প্রিন্ট এর তারিখঃ নভেম্বর ২২, ২০২৪, ২:০৭ এ.এম || প্রকাশের তারিখঃ অক্টোবর ১৭, ২০২০, ১০:২৩ এ.এম
আমার বন্ধু ও কবি শাকিল রিয়াজ। দেখতে দেখতে পঞ্চাশে পদার্পণ করলো। ১৭ অক্টোবর ৫০ এ।বিষয়টি আনন্দের। আমাদের নব্বই দশকের বাংলা কবিতার একজন কবি সে। পৃথিবীতে অর্ধশতাব্দীকাল বিচরণ করছে শাকিল। বর্তমানে সুইডেনে পরিবারসহ বসবাস। শুরুতে বললাম, বিষয়টি আনন্দের। কারণ নব্বই দশকের কবিদের বয়স একে একে পঞ্চাশ হতে চলেছে। পঞ্চাশ মানে আকাশ দেখার মধ্যে একটা অভিজ্ঞতা থাকবে। এক জোড়া চোখ পরিপক্ব। দিনরাতের পার্থক্য চেনার উত্তম সময়। বৃষ্টির আওয়াজে নূপুরের ধ্বনি এই বয়সেই শোনা যায়। শরতের কাশফুলের উদাস চাহনি এ সময়েই ধরা পরে। পঞ্চাশ মানে পরিপূর্ণ যুবক। বন্ধু শাকিল রিয়াজ এর সঙ্গে আমার পরিচয় ১৯৯৭ সালে। বগুড়া থেকে এসেছিলাম। উদ্যান লিটল ম্যাগাজিন বের করবো।লেখা নিতে। পরিচয় শুরু। পরে বন্ধুত্বের দারুণ পর্যায়ে চলে যাই আমরা। শাকিল রিয়াজ তখন দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকায় ফিচার বিভাগে। আমি ১৯৯৭ সালের শেষে ঢাকায় চলে আসি জীবন জীবিকার জন্য। শাকিল রিয়াজ এর সঙ্গে সখ্যতা বাড়ে। " বাংলা কাব্যের দুই গর্বঃ শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ " শীর্ষক এক প্রবন্ধ লিখে শাকিল রিয়াজ কে দিলাম। তিনি দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকার সাহিত্য পাতায় তা প্রকাশ করলেন। এ নিয়ে নব্বই দশকের শেষ পর্যায়ে বেশ হৈচৈ হয় শাহবাগে। পরবর্তী সময়ে জনকন্ঠে বেশ কয়েকটা গদ্য ও কবিতা প্রকাশ হয়। সে সময় মুখ চিনে লেখা ছাপা হতোনা।গুণগত মান বিচার হতো লেখার।একটা সময় ছিলো। বন্ধু শাকিলের সঙ্গে দেখা হওয়া মানেই কবিতা নিয়ে আলোচনা। শাকিলের কবিতা নিয়ে আজ কিছু বলতে এরাদা করেছি।
ব্যক্তি শাকিল রিয়াজঃএকটি পরিচিতি
জন্ম ১৭ অক্টোবর ১৯৭০। গ্রামের বাড়ি বরিশালের মুলাদী উপজেলায়। জন্ম নারায়ণগঞ্জ। পিতা মোঃ মজিবুল ইসলাম, মাতা ফৌজিয়া ইসলাম। শৈশব কৈশোর কেটেছে ফরিদপুরে।