দু’দিন হলো জব্বলপুর শহরের উপকন্ঠে তাবু গাড়া হয়েছে। সোঁথারা নগরে ছড়িয়ে গেছে, কেউ এখনো কোন খবর আনতে পারেনি। তাঁবুতে অলস সময় পার করছিলো সৈয়দ আমির আলী। দুপুরের দিকে হঠাৎ হন্তদন্ত হয়ে পুরান সোঁথা জুম্মন খাঁ হাজির, “নদীর ধারে ব্রাহ্মণের দোকানের সামনে একটি পালকী দাঁড়ানো, মনেহয় মালদার বুনিজ হবে”। শুনে আমির আলী নিজেই ছুঁটে বের হলো। দ্রুত পৌছে ব্রাহ্মণের দোকানের সামনের মাঁচায় বসে এক ছিলিম হুকায় দম দিয়ে আশেপাশে শকুনি নজর ফেললো। দোকানের প্রায় হাত কুড়ি পঁচিশ দুরে দাঁড়ানো একটা নকশা করা অভিজাত পালকী, সাথে আটজন বেহারা, ছ'জন রক্ষী, মাঝ বয়সি একজন দাসী। পালকির ভেতরে কে ঠাহর করা যাচ্ছে না। তবে বড় ঘরের কেউ তাতে কোন সন্দেহ নেই, নিশ্চয়ই মালদার বুনিজ। এলোমেলো অনেক ভাবনার মাঝে হঠাৎ পালকির পর্দার আড়ালে একজোড়া চোখের দেখা মিললো, অপরুপ দৃষ্টি। নিচুস্বরে দাসীকে কিছু বলে আবার পর্দার আড়াল হলো। তবে এর মাঝে কয়েক মুহুর্ত দোকান পানে চেয়ে দৃষ্টি থেমে রইলো, কিন্তু কেন তা বোঝা গেলো না। রাজ বংশের কেউ তো হবেই, সাথে অনেক জেবরপাতি আছে নিশ্চয়ই । কিন্তু নারী হত্যা এ পেশায় নিষিদ্ধ। ধনরত্নের লোভে এমন অপরুপার গলায় ফাঁস পরানো তার কম্মো নয়, ভাবতে ভাবতে তাঁবুতে ফিরে এলো সে। পরদিন ভোরে আবার নতুন পথে নামতে হবে।
সন্ধ্যা নামার আগে অবাক হলো সৈয়দ আমির আলী, দুপুরে দোকানের সামনে দেখা সেই দাসী বেগম সাহেবার সালাম নিয়ে এসেছে। সে ডাক ফেরানো মুসকিল, নিঃশব্দে সেদিকে পা বাড়ালো সে। ঘোমটার আড়াল থেকে জেনানা বললেন, তিনি আগ্রার রাজ দুহিতা, আবার নাগপুরের রাজ পরিবারের বধু। বছর দু'য়েক হলো স্বামী গত হয়েছেন, এখন বিধবা, নাগপুর যেতে চান। নির্জন পথে তার মতো অভাগীকে কি সাথে নিবেন? নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছে দেবেন? মহিলার কথা গুলো কেমন যেন মায়াভরা। এমন মায়া ভরা মুখ আগে কখনো দেখেনি, তার বুলিও যেন কেমন যেন মায়া জাগায়, এমন মিষ্টি বুলি সে আগে শোনেনি, বার বার শুনতে ইচ্ছে করে। কোন কথা বলতে পারলো না আমির, শুধু মাথা নেড়ে হ্যাঁ জানিয়ে মোগলানীর সামনে থেকে তাঁবুতে ফিরে এলো।
