সম্প্রতি ক্রমবর্ধমান অনেক ঘটনা জনস্বাস্থ্যকে বিপন্ন করে তুলেছে এবং এমনকি বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাকেও চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে। এই সমস্যগুলোর মধ্যে অ্যানথ্রাক্স আক্রমণ, সুনামির মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ, এডিস মশা বাহিত রোগ ডেংগু, চিকুনগুনিয়া, জিকা, ইবোলা ও নিপাহ, সার্স, মার্স ও কোভিড-১৯ এর মতো সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাবগুলো অপ্রত্যাশিতভাবে প্রায়ই জনস্বাস্থ্যরে হুমকির মধ্যদিয়ে মানুষের দূর্বল ব্যবস্থাপনাকে তুলে ধরেছে।
যতবারই আক্রান্ত জনগোষ্ঠীর জীবন বা স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে ঝুঁকির সম্মুখীন হতে হয়েছে ততবারই চিকিৎসকসহ সকল স্বাস্থ্যকর্মীদের ব্যক্তি স্বাধীনতা, সুরক্ষা, নৈতিকতা ও মানবিক মূল্যবোধ নিয়ে আলোচিত হয়েছে। ঠিক এবারও কোভিড-১৯ সংক্রামণের ফলে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার যে দৈন্যদশা উঠে এসেছে তাতে আতঙ্কিত না হয়ে উপায় নেই। স্বাস্থ্য ব্যবস্থার এই আলোচনা, সুরক্ষা, নৈতিকতা ও মানবিক মূল্যবোধ এটা হাজার বছরের প্রশ্ন। তাই গ্রিক চিকিৎসক যাকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের জনক বলা হয় সেই হিপোক্রেটিসকেও হাজার হাজার বছর আগে চিকিৎসা পেশাকে বিতর্কমুক্ত করার জন্য শপথ বাক্য তৈরি করেছিলেন।
এতে বোঝা যায়, তিনি চিকিৎসকের নৈতিকতার ওপর যথেষ্ট জোর দিয়েছেন। বিশেষ করে, চিকিৎসার ক্ষেত্রে বৈষম্য নিরসন, রোগীর গোপনীয়তা রক্ষা করাসহ অনেক বিষেয়ে গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। ভারতবর্ষে চরক ও শশ্রুতায় (খ্রিস্টপূর্ব ২০০-৫০০) মতে সেবার সময় সকলের প্রতি ভাল ব্যবহার, দয়া, রোগীকে নিরীক্ষা করে সকল সুবিধা দেয়ার ও রোগীর আরোগ্য লাভ না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করার মতো বিষয়গুলোর কথা বলা হয়েছে। এছাড়া ইংরেজি দার্শনিক বেন্থাম তাঁর "ডিওন্টোলজি বা নৈতিকতার বিজ্ঞান" গ্রন্থসহ অনেকে চিকিৎসা পেশার নৈতিকতা বিষয়ক অনেক গ্রন্থ তৈরি করেছেন।
আধুনিককালে চিকিৎসা ক্রমশ বিজ্ঞানভিত্তিক হয়ে উঠলেও চিকিৎসকের নৈতিকতার বিষয়টি কখনো আলোচনার বাইরে থাকেনি বরং চিকিৎসকের এই নৈতিক অবস্থানই চিকিৎসককে রোগীর কাছে আস্থাভাজন করে তুলেছে, তাঁকে মর্যাদার আসনে বসিয়েছে যা চিকিৎসা পেশাকে অন্য পেশা থেকে আলাদা করে তুলেছে।
জনস্বাস্থ্যের জরুরি প্রস্তুতি এবং কার্যক্রম বাস্তবায়নের যেকোন পর্যায়ে নৈতিকতার বিচ্যুতি দেখা দিতে পারে উদাহরণস্বরূপ,সম্পদ ব্যবহার ও বন্টন, মানুষের অধিকার ইত্যাদি। জরুরি অবস্থায় প্রায়শই সামাজিক অবিচারের বিদ্যমান অবস্থাগুলোকে আরও বাড়িয়ে তোলে।