তিনি ১৯৮৫ সালে ফরিদপুর জেলা স্কুল থেকে মাধ্যমিক ও ১৯৮৭ সালে রাজেন্দ্র কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন। অতপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে এম এ পাশ করেন ১৯৯২ সালে। সুইডিশ ভাষা, সাহিত্য ও সমাজ কল্যাণ বিষয়ে পড়েছেন স্টকহোম ইউনিভার্সিটিতে (২০০৬-২০০৭)। স্টকহোমের স্কুল অব কমপিটেন্স ডেভেলাপমেন্টে পড়েছেন কোয়ালিফায়েড রিসার্চিং নিয়ে (২০০৯)। ক্যারোলিনস্কা ইনস্টিটিউট থেকে “ভ্যালুস এন্ড লিডারশিপ” বিষয়ে উচ্চতর কোর্স করেছেন (২০১৩)।
স্কুল-জীবনেই লেখালেখিতে হাতেখড়ি। সাংবাদিকতায় দীক্ষাও স্কুল জীবনে। ফরিদপুর জেলা স্কুলে অধ্যয়নকালে জাতীয় ও স্থানীয় পত্রপত্রিকায় লেখা প্রকাশিত হয়। সম্পাদনা করেছেন কলেজ শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে প্রকাশিত পত্রিকা “রক্তাক্ত সংলাপ”। ফরিদপুরে লিটলম্যাগ আন্দোলনের প্রথমদিকের কলাকুশলী। ঢাকায় এসে প্রথম কাজ করেন মাসিক নতুন ঢাকা ডাইজেস্টে। কাজ করেছেন পালাবদল পত্রিকায় সহকারী সম্পাদক হিসেবে। কবি ফজল শাহাবুদ্দীন সম্পাদিত নান্দনিক পত্রিকায় যোগ দেন সহকারী সম্পাদক হিসেবে। তাঁরই সম্পাদিত সাহিত্য পত্রিকা “কবিকণ্ঠ”তে কাজ করেছেন সহযোগী সম্পাদক হিসেবে। যৌথভাবে সম্পাদনা করেছেন লিটলম্যাখ “চোখ” ও “শিরোনাম”। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠরত অবস্হাতেই মূলধারার সাংবাদিকতার সঙ্গে জড়িত। দৈনিক জনকণ্ঠের প্রতিষ্ঠালগ্নের অন্যতম কুশলী। কাজ করেছেন ফিচার ও সম্পাদকীয় বিভাগে বিভাগীয় সম্পাদক হিসেবে। বাংলাদেশ টেলিভিশনে কাজ করেছেন গবেষক ও উপস্হাপক হিসেবে। সংযুক্ত ছিলেন বাংলাদেশ বেতারের সঙ্গেও। নব্বইয়ের গণ আন্দোলনে জড়িয়ে কারাভোগ করেন নব্বই দশকের এই কবি। ২০০৩ সাল থেকে স্ত্রী ও দুই সন্তানসহ বসবাস করছেন সুইডেনে ।
শকিল রিয়াজের প্রকাশিত গ্রন্থ ছয়টি। এর মধ্যে কাব্যগ্রন্থ চারটি। একাকি পুরুষ একাকি রমণী (১৯৯৫); পোড়ে প্রেম পুরোটাই (১৯৯৭); মকর রাশির মেয়ে (২০০০); নিজের ছায়াকে বৃষ্টিতে ভিজিয়ে মজা লুটি (২০০৪)। প্রবন্ধগ্রন্থ: অন্যান্য এবং আত্মহত্যার স্বপক্ষে (২০০৩)। কিশোর উপন্যাস: দ্বীপ বিভীষিকা (১৯৮৭)। কবি পৃথিবীতে যে সব দেশ ভ্রমণ করেছেন, সেগুলো হলো, ভারত, নেপাল, ভুটান, থাইল্যান্ড, ইংল্যান্ড, জার্মানি, ফ্রান্স, সুইডেন, ফিনল্যান্ড, নরওয়ে, ডেনমার্ক, গ্রিস, তুরস্ক, স্পেন, মাল্টা, রাশিয়া, ইউক্রেন, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া, হাঙ্গেরি, এস্তোনিয়া, মিশর, ইতালী, পোল্যান্ড।