পরদিন ভোরে ওরা জব্বলপুর থেকে নাগপুরের পথে পা বাড়ালো। দলের সবাই নব আগুন্তকের পরিচয় না জানলেও একটা বিষয় কারো দৃষ্টি এড়ালো না। পালকির যাত্রী মোগলানীর ঘন ঘন তেষ্টা পাচ্ছে, আর ছায়া বৃক্ষের দেখা পেলেই যাত্রা বিরতি। কোথাও থামলেই মোগলানী আমিরকে পালকির কাছে ডাকছেন, তার কাছে এখন অনেক খাতির। খাবার ভাগাভাগি করে খাওয়া, হেঁসে হেঁসে গল্প করা সবই বাড়তে লাগলো। সাথের বুড়ি আপত্তি করে বললো হাজার হোক পথের লোক, এত মাখামাখি ভালো নয়। ততক্ষনে অনেক জল গড়িয়েছে। মোগলানীর সাফ জবাব, সারা দুনিয়াটাই তো পথ, কে এখানে চিরকাল থাকতে এসেছে? বুড়ি যা বলতো আর সে কি জবাব দিয়েছে পরে তার সবটাই তাকে বলতো আর খিল খিল করে হাসতো মোগলানী। খুব নিষ্পাপ সে হাঁসি।
এভাবে পথ চলতে পুরো ছ'দিন ছ'রাত পায় হয়ে গেছে। কোন দিকেই খেয়াল নেই আমিরের। শেষে মুখ খুললেন দলের পুরানো আর সকলের গুরু দূর্গা, কি ব্যাপার? দেরী কেন?
সাচ বলবো? এই জেনানা আমার দিল লুটেছে।
আরে দিল তো ঘর মে, এ পথে ওসব চলে না, দেখেছ না, গায়ে লাখ টাকার জেবরপাতি, আর সাথে যা আছে সব মিলে তো লাখ দেড়েক ছেড়ে যাবে!
সে রাতে মোগলানী হাত ধরে বললো, সঙ্গী সাথি বিদায় দাও, আমার সাথে চলো। যা আছে তাতে জিন্দেগিভর অভাব হবে না, অনেক সুখে থাকবো। তা হয় না বেগম সাহেবা। যদি না যাও সব ফাঁস করে দিবো, বদ লোকের সাথে তোমার চলাফেরা, হ্যাঁ, আমার সাথে আগ্রা অবধি যেতেই হবে নইলে…
মাথায় অনেক চিন্তা নিয়ে তাঁবুতে ফিরলো আমির। কি করে সব জানলো এই মোগলানী। পরের সকালেই জানা গেল, দলের নতুন লুগারী বাব্বন খাঁ, তার সাথে নাকি মোগলানীর দাসীর খুব ভাব। সেইই কথায় কথায় সব জেনে নিয়েছে, আর সেখান থেকে মোগলানীর কানে।
দিনটা নতুন কোন ঘটনা ছাড়াই পার হলো। নাগপুর এখনো দু'দিনের পথ। সন্ধ্যা নাগাদ তাঁবু গাড়া হলো এক ছোট একটা নদীর পাড়ে। কাছেই পুরাতন বড় দু'টা বট গাছ। সকলের রাতের খাওয়া শেষ, কেউ একজন বাঁশিতে মধুর সুর তুলেছে। বাম হাতে পর্দা সরিয়ে তাঁবুর ভেতরে পা রাখতেই মোগলানী বলে উঠলো, এতক্ষণে মনে পড়লো? আমি কি তোমার কেউ নই?
