উজ্জ্বল রায়, জেলা প্রতিনিধি নড়াইল থেকে:
নড়াইলের একমাত্র মৎস্য প্রজনন কেন্দ্রটির বেহাল দশা। আশির দশকে নড়াইল-যশোর সড়কের পাশে ৯ একর ৭৫ শতক জায়গার ওপর নির্মিত হয় নড়াইল মৎস্য প্রজনন কেন্দ্র। যা স্থানীয়ভাবে ‘ফিসারি’ নামে পরিচিত। শুরুতে বেশ ভালোভাবেই চলছিল জেলার একমাত্র মৎস্য প্রজনন কেন্দ্রটি । কিন্তু দীর্ঘ ২০ বছর ধরে প্রায় অকেজো হয়ে আছে কেন্দ্রটি। আর বিশাল এ স্থানটি ব্যবহৃত হচ্ছে গো-চারণভূমি ও মাদকসেবীদের নিরাপদ আখড়া হিসাবে। বছরের পর বছর জনবল সংকট, পুকুরগুলোর পানি শুকিয়ে যাওয়া, চারপাশের প্রাচীর ভেঙে পর্যাপ্ত নিরাপত্তার অভাবসহ বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার কারণে জেলার একমাত্র মৎস্য প্রজনন কেন্দ্রটির এ বেহাল দশা বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
জেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা গেছে, ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত প্রজনন কেন্দ্রটি চালু ছিল। তখন ২টি হ্যাচারিতে সাদা মাছের রেনু উৎপাদন হত তা এখানকার ৮টি পুকুরে একটু বড় করে স্থানীয় মৎস্যচাষীদের মাঝে সরবরাহ করা হত। এই মৎস্য প্রজনন কেন্দ্রকে উপলক্ষ্য করে নড়াইলের বিভিন্ন এলাকায় মাছের খামার আর ঘের গড়ে ওঠে । ৩ দশকে ঘের আর পুকুরের সংখ্যা বেড়ে এখন প্রায় ১৩ হাজারে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে চিংড়ি মাছের ঘের প্রায় ৩ হাজার। আর এই মৎস্য চাষের ওপর জীবীকা নির্ভর করছে জেলার অন্তত ৮০ হাজার মানুষের।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, দ্বিতল অফিস ভবনসহ প্রজনন কেন্দ্রটির সব ভবনই তালাবদ্ধ। কয়েকটি পুকুরে সামান্য পানি থাকলেও অকেজো আর অব্যবস্থাপনায় বাকি পুকুরগুলো শুকিয়ে ঘাস-লতাপাতায় ভরে গেছে। যা এখন কেবলই গো-চারণভূমি। প্রজনন কেন্দ্রের ৮টি পুকুরের ৩টি পুকুরে পানি থাকলেও সেগুলো আশপাশের বসতিদের কাপড়-কাঁচা আর গোসল ছাড়া কোনো কাজে আসছে না। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পুরো এলাকাজুড়ে কেবল মাদকসেবীদের আড্ডা চলে।
অফিস সূত্রে জানা গেছে, এখানে ৫টি পদ থাকলেও দীর্ঘদিন যাবৎ এখানে কোনো লোক নিয়োগ দেয়া হয় না। ৫টি শুন্য পদের বিপরীতে আছে মাত্র একজন এলএমএসএস। ১০ একরের বিশাল এই এলাকায় থাকেন ওই কর্মচারী। শাহজাহান নামের ওই অফিস সহায়কও দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ।
উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা মো. ইনামুল হক বর্তমানে এই খামারের অতিরিক্ত দ্বায়িত্বে আছেন। তিনি জানান, খামারের পুকুরগুলোতে পানি ধরে রাখা যায় না। তাই উৎপাদন এক পর্যায়ে বন্ধ হয়ে গেছে। এছাড়া এখানে জনবলের অনেক ঘাটতি রয়েছে। জনবল চেয়ে বারবার উপরে জানানো হলেও এখনও কোন সুরাহা হয়নি। এছাড়া ভবিষ্যতে টাকা পাওয়া গেলে পুকুরগুলো সংস্কারের উদ্যোগের কথা বলেন এই কর্মকর্তা ।
জানা গেছে, ৯৯০.২৩ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের ছোট্ট জেলা নড়ালের জনসংখ্য ৭ লাখ ২৭ হাজার ১৫৬ জন। আর এই জনসংখ্যার বাৎসরিক মাছের চাহিদা রয়েছে ১৬ হাজার মেট্রিক টন। জেলায় মাছের উৎপাদন হয় ২৩ হাজার ২৬১ মেট্রিক টন। জেলার চাহিদা মিটিয়ে বাকি ৭ হাজার ২৬১ মেট্রিক টন মাছ অন্য জেলা ও ঢাকায় পাঠানো হয়। জেলার মৎস্য অফিসের হিসেব অনুযায়ী এখানে বাৎসরিক চিংড়ি উৎপাদন হয় ২ হাজার ৬৯০ মেট্রিক টন।
মৎস্য চাষিরা জানান, এই খামার স্থানীয় মৎসজীবীদের কোনো কাজে লাগছে না । তারা যশোর, খুলনা, সাতক্ষীরাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে মাছের রেনুপোনা সংগ্রহ করেন। তা সবসময় ভালো হয় না এবং আনতে প্রচুর ব্যয় হয়। সরকারি হ্যাচারি থেকে পোনা পাওয়া গেলে তা নির্ভেজাল হত এবং দামেও কম হত।
মৎস্যচাষি জিরু শেখ জানান, তিনি দীর্ঘদিন যাবৎ মাছের চাষ করেন। জেলাতে নির্ভরযোগ্য কোনো হ্যাচারি না থাকায় সাতক্ষীরা বাগেরহাটসহ বিভিন্ন জেলা থেকে পোনা সংগ্রহ করেন। কয়েকবার পোনা কিনে প্রতারিতও হয়েছেন তিনি।
আরেক মৎস্যচাষি রবিউল জানান, নড়াইল জেলা মৎস্য চাষের জন্য একটি সম্ভাবনাময় জেলা। প্রতি বছরই মৎস্য চাষে আগ্রহী হয়ে অনেকে এই পেশায় আসছে। স্থানীয় ভালো কোনো হ্যাচারি না থাকায় তার মতো অসংখ্য চাষিকে বাইরের জেলা থেকে পোনা আমদানি করতে হয়। এতে তাদের অনেক ঝুঁকি থাকে। বাইরের থেকে পোনা এনে অনেক চাষি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বলে জানান তিনি।
সরকারি কোটি টাকার এই সম্পত্তি এলাকার মানুষের কাজে লাগানোর উদ্যোগ গ্রহণ করা হোক, এটাই বিল এলাকা নড়াইলের লক্ষ মৎস্যজীবী মানুষের দাবি।