শাকিল রিয়াজের কবিতার আকাশঃ একটি ভাবনা
কবি মাত্রেই স্বতন্ত্র কাব্যভঙ্গি থাকতে হয়। যাঁর থাকেনা, তিনি কবি নন, অনুকারক বলতে পারি আমরা। একটি কথা বলতে চাই, রবীন্দ্রনাথের আগে যেমন আর কোনো রবীন্দ্রনাথ ছিলেননা,তেমনি জীবনানন্দের আগেও আর কোনো জীবনানন্দ ছিলেননা। প্রত্যেকেই স্বতন্ত্র প্রতিভার অধিকারী। রবীন্দ্রনাথের কাব্যভঙ্গি বাংলা ভাষাকে যতোটা প্রকাশ ক্ষমতা দিয়েছিল, জীবনানন্দের কাব্যভঙ্গিও বেশ দিয়েছে। যুগ এগিয়ে যায়। যুগের মানসিকতা ক্রমেই জটিল হয়,প্রসারিত হয়। সেই মানসিকতাকে ব্যক্ত করবার জন্য দশকে দশকে যে সব কবিরা যুগকে সার্থক করেছেন, তাঁরা কবিতায় একটা পথ নির্মাণ করেছেন। শব্দ ব্যবহারের ক্ষমতার উপরই ভাষা তৈরির কাজ নির্ভর করে। শব্দ নিয়ে যারা বিব্রত, বিপন্ন, কবিকর্ম তাঁদের কাজ নয়। যে সময়ে শাকিল রিয়াজ এর উত্থান অর্থাৎ নব্বই দশক নিয়ে কথা বলা দরকার। নব্বই দশকে ভাষা নির্মাণে, এ দশকের কবিরা শব্দ নিয়ে নিরীক্ষা চালিয়েছেন। শুরু থেকেই শাকিল রিয়াজ এ বিষয়ে সচেতন। নব্বই দশকের কবিদের কেউ কেউ মহৎ কবিতা লেখার জন্যই যেন এ দশকে এসেছেন। জৈব শরীরের অবয়বগুলো যেমন একে অন্যের সঙ্গে অত্যন্ত জটিলভাবে সম্পর্কিত, মহৎ কবিতাও তেমনি। এ ধরনের কবিতার মোট অর্থ এতো সমৃদ্ধ হয় যে তা বিভিন্ন স্তরে সক্রিয় থাকে। অর্থসমৃদ্ধির দরুণই মহৎ কবিতা লেখা হয়ে যাবার পর যুগে যুগে পাঠকের মন আকৃষ্ট করে। আজ যেহেতু আমরা শাকিল রিয়াজের কবিতা নিয়ে কথা বলছি, তাই আমরা শাকিল রিয়াজ এর দুটি কবিতা লক্ষ্য করিঃ
১. সুউচ্চ পাহাড়ের ওপাশ থেকে
নক্ষত্রের পেছন থেকে
যাবতীয় ফুল ও গানের আড়াল থেকে
আলো ও অন্ধকারের কিনার থেকে
নিসর্গের খা খা শূন্যতা থেকে
মিছিল ও কোলাহলের প্রতিধ্বনি ছোঁয়া প্রাচীর থেকে
বুনোগ্রাম, উচ্ছলনদী ও হারিয়ে যাওয়া নোলক ফিরে পাবার আকুলতা থেকে
ব্যথা ও রুগ্নতার শিয়রে দাঁড়িয়ে থাকা
ভারাক্রান্ত শাদা বাতাস থেকে
ফিসফিস করে কেউ আপনার কানে কানে বলেছিল,
এসো কবি, এসো আমাদের কাছে
পৃথিবীর আয়তনে খুব ঠাসাঠাসি হয়ে আছো আহা
আমাদের কবি অবশেষে চলে গেলেন
মখমলের মতো তার পেলব ডানহাত নেড়ে।
( কবি আল মাহমুদের মৃত্যুতে)
২.
