সংখ্যায় ওরা ছয় জন। জয়, সাইমুন, জুবায়ের, মাঈনুল, রহিম ও ইমরান। বয়সটা তাদের ১৬-১৭। দুজন ঢাকায় থাকে। বাকি চারজন গ্রামে। ঈদ উপলক্ষে সুন্দরবনে বেড়াতে যাওয়ার পরিকল্পনা করে তারা। যেই ভাবনা, সেই কাজ। পরিকল্পনা অনুযায়ী তারা গতকাল বুধবার সকালে সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের ধানসাগরে বেড়াতে আসে।
সকাল ১০টা। ধানসাগরের লাগোয়া এলাকায় বনরক্ষীদের অফিস রয়েছে। পাশেই একটি ছোট খাল। খাল ওপাড়ে যাওয়ার জন্য একটি কাঠের পুল রয়েছে। পুলটি সাধারণ মানুষের জন্য নয়। এই সুন্দরবন পাহারা দিতে যে বনরক্ষীরা যান,কেবলমাত্র তারাই এটি ব্যবহার করেন।
ছয় কিশোর লোক চক্ষুর অন্তরালে পুল পাড় হয়ে খালের ওপারে চলে যায়। এরপর গল্প করতে করতে তারা সুন্দরবনের ভেতরে হাঁটতে থাকে।সকাল গড়িয়ে দুপুর। দুপুর গড়িয়ে বিকেল। তাদের যে ফিরতে হবে, সেই ভাবনাই নেই। বিকেলে দূর থেকে ভেসে এলো আছরের আজানের শব্দ। এবার তাদের ফেরার কথা মনে হলো।
যেপথে তারা এসেছে, সেই পথে উল্টো দিকে কিছু দূর হাঁটলো।এরপরই পথ হারালো তারা। ঠিক পথে আসার পরিবর্তে উল্টো বনের গহীনে যেতে লাগলো।এদিকে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা। বেরুনোর কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছে না তারা। কী করবে মাথায় কিছু আসছেও না।
তাদের সাথে ছিলো তিনটি মোবাইল ফোন। তাতে নেটওয়ার্ক আসে যায়, আসে যায়। ফোন দিয়ে তাদের পরিবারকে জানালো নিজেদের দুর্দশার কথা। হারিয়ে যাওয়াদের দলের একজন বুদ্ধি করে পুলিশ পরিচালিত জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ ফোন করে। ৯৯৯ সঙ্গে সঙ্গে শরনখোলা থানার সাথে যোগাযোগ করিয়ে দেয়। এদিকে নৌ-পুলিশকেও বিষয় অবহিত করা হয়। নিজেদের সমস্যার কথা জানিয়ে বনের মধ্যে পথ হারানো তরুণেরা তাদের উদ্ধারে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য পুলিশের কাছে অনুরোধ জানায়।
খবর পাওয়া মাত্রই শুরু হয় পুলিশের উদ্ধার অভিযান। কিন্তু এতবড় সুন্দরবনে কারও অবস্থান জানা তো সহজ সাধ্য নয়। ওদিকে, ওই কিশোরদের সাথে থাকা দুটি ফোন চার্জের অভাবে বন্ধ হয়ে গেছে।সচল কেবল একটি। সেটির মাধ্যমেই তাদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছিল পুলিশ।
অভিযানের শুরুতেই কিশোরদের বনের মধ্যে হাঁটা চলা না করে গাছে চড়ে বসার জন্য পরামর্শ দিলো পুলিশ।কারণ বনের চাঁদপাই রেঞ্জের ওই অংশে বাঘের চলাচল আছে। কিন্তু শুরুর কিছু সময় পরই শুরু হলো বৃষ্টি। এতে বনের মধ্যে এক গোমট অন্ধকারে সৃষ্টি হলো। আরও ভয় পেয়ে গেলো কিশোরেরা। আর এর মধ্যেই তাদের ফোনের নেটওয়ার্কও চলে গেল।
মোবাইল ফোনে কল করার জন্য একের পর এক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। এভাবে কাটল ঘন্টা খানেক সময়। তাদের সাথে পুনরায় মোবাইল ফোনে যোগাযোগ স্থাপন করতে সক্ষম হয় পুলিশ।কথায় এক পর্যায়ে তারা জানায়, মাইকে এশার আজানের শব্দ শুনেছে তারা।এ কথা শুনে নতুন করে পরিকল্পনা করে পুলিশ।