জীবন-রক্ষাকারী সংস্থাগুলি জরুরি প্রস্তুতি এবং কার্যক্রম বাস্তবায়নের অন্যতম কঠিন চ্যালেজ্ঞ নৈতিকতা বজায় রাখা। সীমিত সম্পদগুলো বিশেষ করে মেডিকেল (ওষুধ, ভ্যাকসিন, ভেন্টিলেটর এবং হাসপাতালের বিছানা) কাঠামোগত দিক (বিদ্যুৎ, পানি),বা মানবসম্পদ (স্বাস্থ্যকর্মীরা) নির্বিশেষে তাদের বিতরণ সংক্রান্ত বিষয়ে সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে কিছু সদস্যকে অগ্রাধিকার দেওয়া অন্যদেরকে প্রভাবিত করে।
বিতর্কিত বা সমস্যার মুখোমুখি যাতে না হওয়া লাগে তার জন্য নীতিনির্ধারকদেও দেশের নীতিমালা অনুযায়ৗ পেশাদারীত্বে সাথে কার্যক্রম বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা চালানো উচিত যা ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর প্রয়োজনীয়তা মোকাবেলা করতে পারে। নীতিনির্ধারকদের বা জরুরি পরিকল্পনাকারীদের নৈতিক বিষয়কে বিবেচনায় রাখা উচিত কারণ জনস্বাস্থ্য ও সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাবের কারণে সামাজিক দূরত্ব, ভ্রমণের সীমাবদ্ধতা এবং যোগাযোগের মতো বিষয়গুলির সিমাবদ্ধতা পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তোলে।
নৈতিক বিধিসমূহ পেশাগত কারণে জরুরি অবস্থার সময়ে চিকিৎসা সেবা প্রদানের জন্য স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের দায়বদ্ধতার করে। সাধারণত স্বাস্থ্যকর্মীদের সামাজিক চুক্তি বা পেশাদার হিসাবে সহায়তা প্রদান প্রত্যাশা করে এবং সেখানে নৈতিক বিধি রয়েছে। তবে রোগীদের চাহিদা এবং যত্ন নেওয়ার দায়িত্ব তাদের প্রদত্ত যেকোনও জরুরি অবস্থার সাথে সম্পর্কিত ব্যক্তিগত ঝুঁকির বিরুদ্ধে ভারসাম্যপূর্ণ হওয়া উচিত। সার্স, ইবোলা করোনা প্রাদুর্ভাব হিসেবে দেখা গেছে যে সংক্রামক রোগের সংস্পর্শে আসা স্বাস্থ্যসেবা কর্মীরা সংক্রমিত করতে পারে, তাদের পরিবারকে সংক্রমিত করতে পারে। নীতিনির্ধারকদের বিবেচনা করা উচিত যে জনস্বাস্থ্যের উন্নতিতে ব্যক্তিগত ঝুঁকি গ্রহণকারীদের বিষয়কে অগ্রাধিকারযোগ্য ও নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে দায়বদ্ধতা থেকে দায়মুক্তি দেয়া এবং সুরক্ষা সামগ্রী প্রদানের মতো বিষয়গুলো প্রমাণ করে যে জরুরিকাজ বাস্তবায়ন একটি সম্মিলিত উদ্যোগ।
স্বাস্থ্যসেবা কর্মীরা যদি সুরক্ষা না পান তাহলে হাজার হাজার মানুষ আক্রান্ত হয়ে যেতে পারে, চিকিৎসা ব্যবস্থা ব্যাহত হবে। এজন্য স্বাস্থ্যকর্মীদের নিরাপত্তা আগে দরকার। কোভিড-১৯ এর মতো পরিস্থিতিতে লকডাউনের ফলে আমরা যখন সকলে ঘরবন্দি, তখন অনেকেই কোভিড-১৯ মহামারির বিরুদ্ধে সামনের সারি থেকে লড়ছেন, এঁরা হলেন স্বাস্থ্যকর্মী, জরুরি ও অপরিহার্য পরিষেবা প্রদানকারী কর্মীরা। নীতিনির্ধারকদের দায়িত্ব এই সব মানুষের খেয়াল রাখা।
