সাহসী এবং বলিষ্ঠ উচ্চারণ ভালো লাগে। ভালো লাগে কবিদের হাতের গদ্য। কারণ তা সুখ পাঠ্য। কবি ফরিদ কবিরের “আমার গল্প” পাঠ করে অদ্ভুত এক শিহরণ জাগা পরিস্থিতি তৈরি হলো আমার হৃদয়ে। আধুনিক বাংলা কবিতার শক্তিমান কবি আল মাহমুদের ‘যেভাবে বেড়ে উঠি’পাঠ করেও আমার ভিতরে এ ধরণের ঘোরের সৃষ্টি হয়েছিল। ‘আমার গল্পে’- সম্পত্তি দখলের জন্য গনি মিঞাকে খুন করে তার তিন ছেলেমেয়েকে আলাদা আলাদা ট্রেনে চাপিয়ে দিয়েছিল সাদুল্লার চাচারা। আশি বছর আগে নোয়াখালী থেকে ভাসতে ভাসতে এগারো বছর বয়সে ঢাকার ফুলবাড়িয়া স্টেশনে এসে নামেন সাদুল্লা। বিশৃঙ্খল মানুষের এক নাট্যশালা যেন প্রতিটি রেল স্টেশন। স্টেশনের লাল ইটের নিওগথিক স্থাপত্যের মধ্যে দাঁড়িয়ে সাদুল্লা প্রথম দেখেন শহরের বিচিত্র মুখ। এগারো বছরে প্রথম আবিস্কার সাদুল্লার, জীবনের সিংহভাগ কাটাতে হবে এই বিচিত্র মানুষদের সঙ্গে, এই শহরে। তিন দিন না খেয়েও জীবন যুদ্ধে এগিয়ে যাওয়া সাদুল্লা কিংবা ফরিদ কবিরের আব্বুজি ক্রমশ নিজেকে প্রস্তুত করেছেন বেঁচে থাকার যোদ্ধা হিসেবে। যা ‘আমার গল্প’-এ প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত কবির হাতে আঁকা হয়েছে পরম শ্রদ্ধায়। ফরিদ কবির নিজ হাতে এমন তৈলচিত্র এঁকেছেন যার রেশ বাংলা গদ্য সাহিত্যে দীর্ঘদিন থাকবে বলে আমার বিশ্বাস।
‘আমার গল্প’- এর আর একটি আকর্ষণীয় অধ্যায় হল আমাদের মহান ‘মুক্তিযুদ্ধ’। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের একজন প্রত্যক্ষদর্শী কবি ফরিদ কবির। প্রকম্পিত গুলির আওয়াজ থেকে শুরু করে চোখের সামনে স্বাধীনতা বিরোধীকে গুলি করে হত্যা- এমন সব জীবন্ত দৃশ্যাবলী এবং নিম্ন মধ্যবিত্ত সামাজিক বোধ ও আকাঙ্খার মিশেল স্বপ্নই ‘মোঃ খবির উদ্দিনকে’ ‘কবির উদ্দিন’ পরবর্তীতে বাংলা সাহিত্যের রাজপথে পথচলা আজকের কবি ফরিদ কবির। কবি ফরিদ কবিরের সাহিত্যের যাদুমাখা স্বপ্নিল পথে পা বাড়াতে ভুমিকা রেখেছেন ‘মোমেনা খালা’। জসিম উদ্দিনের বাঙালীর হাসির গল্প’ এবং ’ঠাকুর মার ঝুলি’ বই দুটি কবি ও তার ভাইয়ের মুসলমানিতে উপহার দেন মোমেনা খালা। সেই পাঠাভ্যাস শুরু। কবি নিজেই ঘোষণা দিচ্ছেন গ্রন্থের ১২৭ পৃষ্ঠায় ” সেই আমার বই পড়া শুরু। বইয়ে এতো মজা লুকিয়ে আছে জানতাম না। এরপর বইয়ের খোঁজে রাস্তায় নামলাম। একটা সময় এমন হল, প্রতিদিন অন্তত একটা বই না পড়লে আমার ঘুম হতোনা ।”