বেলুনে বেলেছো মন,অনিশ্চিত রুটি হই প্রতিদিন
আয়ু বাড়ে গোল হয়ে, শীর্ণকায় হতে থাকে অভিলাষ।
দক্ষ সদালাপী হাতে গুণগুণ করে রুটি নয়,
বেলেছো আমাকে হায় অবিরাম, মথেছো আমাকে।
এ এক অদ্ভুত বৃত্ত হয়ে বাড়ে আমার জীবন।
এমন উন্মুক্ত রান্নাঘরে
এই ধোঁয়াময় সেঁতসেঁতে স্বাদে
আমাকে যে সেঁকা হয় অবশেষে গরম তাওয়ায়।
একবার খুব বৃষ্টি হলো এই রান্নাঘরে
ফোটানো ছাতার মতো টানটান হয়ে খুলে গেল তোমার শরীর।ফুলে গেল শেমিজের নকশাকাটা নজর।
(বৃত্ত)
কবিতা দুটি আমরা লক্ষ্য করি। উপলব্ধিকে খাঁটি হতে হলে মনের সমগ্র সম্পদ নিয়ে উপলব্ধি করতে হয়। তাহলে কবিতার রস আস্বাদনে প্রকৃত টেস্ট বোঝা যায়। পাঠকচিত্তে প্রগাঢ় সাড়া আনাই মহৎ কবিতার লক্ষণ। " মখমলের মতো তাঁর পেলব ডানহাত নেড়ে "- এই লাইনটিতে একজন মৃত্যু পথযাত্রী কবির শেষ চিত্র আঁকা হয়েছে। ডানহাত নেড়ে আমরা মানুষকে বিদায় জানাই। ইংরেজ সাহেবরা ডান হাত নেড়ে বাই বাই বলেন। দুটি হাতই মানুষের গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ডানহাত ভব্যতা, ভদ্রতা, রুচির একটি বিশেষ দিক নির্দেশ করে। ডানহাত নেড়ে চলে যাওয়া মানে মানুষের হৃদয়ে সাড়া ফেলে তিনি চলে গেলেন। এখানে কবির চিত্রকল্পের অসাধারণত্বের শব্দ হলো মখমল। মখমলি পোশাক রাজা-বাদশারা পড়তেন। মখমলি পোশাক অত্যন্ত নরম তুলতুলে হয়। কবির হাত নরোম তুলতুলে বোঝাতে মখমল শব্দ টা যথাযথ মর্যাদায় ফুটে উঠেছে এখানে। শাকিল রিয়াজ তাঁর কাব্যকৃতি প্রতিষ্ঠিত করতে প্রয়াসী হয়েছেন, এ কবিতায়। " বেলুনে বেলেছো মন,অনিশ্চিত রুটি হই প্রতিদিন "- এই চিত্রকল্প দেখে কিছুটা সময় আমরা চুপ থাকি। যাপিত জীবনের গেরস্থালী চিত্র। এই বিষয়ে অনেক কবিই কবিতা লিখেছেন। কিন্তু দৃষ্টিভঙি ব্যতিরেকী গতির জন্য আধুনিক বাংলা কবিতায় যুতসই একটা উপমা যখন বুনন হয় তখন তা চোখে ঘোর লাগায়। আবেগ সংযত করে যখন কবি কবিতার পংক্তি পৃথিবীতে ছড়িয়ে দেন, তখন বলতেই পারি, কবিতার ভাষা নির্মাণে যে সব শব্দের প্রবেশাধিকার আছে, শাকিল রিয়াজ সেই শব্দগুলো দারুণভাবে ধ্বনিময় করে তুলতে সক্ষম। পোশাকি শব্দগুলো, যেগুলো দিয়ে আমরা দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োগ করি, শাকিল রিয়াজ সেই শব্দগুলো দারুণ মুন্সিয়ানায় তাঁর কবিতায় স্থান দিয়েছেন। চিরায়ত বাঙালি ঐতিহ্য কে হৃদয় সাহচর্যে নিয়ে এসেছেন তিনি। মহৎকবিতার কথা বলছিলাম আমরা। যে কবিতাগুলো আপন ঐতিহ্যে স্থিত হয়ে আমাদের হৃদয়ে সাড়া ফেলে, আমরা উপলব্ধি করতে পারি শব্দের আদর, তেমন কবিতা আমাদের শুধুই টানে চুম্বকের মতো।
