সাংবাদিকতা পেশা হচ্ছে সমাজসেবার একটি অনান্য রূপ।মানবিক ও সুন্দর সমাজ গঠনে দায়িত্বশীল হিসেবে সাংবাদিকতা পেশা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম। মানুষকে সচেতনার মাধ্যমে সঠিক পথে চলতে সহায়তা করে। স্বচ্ছতার মাধ্যমে দেশ ও মানবিক জাতি গঠনে সাংবাদিকদের ভুমিকা অপরিহার্য। সাংবাদিকদের মেধা, মনন, মনুষ্যত্ব বোধ থেকে উচ্চারিত হয় সত্যনিষ্ঠা, নীতিবোধ ও দেশপ্রেম। তাই এসব গুণের অধিকারী সাংবাদিকদের শোষণ, জুলুম, নির্যাতনের বিরুদ্ধে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনে সোচ্চার ভুমিকা রাখতে হবে। সাংবাদিকতার এ মহান পেশাকে সমাজ বা জাতির দর্পন বলা হয়। বাস্তব মুখি জীবন, দেশ ও বিশ্বের বিভিন্ন চিত্র প্রতিদিন সংবাদপত্রের পাতায় ফুটে ওঠে। আয়নায় দেখা নিজের চেহারার মত প্রতিবিম্ব সংবাদপত্রে চলমান জীবন, সমাজ, রাষ্ট্র ও বিশ্বের চিত্র ভেসে ওঠে। সাংবাদিকদের সত্য ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ সুষ্ঠু ও সুন্দর সমাজ গঠনে সহায়তা করে। মানুষকে সচেতন করে তোলে। দূর্নীতিবাজ ও অপরাধমূলক কর্মকান্ডের সংগে জড়িতরা আতঙ্কে থাকে। দায়িত্বশীল সাংবাদিকতার ভয়ে তারা দূর্নীতি ও অপরাধ মূলক কর্মকান্ড থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়। সাংবাদিকদের মেধা, মনন, মানবতাবোধ থেকে উৎসারিত হয় সত্যনিষ্ঠা, নীতিবোধ ও দেশপ্রেম। তাই এই সব গুণের অধিকারী সাংবাদিককে বলা হয় জাতির বিবেক।
সাংবাদিকতা বর্তমানে গুরুত্বপূর্ণ পেশা হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছে। সাংবাদিকের মুখ্য ও পবিত্র দায়িত্ব হলো চলমান ঘটনা ও বাস্তবতাকে সকলের সামনে তুলে ধরা। সাংবাদিকতা পেশার সাথে মনুষ্যত্বের সম্পৃক্ততা না থাকলে সে পেশায় স্বচ্ছতা থাকে না। তাই বস্তনিষ্ঠ সংবাদের গতি হারায় ও ম্রিয়মান হয়ে পড়ে। এখানে সত্যনিষ্ঠা ও নীতিবোধ নির্ভর করে সাংবাদিকের দৃষ্টিভঙ্গী, মন-মানসিকতা ও নৈতিকতার উপর। অসৎ ও দায়িত্বহীন সাংবাদিকতা এ পেশার জন্য যেমন ক্ষতিকর, তেমনি সমাজ, দেশ ও জাতির জন্যও তেমন ক্ষতিকর। সাংবাদিকতা পেশার প্রথম ও প্রধান কাজ হলো সততা ও দায়িত্বশীলতা। সৎ, মেধাবী ও নির্ভীক সাংবাদিক জাতির পথ প্রদর্শক। সংবাদপত্র সরকারের চতুর্থ স্তম্ভ হিসাবে খ্যাত। উইকহ্যাম স্টিডের মতে “সাংবাদিকতা হচ্ছে সমাজ সেবার একটি আধুনিক রূপ”। সুষ্ঠ ও সুন্দর সমাজ গঠনে দায়িত্বশীল সাংবাদিকতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। মানুষকে সচেতন করে তোলে। দেশ ও জাতিগঠনে সংবাদপত্রের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
আমাদের দেশে অনেক ক্ষেত্রে সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নেই। দুনীতি, অপকর্মের সংবাদ প্রকাশিত হলেই সংশ্লিষ্টরা সাংবাদিকে মেরে ক্ষোভ মেটায়। মিথ্যা মামলায় দিয়ে হয়রানি করা হয়। অনেক সাংবাদিক নিউজ কভার করতে গিয়ে আক্রমন ও হামলার শিকার হচ্ছে। হামলায় অনেককে মারাত্মক আহত ও পঙ্গুত্ব নিয়ে জীবন যাপন করতে হচ্ছে। সংবাদকর্মিরা দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে শুধু আহত নয় অনেকে নিহত হয়েছেন। তাদের পরিবার-পরিজনদের নিরাপত্তা নেই। বিচারের আশায় আদালতের দারে দারে ঘুরছে। গণতন্ত্রের জন্য গণমাধ্যমের স্বাধীনতা অপরিহার্য। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা না থাকলে সেখানে দূনীতি, সন্ত্রাস বেড়ে যায় এবং গণতন্ত্র ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে। সাংবাদিকদের নিরাপত্তা না থাকায় ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে।
