ছুটছে সবাই ছুটছে, একেবারে হণ্য হয়ে, পৌঁছাতে হবে যত দ্রুত সম্ভব, কার আগে কে পৌঁছতে পারে চলছে সেই টেক্কা। কেউ টাকা ধার করে, কেউ ঘরবাড়ি দালান কোটা বন্ধক রেখে না বিকোয়ে, কেউ বা সারা জীবনের সঞ্চয় সাথে নিয়ে, ঘর সংসার বাচ্চাকাচ্চার দায়িত্ব বউয়ের হাতে ছেড়ে,, আর তা না পারলে খুব দরকারী সাংসারিক মালামাল আর আন্ডাবাচ্চা ওয়াগনে চাপিয়ে ঘোড়া দাবিয়ে ছুটছে ক্যালিফোর্নিয়ার পথে…
কেন এই ছুটে চলা? পত্রিকায় খবর এসেছে,, হট কেকের মতো বিক্রি হচ্ছে The California Star দৈনিক। গত ২৪’শে জানুয়ারী ১৮৪৮ তারিখে জন সুটার নামের এক ডাচ স্যাক্রমেন্টো ভ্যালীতে (Sacromento Vally) বাড়ির পাশে নিজ জমিতে করাত কল তৈরী করছিলো। এ সময় করাত কলের ছুতার জেমস উইলসন মার্শাল পাশের কলোমা নদীর কিনারে অল্প পানিতে চকচকে কিছু একটা দেখতে পায়, পানিতে নেমে সেটা হাতে তুলে নিতেই আরও কয়েকটা টুকরা চোখে পড়ে।সেগুলো তুলে পরিস্কার পানিতে ভালো করে ধুয়ে কিনারে উঠে এসে যা বুঝলো তাতে অজানা কল্পনায় রীতি মতো হাত পা কাঁপা শুরু হয়ে গেলো। দ্রুত ওগুলো নিয়ে গেলো মালিক জন সুটারের কাছে,, দু'জনেই বুঝলো গরিব থাকার দিন শেষ। এবার তারা আর মালিক কর্মচারী রইলো না, নিমেষেই হয়ে গেলো পার্টনার। দুজনের কথা পাকা হলো খবরটা চেপে রাখতে হবে! কিন্তু তা আর হয়ে উঠেনি। একান সেকান করে রাতারাতি খবরটা চাওড় হলো সারাদেশে।
সেবছর মধ্য মার্চে খবরটা সান-ফ্রান্সিসকোর পত্রিকা প্রকাশক স্যামুয়েল ব্রাননান কানে পৌছোলো, সে এক ঝানু কারবারি, দ্রুত খুলে বসলো খনির কাজে ব্যবহারি মালামালের স্টোর। আর নিজে শিশিতে কয়েক টুকরা সোনা ভরে নিয়ে তা ভরা রাস্তায় চিৎকার জুড়ে দিলো, “গোল্ড গোল্ড গোল্ড, আমেরিকান নদীতে গোল্ড”। তার বেলচা, কড়াই আর ছাকনির কারবার ভালোই জমে উঠলো। শুরু হলো, আমেরিকার ইতিহাসের সবচেয়ে বড় Rush “ক্যালিফোর্নিয়া গোল্ড রাশ”। মধ্য জুন নাগাদ সান- ফ্রান্সিসকোর তিন-চতুর্তাংশ লোক হাওয়া, তাদের ঠিকানা হলো ক্যালিফোর্নিয়া। হাজার খানেক লোকের শহর ক্যালিফোর্নিয়া আগষ্ট নাগাদ চার হাজারি, বছর শেষে পঁচিশ হাজার লোকের শহর হয়ে গেলো।
খবরটা ১৮৪৮ সালের ১৯ শে আগষ্ট,” নিউ ইয়র্ক হেরাল্ড” ছাপানো হলে সে ঢেউ সুদুর অষ্ট্রেলিয়া নিউজিল্যান্ড পর্যন্ত পৌছালো,, আর চায়নাও বাদ পড়লো না। সোনার পাহাড়ের খোঁজে পরের বছর পুরো দুনিয়া থেকে ৪০০০০ নতুন মুখ যোগ হলো সে এলাকায় সালটি ১৮৪৯, এইটিন ফোরটি নাইন। তাদের নামও পড়ে গেলো Forty Niners /49ers / ফোরটি নাইনার্স !!!
