উপমহাদেশের খ্যাতিমান আধ্যাত্মিক ছুফী সাধক, অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইসলামী চিন্তাবিদ, সমাজ সংস্কারক, শিক্ষাবিদ ও শিক্ষা সংস্কারক হজরত খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (রঃ)’র জন্ম ১৮৭৩ সালে সাতক্ষীরা জেলার নলতা গ্রামে।
খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (রঃ) এর বয়স পাঁচ বছর পূর্ণ হওয়ার পূর্বেই তাঁর পড়াশুনা শুরু হয়। পাঠশালার শিক্ষা শেষ করে তিনি নলতা মধ্য ইংরেজি বিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং পরে তিনি টাকী গভর্ণমেন্ট হাই স্কুলে ভর্তি হন। তিনি সর্বশেষ ১৮৯৫ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃতিত্বের সাথে দর্শণ শাস্ত্রে এম. এ. পাশ করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনিই প্রথম মুসলিম সিনেট সদস্য ছিলেন। তাছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় একমাত্র বাঙালী মুসলমান প্রতিনিধি হিসেবে তাঁর ভূমিকা বিশেষভাবে স্মরণ করতে হবে। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকাল থেকে এক দশকেরও বেশি কাল তিনি এর সিনেট সদস্য ছিলেন।
তাঁর সারাটি কর্মজীবন শিক্ষা বিভাগের চাকরিতে কাটে। সর্বশেষ ১৯২৪ সালে চাকরিতে পদোন্নতি পেয়ে অবিভক্ত বাংলা ও আসামের শিক্ষা বিভাগের সর্বোচ্চ স্তরে সহকারী পরিচালকের পদ লাভ করেন, যে পদে বৃটিশ শাসনামলে তিনিই সর্বপ্রথম বাঙালি। উক্ত পদে অধিষ্ঠিতকালে তিনি এদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় আমূল ও যুগান্তকরী পরিবর্তন ও সংস্কার সাধন করেন। যারমধ্যে অন্যতম, পরীক্ষার খাতায় পরীক্ষার্থীর নাম লেখার পরিবর্তে রোল নম্বর লেখার রীতি প্রবর্তন, কলকাতায় ইসলামিয়া কলেজ, বেকার হোস্টেল, টেলর হোস্টেল, কারমাইকেল হোস্টেল, রাজশাহীর ফুলার হোস্টেল নির্মাণসহ সারা দেশে অসংখ্য স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা, স্কুল-কলেজে মৌলভীর পদ সৃষ্টি ইত্যাদি।
১৯১১ সালে তিনি বৃটিশ ভারতের ‘রয়েল সোসাইটি ফর এনকারেজমেন্ট অব্ আর্টস ম্যানুফাকচারার্স এন্ড কমার্স’- এর সদস্যপদ লাভ করেন। শিক্ষা ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ বৃটিশ সরকার কর্তৃক তিনি ‘খানবাহাদুর’ উপাধিতে ভূষিত হন।
চাকরি জীবনে এবং অবসর জীবনে খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (রঃ) নিরলসভাবে সাহিত্য চর্চা করেন। সমাজ ও দেশ, বাংলা ভাষা, সাহিত্য-সংস্কৃতি, ইতিহাস, শিক্ষা, ধর্ম, জীবন-কথা প্রভৃতি নানা বিষয় নিয়ে তিনি সাহিত্য রচনা করেন। তাঁর রচিত গ্রন্থাবলীর মধ্যে বঙ্গভাষা ও মুসলমান সাহিত্য (১৯১৮), হিস্ট্রি অফ দি মুসলিম ওয়ার্ল্ড (১৯৩১), ইসলাম ও আদর্শ মহাপুরুষ (১৯২৬), তরিকত শিক্ষা (১৯৪০), শিক্ষাক্ষেত্রে বঙ্গীয় মোছলমান (১৯৩১), কোরআন ও হাদিছের আদেশাবলী (১৯৩১), ছুফী (১৯৪৭), সৃষ্টিতত্ত্ব (১৯৪৯), ইছলামের মহতী শিক্ষা (১৯৪৯), মহাপুরুষদের অমিয়বাণী (১৯৫০), ইসলামের বাণী ও পরমহংসের উক্তি (১৯৫৬), টিচার্স ম্যানুয়েল (১৯৫২) প্রভৃতি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (রঃ) সাহিত্য ভাবনার প্রায় পুরোটা দখল করে আছে স্বদেশ ও স্বজাতি, বাংলা ভাষা ও সাহিত্য এবং মানুষের সর্বাঙ্গীন মঙ্গল কামনা। তিনি তাঁর গ্রন্থে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেনঃ ‘সমাজ-সেবাই সাহিত্যের মূল উদ্দেশ্য হওয়া বাঞ্ছনীয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘যে জাতির সাহিত্য নাই সে জাতির আত্মসম্মান নাই, সে জাতির উন্নতি সুদূরপরাহত।’ জাতীয় অস্তিত্ব রক্ষা করিতে হইলে বাঙলা ভাষার উন্নতি একান্ত আবশ্যক।
শৈশব থেকে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি আধ্যাত্ম চিন্তা ও সাধনায় জীবন অতিবাহিত করেছেন। শুধু আল্লাহর সাধনাই নয়, তাঁর সৃষ্টজীবকে ভালবাসা, তাদের কল্যাণে আত্মনিবেদিত হওয়াতে মানব জীবনের পূর্ণত্ব- এই ছিল তাঁর জীবন-সাধনা। এ আদর্শে তিনি রচনা করেছেন ৮১টি উপদেশ ও শিক্ষামূলক গ্রন্থ। উক্ত ভাবাদর্শের ভিত্তিতে ‘স্রষ্টার এবাদত, সৃষ্টের সেবা’- এই মূলমন্ত্র নিয়ে ১৯৩৫ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ‘নলতা কেন্দ্রীয় আহ্ছানিয়া মিশন’।
খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (রঃ) বাঙালি মুসলমানের অহঙ্কার এবং তাঁর কালের আলোকিত মানুষ। তিনি দীর্ঘ পরমায়ু পেয়েছিলেন এবং জীবনের প্রায় পুরোটা সময় তিনি অনগ্রসর মুসলমান জাতির উন্নতির জন্য ব্যয় করেছেন। ইংরেজ শাসনাধীন ভারতে মুসলমানের যে ক্ষয়িষ্ণু অবস্থান, দৃষ্টিভঙ্গির পশ্চাদপদতা, সাংস্কৃতিক অবক্ষয় তাকে নতুন জীবনদৃষ্টি ও বিশ্ববীক্ষা নির্মাণে তিনি পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেন। তিনি তাঁর উদ্যোগ ও কর্ম-প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে মুসলমান জীবন ও মানসে যে শ্রেয়-চেতনা নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন তাতে তিনি পরিপূর্ণ সাফল্য অর্জন করেন। খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (রঃ) এভাবে একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছেন। এই বিরাট, বিপুল এবং প্রায় পুরো একটি শতাব্দীকালের মহাপুরুষ প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বার বার তাঁর নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরিত ও উচ্চারিত হবে। এই দেশ এবং জাতি খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লার (রঃ) কাছে নানাভাবে ঋণী থাকবে চিরটাকাল।
হাসানূর রহমান সুমন
সিনিয়র সহকারী সম্পাদক
সাপ্তাহিক হিতবানী
sumon.parves09@gmail.com
সম্পাদক : মোঃ কবির নেওয়াজ রাজ, E-mail: mkprotidin@gmail.com, Contact: (+88) 01643-565087, 01922-619387; Mailing Address: House# 4/A, Main Road, Ati Model Town, Ati, Keraniganj, Dhaka-1312
© All rights reserved © MKProtidin.Com