কিন্তু সমস্যাটা হলো বনের ওই এলাকার দুই পাশে দুটি মসজিদ আছে। কাজেই কোন মাইকের শব্দ তারা শুনতে পেলো, সেটি জানতে পারলে তাদের অবস্থানের ব্যাপারে কিছুটা ধারণা পাওয়া যাবে। এবার একটি মসজিদের মাইক দিয়ে তাদের ডাকা হলো। আর ফোনে জানতে চাওয়া হলো, আওয়াজ শোনা যায় কিনা? জবাব এলো, খুবই কম। এবার বনের অন্য পাশের মসজিদের মাইক দিয়ে ডাকা হলো। এবার মোবাইল ফোনে কিশোরেরা জানালো, তুলনামূলক স্পষ্ট শব্দ শুনতে পাচ্ছে তারা। এটার মাধ্যমে বনের মধ্যে তাদের অবস্থানটি কিছুটা আঁচ করে নিলো পুলিশ। সুন্দরবনের ভেতরে স্বাভাবিকভাবে ৩-৪ কিলোমিটার পর্যন্ত শব্দ শোনা যায়। আর রাতে সেটি আরও গহীন থেকে শোনা যায়। তাই সুন্দরবনের ৪-৫ কিলোমিটার ভেতরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে এগুতে থাকে পুলিশ।
সুন্দরবনের ভেতর হাঁটা সহজ নয়। কেওড়ার শ্বাসমূলের সাথে লতাগুল্ম। ঝোপঝাড় আর নানান ধরনের কাঁটা।রাতের অন্ধকারের সাথে বৃষ্টি। পিচ্ছিল পথে এ যেন এক কণ্টকাকীর্ণ যাত্রা। কয়েক ঘন্টা ধরে সেই পথ পাড়ি দিয়ে বনের আরও ভেতরে গেল পুলিশ। এবার ফোন ওই কিশোরদের পুলিশ বললো, আমরা হাঁক তুলবো। যদি তোমরা শুনতে পাও তো তোমরাও হাঁক তুলবে। পুলিশ বনের মধ্যেই হাঁটতে হাঁটতে হাঁক তুললো। কিন্তু ওই পাশ থেকে সাড়া নেই। ঘন্টা খানেক পর ওপাশ থেকেই হাঁকের জবাব এলো। এবার পুলিশ বুঝতে পারলো, কাছাকাছি চলে এসেছে তাঁরা। হাঁক দিতে দিতে একসময় হারিয়ে যাওয়া কিশোরদের খুঁজে পায় পুলিশ। ততক্ষণে যে রাত তিনটা বেজে গেছে।
দীর্ঘক্ষণ বনের মধ্যে এমন প্রতিকূল পরিবেশে থেকে মুশড়ে পড়েছে কিশোরেরা। পুলিশ ধরাধরি করে তাদের নিয়ে থানায় ফিরতে ফিরতে রাত পেরিয়ে ভোর। দীর্ঘক্ষণ কিছু না খেতে পেরে আরও ক্লান্ত কিশোরেরা। থানায় এনে প্রাথমিক শুশ্রূষার প্রদানের পাশাপাশি খাবার খেতে দেয় পুলিশ। এরপর মিষ্টিমুখ করিয়ে কিশোরদের পরিবারের হাতে তুলে দেয় পুলিশ।
সন্তানদের ফিরে পেয়ে পরিবারের সদস্যদের চোখে তখন আনন্দ অশ্রু। বুকে সন্তান জড়িয়ে বাংলাদেশ পুলিশের জন্য প্রাণভরে দোয়া করলেন তাঁরা। জানালেন অশেষ কৃতজ্ঞতা।
থানা থেকে বিদায়বেলা হারিয়ে যাওয়া দলের এক তরুন থমকে দাঁড়ালেন। পুলিশকে লক্ষ্য করে বলল,"বনের ভেতরে যখন হারিয়ে গিয়েছিলাম, তখন বারবার মনে হয়েছে এ জীবনে আর ফেরা হবে না। কিন্তু পুলিশের কারণে আমরা ছয়জন আবার নতুন জীবন পেলাম। আমি পড়াশোনা করে পুলিশ হতে চাই।"
সর্বদাই জনগণের পাশে, বাংলাদেশ পুলিশ।
সূত্র:বাংলাদেশ পুলিশ
সম্পাদক : মোঃ কবির নেওয়াজ রাজ, E-mail: mkprotidin@gmail.com, Contact: (+88) 01643-565087, 01922-619387; Mailing Address: House# 4/A, Main Road, Ati Model Town, Ati, Keraniganj, Dhaka-1312
© All rights reserved © MKProtidin.Com