স্বাস্থ্যকর্মীদের নৈতিকতা ও পেশাগত অনুশীলনের মাধ্যমে রোগীর স্বাস্থ্য বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে রোগী, চিকিৎসক বা অন্যান্য পক্ষের মধ্যে মতবিরোধ নিরসন জরুরি। এক্ষেত্রে অর্থোপার্জন বা অনেক বেশি রোজগারের চেয়ে একজন নৈতিক চিকিৎসক হওয়া আরও গুরুত্বপূর্ণ। স্বাস্থ্যব্যবস্থায় নার্স, প্যারামেডিক, মিডওয়াইফ, ল্যাবটেকনেশিয়ানসহ অন্যদের পেশাদারীত্ব ও নৈতিকতার বিষয়ে খুব কম গুরুত্ব দেওয়া হয়। ১৯৪৯ সালে গৃহীত ওয়ার্ল্ড মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের জেনেভা ঘোষণাপত্রটি চিকিৎসকের জন্য এক ধরনের শপথ, এতে বেশ কয়েকটি বিধান রয়েছে।
এখানে পরামর্শ দেওয়া হয় "আমি আমার পেশাগত দায়িত্ব সৎ ও মর্যাদার সাথে পালন করব বা ধর্ম, জাতীয়তা, জাতি, রাজনৈতিক মতামত বা সামাজিক কোন কারণে আমার দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করতে এবং আমার এবং আমার রোগীর মধ্যে উপস্থিত হতে দেব না।”
পেশাদারিত্ব ও নৈতিকতা সম্পর্কে কর্মীদের শিক্ষা প্রদান করা এবং কর্মীদের ওপর নৈতিক বিষয়সমূহ তদারকি করা। চিকিৎসক তার তত্ত্বাবধানাধীনে কর্মরত অন্যদেরকে সঠিক এবং সাম্প্রতিক তথ্য প্রদান, সময়মত মূল্যায়ন, গঠনমূলক পরামর্শ দেয়ার মাধ্যমে অধিকতর পেশাগত উন্নয়ন সহযোগিতা করার মনোভাব থাকতে হবে।
যারা চিকিৎসা পেশায় নিয়োজিত, যেমন, ডাক্তার, মনোবিজ্ঞানী, কাউন্সেলর, নার্স, হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোর কর্মচারী বিশেষত বর্তমানে কোভিড-১৯ নিয়ে কাজ করছেন তাদের মানসিক চাপ থকলে অবশ্যই কাজের গুণগত মান কমে যাবে এবং সেবাগ্রহীতা বঞ্চিত হবে যা পেশাগত নৈতিকতার পরিপন্থী। তাই এই ধরনের পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তিদের সব সময় নিজের শারীরিক ও মানসিক চাপ মোকাবেলা করে সেবাগ্রহীতাকে সেবা দিতে হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে ‘everyone has an equal opportunity to enjoy the highest attainable level of health’ এবং তাদের এই স্বাস্থ্য অধিকার ভোগে যেমন আছে স্বাধীনতা তেমনি আছে তথ্য অধিকার ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার।
ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নালে বলা হয়েছে, মানুষের ভুল অবশ্যই হতে পারে। তবে চিকিৎসায় ভুল হলে প্রথম কাজ হচ্ছে ভুলটাকে দৃশ্যমান করা অর্থাৎ গোপন না করা, যেন সেই ভুলের ক্ষতি কমাতে উদ্যোগ নেওয়া যায়। ভুল হলে তার প্রতিকার কী হবে, তার ব্যবস্থাপনাও হাতের কাছে রাখা দরকার। আর কিছু নীতি মেনে চলতে হবে, যেন ভুল কম হয়। ইটালিতে কোভিড-১৯ বিরুদ্ধে লড়াইয়ে প্রথম সারিতে থাকা চিকিৎসকরা বলছেন যে, এত রোগীর ভিড় যে কাদের তারা বাঁচানোর চেষ্টা করবেন এবং কাদের ফেলে রাখবেন তা তাদেরকে বেছে নিতে হচ্ছে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণে এখনও প্রতিদিন আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই বিপুল পরিমাণ রোগীদের চিকিৎসা দেয়ার জন্য হাসপাতালের পর্যাপ্ত বিছানার ব্যবস্থা করতে রীতিমত সংগ্রাম করে যাচ্ছেন তারা।