নব্বই দশকের কবিদের বৈশিষ্ট্য হলো কবিতা নিয়ে নানামুখী পদচারণা। বিবর্তনের পথে যতটুকু পরিবর্তন ঘটা সম্ভব, তা এ দশকের কবিদের কবিতার মধ্যে নিরীক্ষায় দেখা গেছে। পূর্ববর্তী দশকগুলো সামনে ছিলো বিজলি বাতির মতো, তাই মনোভঙ্গির পরিবর্তন ঘটতে সহজ হয়েছে। অগ্রজ অনেক কবির বিশেষ করে ত্রিশ আর পঞ্চাশ দশকের কবিতার প্রভাব শুরুর দিকে থাকলেও খুব জলদি তাঁরা এই প্রভাব থেকে বেরিয়ে নিজের পথে চলে গেছেন। কে কতো বড়ো পথ নির্মাণ করেছেন সেটা মহাকাল বিচার করবে, কিন্তু সংকীর্ণতা পরিহার করে মুক্তমনে প্রগতির ধারক বাহক হয়ে এ দশকের কবিরা কবিতার বৈতরণি পাড়ি দিতে চেষ্টা করেছেন। এটি আশার কথা। ইন্দ্রিয়ঘন পরিবেশ রচনায় বেহতর মেহনত করেছেন নব্বই দশকের কবি সমাজ। যুগের দুঃখ বেদনা সম্বন্ধে গভীরভাবে সচেতন এ দশকের কবিরা। ভিন্ন ঐতিহ্যে মানুষ, সমসাময়িক হতাশাকে বুদ্ধি দিয়ে বুঝতে পারলেও এবং কখনো কখনো কবিদের অন্তঃস্থল যুগের বেদনা স্পর্শ করলেও কবিরা এগিয়ে গেছেন শুভবুদ্ধির চেতনাকে ধারণ করেই। শাকিল রিয়াজ এ ঘরানারই কবি। শাকিল রিয়াজের কবিতাকে কখনো নির্জন নক্ষত্রের আলো বলে মনে হয়না। মনে হয় থালার মতো বিশাল পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে শাকিলের কাব্য আকাশে। সে কারণে, শাকিল রিয়াজ পাঠ করে আনন্দ পাওয়া যায়। সৃষ্টির যেখানে আনন্দ উপলব্ধি হয় সেটাই মহৎ সৃষ্টি। শাকিল রিয়াজ এর একটি কবিতা লক্ষ্য করিঃ
এই গলিতে কোনো কবির বসবাস নেই
এই মহল্লায় কোনোদিন কেউ এক পংক্তি স্বপ্ন লেখেনি
কিছু মানুষ অযথাই বসে থাকে নিঃসাড় বারান্দায়
কিছু মানুষ কখনো তাকায়না গৃহে,ভালোবাসায়
কিংবা সামনের জানালায়
যেখানে কার্নিশে ঝুলে আছে এখনো কিছু বরফ
পাখির তায়ের মতো ঝিরিঝিরে রেশমী রোদ এসে বরফ গলালে
চুয়ে পড়া পানির ফোঁটায় যে বসন্ত উঁকি দেয়
কেউ খেয়াল করেনা এ মহল্লায়।
( লুমিনিতা)