মৃগনয়নার নয়নবাণে আবদ্ধ হয়ে পুরুষরা দিগভ্রান্ত হয়। আর কবি সমাজ! সন্ধ্যাতারা, শুকতারা, চন্দ্র, সূর্য, আকাশ, পাহাড়-পর্বত, সমুদ্র সব কিছুতেই নারীর রূপের হাতছানি আর ছলাকলার অপরূপ লীলা খুঁজে বেড়ান। কবি ফরিদ কবিরের জীবনে প্রেম-ভালোবাসা এসব দেখা যায় প্রায়শই। কিন্তু ক্ষণস্থায়ী। ময়মনসিংহ এর চিঠি প্রেম, চুমু থেকে যখন অগ্রসর হয়ে নিজ বাসায় বেডরুমে নতুন দুনিয়ায় উন্মোচিত হয়, তখন একজন তরুণ নিজেকে সামলে রাখবেন কিভাবে। তাইতো রিকশায় চেপে বিয়ের জন্য চাপ দেয়া, চিৎকার করা, সবশেষ কান্ডজ্ঞানহীন ভাবে বিকশা থেকে নামিয়ে দিয়ে চলে যাওয়া - এসবই রাগী যুবকের হৃদয় ক্ষুধার বহিঃপ্রকাশ। এক টিকিটে ইংরেজি দুই মুভি দেখা এবং সেই মুভি দেখার মূল উদ্দেশ্যই হল নায়ক নায়িকার চুম্বন দৃশ্য দেখা - সেই অভিজ্ঞতাই যখন বাস্তবে এলো তখন দেখা গেল ফরিদ কবির কাঁপছেন। শিহরণের আতিশয্যে অথবা অজানা ভয়ে। এমন সব ঘটনাবলী “আমার গল্প”পাঠে জানা যায়।
জীবনান্দ দাশ লেখেন, “সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি।” আব্দুল মান্নান সৈয়দ লেখেন “আবেগ কবিতার কেন্দ্রীয় উৎস”। ফরিদ কবিদের গোগ্রাসে পঠন-পাঠন এবং এদেশের প্রধান কবিদের সাহচর্য, পাশাপাশি পশ্চিম বাংলার কবিদের সাথে মেলামেশা তাঁকে তাঁর ভাষা জ্ঞান, শব্দ শৈলী নির্মাণ, কবিতার রাজপথে পথ চলতে সহজ করেছে। তরুণ লেখকরা যেখানে লিখেই প্রকাশ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন, সেখানে ফরিদ কবির প্রথমে পাঠক, পরে লেখক। ছান্দসিক কবি হিসেবে তাঁর দক্ষতা ঈর্ষণীয়। পঞ্চাশের প্রধান কবি শামসুর রাহমানের বাসায় তাঁর বন্ধু জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর সঙ্গে ফরিদ কবিরের” ওড়ে ঘুস ওড়ে গাঙচিল কাব্যগ্রন্থ নিয়ে যে বাহাস (আমার গল্প পৃ ২০৩-২০৪) তা শিক্ষণীয়। ছন্দের ওপর দখল এবং সেই প্যাটার্ণে লেখার মুন্সিয়ানা যেভাবে ফরিদ কবির দেখিয়েছেন ১৯৮৭ সালেই, এ থেকে তরুণ কবিদের জন্য দিক নির্দেশনা লুকিয়ে আছে। কবিতা লিখতে গেলে কিছুটা চোখ খোলা রাখতেই হয়। পঠন-পাঠন থাকতেই হবে। আর দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টানোর জন্য অবশ্য জরুরী আড্ডা। সাহিত্যের আড্ডা, “আমার গল্প” পাঠে যানা যায়, ফরিদ কবিরের পঠন-পাঠন, সাহিত্য আড্ডা, কবিতার জন্য ভ্রমণ তার সময়ে ষোল আনাই সফল।