ইউনেস্কোর তথ্য মতে, গত কয়েক বছরে বিশ্বে প্রায় তিনশত সাংবাদিক দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নিহত হয়েছে। আর ২০০৫ সালে এখন পর্যন্ত নিহত হয়েছেন ৭৮৭ জন সাংবাদিক। রিপোটার্স উই দাউট বর্ডারস (আরউবিডবিøবি) নামে ফ্রান্সভিত্তিক আন্তর্জাতিক একটি সংস্থার রিপোর্টে বলা হয়েছে, দায়িত্ব পালনের সময় বা সংশ্লিষ্ট কাজে ২০১৯ সালে সারা বিশ্বে ১২৬ জন সাংবাদিক হত্যার স্বীকার হয়েছে। বাংলাদেশেও এ সংখ্যা কম নয়। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্যমতে ২০১৯ সালে বাংলাদেশে ৩১৫ জন সাংবাদিক হয়রানির স্বীকার হয়েছেন, যার মধ্যে চারজন নিহত হন। তথ্যের স্বাধীনতা মানুষের মৌলিক অধিকার। কিন্তু বর্তমান বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রকাশনাকে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। কখনও কখনও সাংবাদিককে আবার কখনো সম্পাদকদের হয়রানি করা হচ্ছে। গত এক যুগের মধ্যে ২০১৯ সালে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সর্বনিন্ম সুচকে অবস্থান করেছে বলে প্রকাশিত এক রিপোর্টে বলা হয়েছে। আরো বলা হয়েছে কাজের জন্য সবচেয়ে ‘প্রাণঘাতী’ হিসাবে চিহ্নিত শীর্ষ পাঁচটি দেশ হিসাবে সিরিয়া, ইরাক, ফ্রান্স, ইয়েমেন ও দক্ষিণ সুদানের নাম উল্লেখ করা হয়েছে।
দুর্নীতি দমন ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় সাংবাদিক ও সংবাদপত্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। কিন্তু গণমাধ্যমকর্মীরা স্বাধীনতা ভোগের পরিবর্তে নানা ভাবে অপদস্থ ও নির্যাতিত হচ্ছেন। গণমাধ্যম হচ্ছে সমাজের পথপ্রদর্শক। তাই গণতন্ত্রের জন্য গণমাধ্যমের স্বাধীনতা অপরিহার্য। তবে মনে রাখতে হবে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা মানে যা খুশি তাই লেখা বা প্রকাশ করা নয়। প্রকাশিত প্রতিবেদনে অবশ্যই সত্য, বস্তুনিষ্ঠ ও যথার্থ হতে হবে। সংবাদপত্র কোন সত্যকে মিথ্যা আবার কোন মিথ্যাকে সত্য করার মাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে গোষ্ঠি, জাতি ও দেশের শান্তি বিঘিন্ত হতে পারে এমন কোন সাংঘার্ষিক প্রতিবেদন নয়। সাংবাদিকদের প্রতিবেদনে বিভক্তি সৃষ্টি না হয়, সে জন্য চোখ-কান খোলা রেখে সজাগ থেকে প্রতিবেদন তৈরিতে বিচক্ষনতা দেখাতে হবে। তবে একথাও সত্য সব সাংবাদিক একেবারে ধোয়া তুলসীপাতা নয়, তাদেরও দোষ-গুণ থাকাটাই স্বাভাবিক। হীনস্বার্থে ব্যক্তি বা দলের লেজুরবৃত্তি করা সাংবাদিকের কাম্য নহে। সত্য ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ সাংবাদিক তার লেখনীর মাধ্যমে প্রকাশ করবে, এটাই সকলের কাম্য।
আজ দেশের সাংবাদিগণ কতটুকু নিরাপদ তা জনগণের কাছে দৃশ্যমান। কারণে-অকারণে সাংবাদিকদের দোষারোপ ও হয়রানি করা হয়ে থাকে। ফলে সাংবাদিকেরা দিন দিন অধিকশঙ্কা ও নিরাপত্তাহীনতায় ভূগছে। সাংবাদিকদের ঝুঁকিপূর্ণ কাজে বৈরী পরিস্থিতিতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশ ও জনগণের কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে সাংবাদিক, সংবাদপত্র ও গণমাধ্যমকে এগিয়ে আসতে হবে। তার আগে সাংবাদিকদের মধ্যে বিভাজন দুর করতে হবে। সাংবাদিকদের মধ্যে নানামত ও অনৈক্য সৃষ্টি করেছে বিভাজন। এই বিভাজন থেকে একে অপরের সাথে বিরোধ ও সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছে, যা খুবই দুঃখজনক। সাংবাদিকদের নিজ স্বার্থে সকল মতভেদ ভূলে গিয়ে আগে ঐক্যবদ্ধ হওয়া জরুরী। সাংবাদিকরাই হচ্ছে জাতির বিবেক। সমৃদ্ধ দেশ গড়তে গণমাধ্যমের ভূমিকা অপরিসীম। সাংবাদিক সমাজ ঐক্যবদ্ধ থাকলে যে কোন অপশক্তিকে প্রতিহত করা সম্ভাব। সাংবাদিকদের নিজের নিরাপত্তা, গণতন্ত্র সুদৃঢ় ও জনগণের কল্যাণে সম্মিলিত ঐক্য কামনা করি।
মোঃ লিয়াকত হোসেন
রাজশাহী জেলা প্রতিনিধি, মানুষের কল্যাণে প্রতিদিন