চারপাশের প্রচলিত ভালোবাসা কবিকে আকৃষ্ট করে। পৃথিবী কে জানার জন্য কবির আকুতি বারবার তীক্ষ্ণ হয়।জড়তা ও অভ্যাসের দাসত্ব করা কবির কাজ নয়,কবির ধর্ম চৈতন্যের প্রহারে জড়তাকে বিধ্বস্ত করা। জ্ঞান বৃক্ষের ফল আস্বাদনের ফলে পৃথিবীতে নতুন ফুলের স্বর্গ নির্মাণে কবি এগিয়ে যান। সুররিয়ালিজম, ম্যাজিক রিয়েলিজম ঝলসে ওঠে তাঁর কবিতায়। নতুন সৃষ্টির ব্রতে ব্রতী কবি। একটা ধারণা, একটা কল্পনা, একটা স্বপ্নের মধ্যে দিয়ে কবি তাঁর কবিতার সাম্রাজ্যের রহস্যময় আলো ছায়ার জগতে বসবাস করেন। আবেগ আলোড়িত হৃদয়ে কবি যে চিত্রকল্প কবিতায় আঁকেন তা পাঠ করে আমরা কিছুটা সময় চুপ করে থাকি। আমরা তাঁর "অর্ধেক মাছ " কবিতায় কবিকল্পনা, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ও ম্যাজিক রিয়েলিজম এর ক্ষমতা খুঁজে পাই। কবিতাটি লক্ষ্য করিঃ
"গতকালের অর্ধেক খাওয়া মাছ সাঁতরে চলে গেল।
মাছের কোন ভাগ খেয়েছিলাম মনে নেই।
মাথা নাকি লেজের ভাগ?নাকি পুরো একপাশ?
এটা খুব বিবেচ্য বিষয় নয়।
খাবার টেবিলে অন্ধকার ছিলো খুব
বাইরে হেমন্তের ডাকে সূর্য নিভেছিল আগেভাগে।
শুধু এইবুকে আলো ছিল
এই বুক জ্বলেছিল ব্যথার ঘর্ষণে।
গতকালের অর্ধেক খাওয়া মাছ
একটা কাটা রেখে গেছে আলজিভে।
এটাই বিবেচ্য।
এই আধ খাওয়া মাছ সাঁতরে গেল আহা
সাঁতরে গেল সে গলায় বিঁধে রেখে মনে পড়ার ছুরি।
এই অর্ধেক মাছই পাতে চাই আজ।
বাইরে অন্ধকার থাকবে যথারীতি
ভেতরে অন্ধ টেবিলে জ্বালিয়ে রাখবো গলাব্যথা।
আমার ব্যথাতুর মুখে একটি কাতর লোকমা হয়ে নিজেকে পূর্ণ করো মাছ।
আমি এখন অর্ধেক মাছের তালাশে
নেমে যাবো অনিশ্চিত নদীগুলোতে।
একটি মাছ পূর্ণতা পাবে আমার পাতে, এই ভরসায়।
(অর্ধেক মাছ)
চেতন ও মননের দিক থেকে শাকিল রিয়াজের সৃষ্টি ক্ষমতার প্রকাশ ও প্রমাণ আমরা পাই। কবিতা যেহেতু শুধু আবেগ নয়, বাস্তবতারও মিশেল স্রোত তাই তাঁর কবিতা প্রণয়ের কথা স্মরণ করিয়ে দেয় শিল্প সৃষ্টির মধ্যদিয়ে। শাকিল রিয়াজের কবিতা আমাদের অজ্ঞাতেই প্রতিদিন জাগ্রত জীবনের অকল্পনীয় অচিন্তনীয় অবকাঠামোর দুয়ার খুলে দেয়। নতুন নতুন অভিজ্ঞতা সংগ্রহ করে নিজেকে ও কবিতার জীবনকে জীবন্ত ও সমৃদ্ধ করে তোলে। এজন্যই তাঁর কবিতা আমাদের পড়তে হয়। কবিদের কাছ থেকে আমরা মতবাদ চাইনা, কবিতা চাই। কবিতার প্রতি তাঁর দুর্মর আসক্তি আমাদের আশ্চর্য মোহিত করে। শাকিল রিয়াজ নব্বই দশকের উজ্জ্বল কবি।