চিকিৎসকদের রেজিস্ট্রেশন প্রদানকারী সংস্থা মেডিকেল ও ডেন্টাল কাউন্সিল আইন ও শর্তসমূহ মেনে চলা অত্যাবশ্যকীয়। চিকিৎসকদের পেশা চর্চার অনুমতি দেয়া এর নৈতিকতা বিষয়ক সম্মতিপত্রের ২.৫.৩ এবং ২.৫.৪ এ এই বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেয়া আছে যে “ক্লিনিকাল সেটিং বা কমিউনিটিতে ইমারজেন্সি অবস্থায় নিজের নিরাপত্তা, যোগ্যতা এবং সেবার বিকল্প ব্যবস্থা বিবেচনা করেই চিকিৎসক এমতাবস্থায় সেবা দিবেন” এবং “চিকিৎসকের নিজের স্বাস্থ্যের যেকোনো ঝুঁকি থেকে তার সহকর্মী এবং অন্যান্য রোগীদের রক্ষা করতে হবে”।
বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৫, ১৮ ও ২১ এ চিকিৎসাসেবা সম্পর্কে কিছু দিক নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এছাড়া মৌলিক অধিকার হিসেবে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩২ এ যদিও সরাসরি চিকিৎসা সেবাকে স্বীকৃতি দেয়া হয়নি তারপর ও অনুচ্ছেদ ৩২ যদি ব্যাপকভাবে বিশ্লেষণ করা হয় তাহলে দেখা যাবে চিকিৎসাসেবার সাথে জীবন রক্ষা বা জীবন ধারনের একটি শক্তিশালী সম্পর্ক রয়েছে। কোভিড-১৯ এর মতো মহামারীর সময়ে একজন চিকিৎসক অবশ্যই তার পেশাদারীত্ব এবং মানবিকতার বিবেচনায় রোগীর সেবা করবেন। তবে নীতিনির্ধারকদের উচিত স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের সুরক্ষার ও নিরাপত্তা বিষয়টি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিবেচনা করা।
একজন আধুনিক স্বাস্থ্যকর্মীর পেশাদারিত্ব ও বিস্তৃত দিগন্ত থাকতে হবে। রোগীর প্রতি স্বাস্থ্যকর্মীর মনোযোগী ও সৌহার্দ্যপূর্ণ আচরণ পেশাদারিত্বের সফল দিক। অন্যান্য পেশায় যেমন ভালো আছে, খারাপ আছে, তেমনি স্বাস্থ্য সেবাও এর ব্যতিক্রম নয়। রোগী একজন মানুষ যার মর্যাদাবোধ আছে, আছে মৌলিক অধিকার।
সুতরাং চিকিৎসক ও চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি শুধু সংবিধান ও দেশের আইন মেনেই চলবেন না, আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত নৈতিক মানদন্ডগুলোও তিনি পেশাদারিত্বের বেলায় প্রয়োগ করে সিদ্ধান্ত নেবেন। নীতিনির্ধারকদের ভাবা দরকার একজন চিকিৎসক নিজের মর্যাদা ও রোগীর মর্যাদা সমুন্নত কীভাবে রাখতে পারেন। পেশার গুণগতমান, প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা অর্জনের পাশাপাশি সেই প্রশিক্ষণলব্ধ জ্ঞান নৈতিকভাবে কাজে লাগানোর ইচ্ছায় পেশাদারীত্ব।
লেখক- ইকবাল মাসুদ, পরিচালক, স্বাস্থ্য সেক্টর, ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন।
সম্পাদক : মোঃ কবির নেওয়াজ রাজ, E-mail: mkprotidin@gmail.com, Contact: (+88) 01643-565087, 01922-619387; Mailing Address: House# 4/A, Main Road, Ati Model Town, Ati, Keraniganj, Dhaka-1312
© All rights reserved © MKProtidin.Com