কবিরা আবেগী, জীবন-জগৎ নিয়ে উদাসীন থাকেন। তাই কর্মজীবনে কবিরা প্রায়শই হোঁচট খান। জীবনের উন্নতি (ক্যারিয়ার ) নিয়ে যে নোংরা রাজনীতি হয় তা কবিরা বুঝতেই পারেনা। যখন বোধগম্য হয় তখন দেখা যায় কবি আছেন কিন্তু কবির চেয়ার নেই। ফরিদ কবিরের কর্মময় জীবনের উত্থান পর্বে এমন বেশ কিছু দুঃখ জাগানিয় অধ্যায় ‘আমার গল্পে’ সংযুক্ত আছে। কবি মায়াময় চোখ দিয়ে যে দুনিয়া দেখেন কর্পোরেট সোসাইটি দেখে তা অন্যচোখে।
মীর মোশাররফ হোসেনের গদ্যে যে ঐতিহ্যের প্রথম ও শক্তিশালী উন্মোচন, কাজী নজরুল ইসলামের গদ্য তাঁর পরিণত অগ্রগতির স্মারকবাহী। মীরের গদ্যের যে ভাবী ঋজু ক্লাসিক ধর্মিতা বা নজরুলের গদ্যের যে প্রাণবন্যা তার উল্টোটা আমরা দেখি মোতাহের হোসেন চৌধুরীর গদ্যে। আবার বঙ্কিমচন্দ্র, তারাশংকর বন্দোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ, শরৎচন্দ্রের গদ্যে আমরা যে রস আস্বাদন করি তার স্বাদ ভিন্ন। বাংলাদেশের সৈয়দ আলী আহসান, আবদুল মান্নান সৈয়দ, হুমায়ূন আজাদ, আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ, আহমদ ছফার গদ্য পাঠে একটা ভিন্ন স্বাদ পাওয়া যায়। বাংলাদেশের এই সকল গদ্য শিল্পীর পাশাপাশি পশ্চিমবাংলার বুদ্ধদেব বসুর গদ্য অসম্ভব টানে। যেহেতু প্রত্যেক সাহিত্য কর্ম ও শিল্পকর্ম যুগেরই প্রতিভাস, যন্ত্রণা আত্মদহনে রঞ্জিত, আনন্দ ও বেদনার স্মারক- তাই ফরিদ কবিরের ‘আমার গল্প‘-এ যে বর্ণনার ঢঙ আমরা লক্ষ্য করি তা পঠন-পাঠনের গভীরতার জন্য পূর্বসূরী গদ্য শিল্পীদের বলায়ে ঘুরপাক না খেয়ে বিচিত্র ভাবে প্রকৃতি, সংসার, প্রেম, ভালোবাসা অসংখ্য অনুভূতির শিকড় চালিয়ে বিচিত্র রস টেনে শিল্পিতভাবে নির্মাণ করেছেন নিজস্ব গদ্য ঢঙ, যা পাঠে আলসেমি পায়না, বরং শেষ না করে চুম্বকের মত আকর্ষণ করে আটকে থাকে। ফরিদ কবিরের গদ্যের সার্থকতা এখানেই। আমার কাছে গ্রন্থটি কত কপি বিক্রি হয়েছে তা মুখ্য নয়, মুখ্য বিষয় হল ফরিদ কবিরের গদ্যভাষা। আলাউদ্দিন আল আজাদের ‘তেইশ নং তৈলচিত্র’ গল্পের মত। মনে হয় ঘটনার ভেতর আমি উপস্থিত। দেখতি পাচ্ছি নিজ চোখে। আব্বুজির আগমন থেকে প্রস্থান পর্ব পর্যন্ত প্রতিটি ঘটনা মনে হয় যেন আমার সামনেই ঘটে চলেছে। এখানেই ফরিদ কবিরের কারিশমা।
তৌফিক জহুর
কবি ও সম্পাদক,
উদ্যান
সম্পাদক : মোঃ কবির নেওয়াজ রাজ, E-mail: mkprotidin@gmail.com, Contact: (+88) 01643-565087, 01922-619387; Mailing Address: House# 4/A, Main Road, Ati Model Town, Ati, Keraniganj, Dhaka-1312
© All rights reserved © MKProtidin.Com