চুপচাপ পাশে বসলো আমির।
কি ভাবলে আমির? একটু ভালবাসাও কি জুটবে না এই অভাগীর কপালে? বলেই তার পায়ের কাছে বসে পড়লো মোগলানী, তোমার ঘরে যদি বিবি বাচ্চা থাকে তাতেই আপত্তি নেই, আর এমনিতেই তো চারটা বিবি রাখতে পারো। আমার কোন আপত্তি নেই।
তাকে দুহাতে টেনে তুললো আমির কিন্তু মুখে কথা ফুটলো না। পর্দার ফাঁক দিয়ে জোস্নার আলো পড়ছে বিছানায়, অনেক বেশীই মনে হলো সে আলো।
জোস্নায় তন্দ্রাচ্ছন্ন বেগম সাহেবাকে অপরুপ লাগছে, মুখে মায়াভরা মিষ্টি হাঁসি লেগে রয়েছে। নিঃশব্দে সেখান থেকে উঠে এলো আমির। কয়েক পা এগোতেই আবছা অন্ধকারে দাঁড়ানো মূর্তিকার তিনজনকে ঝিরনী সংকেত দিয়ে দ্রুত পা বাড়ালো। যার ছোঁয়া এখনো শরীরে তার গলায় রুমাল পরানো সে দেখতো পারবে না।
আগ থেকেই তৈয়ার ছিলো ৪০ জন লুগারী, তাদের সাথে যোগ দিলো সে। বাব্বান খাঁ'কে দিয়েই শুরু হলো ঝিরনী দেয়া, দলে এমন বেঈমান রাখা যায় না! আটজন বেহারা, ছ’জন রক্ষী আর সেই দাসী কেউই বাদ গেলো না।
তখনো আধো ঘুমে বেগম সাহেবা, স্বপ্ন না হাকিকত এমন ভাবনার মাঝে হঠাৎ গলায় তিব্রো জ্বালা অনুভব করলো সে, চোখ মেলে যা দেখলো, তা কল্পনায় ছিলো না, দুজন তাকে বিছানায় চেপে ধরেছে,আর একজন তার গলায় ফাঁস পরাচ্ছে, একজনকে খুব চেনা মনে হচ্ছে, কদিন আগে ব্রাহ্মণের দোকানের সামনে তাকে দেখেছিলো। সেইই তাকে মারতে চায় কেন? আমির জানলে তোকে আস্ত রাখবে না। চিৎকার করে আমির কে ডাকলো কিন্তু সে আওয়াজ তাবু পেরোলো না, একটু বাতাসের জন্য হাঁসফাঁস করতে করতে নিস্তেজ হয়ে গেলো মোগলানী।
পরদিন ভোরে চারপাশ ভালো করে দেখে নিলো সবাই। নাহ, কোথাও কোন চিহ্নই নেই, রাতভর নদীতে ভেসে ভেসে পালকির টুকরোগুলোও দৃষ্টির আড়াল হয়েছে। নাগপুর নয়, অমরাবতী হয়ে আওরঙ্গবাদের পথে পা ফেললো ওরা…
আচ্ছা, মেয়েটা তো তোমাকে অনেক ভালোবেসে ছিলো, রাজ পর্যাদা, সহায় সম্পদ সবই তোমার পায়ে সঁপেছিলো, তারপরও এমন টা না করলে হতো না? অবাক বিষ্ময়ে জিজ্ঞাসা করলেন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট টেইলর সাহেব..
সাহেব, ভালোবাসা সত্যি হলে পরের জন্মেও তো তা হয়।
আচমকা ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের চিৎকার শুনে আর্দালি আর সেপাইরা হন্তদন্ত কামরায় হাজির, “একে আমার সামনে থেকে সরাও”
অনেক ভেবেও যুতসই একটা ইংরেজি গালি মনে করতে পারলেন না। কেদারা ছেড়ে খাস কামরার জানালা দিয়ে বাইরে চেয়ে রইলেন ফিলিপ মিডোস টেইলর, এক সময় মনে হলো, কি সুন্দর এই দেশ!
লেখকঃ বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমির আইন প্রশিক্ষক হাসান হাফিজুর রহমান।
সম্পাদক : মোঃ কবির নেওয়াজ রাজ, E-mail: mkprotidin@gmail.com, Contact: (+88) 01643-565087, 01922-619387; Mailing Address: House# 4/A, Main Road, Ati Model Town, Ati, Keraniganj, Dhaka-1312
© All rights reserved © MKProtidin.Com