এই ঊণ পঞ্চাশ’য়ালা চল্লিশ হাজারীর মাঝে আবার ৭০০ দুহিতা। সিঙ্গেল, ম্যারিড, জোড়াভাঙ্গা সবই ছিলো সে দলে। কেউ স্বামীর পাশে, কেউ স্বামী খুঁজতে আর বাঁকিরা প্রতিদিন নতুন স্বামী পাওয়ার ধান্দায়..
বোর্ডিং হাউজ, গেমিং হাউজ বেকারী, রেস্টুরেন্ট, পানশালা, সেলুন, সেলাই ঘর ও লন্ড্রির কারবার জমে উঠলো ভালই। তবে ললনা'দের চালানো দোকানগুলো একটু বেশীই লাভের মুখ দেখলো!! তারপরও “আদমী চাল্লিশ হাজার, আওরাত ছাত শ, এ তো বড়ই না-ইনসাফি” গোরা বলে কথা। তাই নিয়ম বিরুদ্ধ অপ্রাকৃত যৌনরীতি গড়ে উঠতে বেশীদিন লাগলো না, এক্কেবারে অদল বদল অফার। সভ্য সমাজে আবার এসব আলোচনা অভদ্রতা, তাই আমিও সাহস করলাম না ওসব ছাই-পাস লিখতে।
বরং Gam Saan (সোনার পাহাড়) খুঁজতে আসা এক চাইনিজের গল্প দিয়েই শেষ করবো। সবাই যখন সোনা নিয়ে মাতামাতিতে ব্যস্ত। তখন সে শহরের এক কোণে লন্ড্রি দোকান John John নামের এক নিছক বোকা। কাপড় ধোয়া ইস্ত্রি করা, একদম ফ্রি, অবাক কান্ড ! যেখানে পাহাড়ের ঢালু বেয়ে নামা নদীতে একটু খুড়ে দুচার দলা মাটি কড়াইতে নিয়ে পানি দিয়ে একটু নড়াচড়া করলেই মিলছে সোনার দলা। সেখানে বিনা পয়সায় কাপড় ধোয়া ইস্ত্রি,,দিনশেষে লন্ড্রিতে হুমড়ি খেয়ে পড়তো খনি শ্রমিকের দল। গাদা গাদা কাপড় ধুতে রেখে যায় , ভোর হবার আগেই জন জন সেগুলো ধুয়ে ইস্ত্রি করে একদম রেডি রাখে। কেউ কেউ আবার শাবল বেলচা কড়াই ও ফেলে রেখে যায়। John John সেগুলোও ধুয়েমুছে পরিস্কার করে রাখে। বছর শেষে, সবাই হিসাব কষলো কার কত লাভ হয়েছে। হাতে গোনা কয়েকজন ছাড়া সবাই দেখলো, মোটামুটি আর কিছুদিন কাজ করলে বছরটা ভালোই কেটে যাবে। আর জন জন ময়লা কাপড়ের পকেট কুড়িয়ে আর বেলচা কড়াই ধুয়ে যা সোনার গুড়া পেয়েছে, তা দিয়ে এতদিন সোনার বার বানিয়ে জমিয়েছে। সেগুলো বেচলে তার নিজের বাকী জীবন তো চলবেই উপরন্তু কয়েক পুরুষ রাজার হালে চলতে পারবে..!!
পাদটিকা: পৌনে দু'শ বছর পরেও দেখতে পাচ্ছি সেই একই স্পেশালাটি
পুনশ্চ: Gan saan- Chinese word, Attn: Reza Rahman
লেখকঃ বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমির আইন প্রশিক্ষক ✍হাসান হাফিজুর রহমান💌
সম্পাদক : মোঃ কবির নেওয়াজ রাজ, E-mail: mkprotidin@gmail.com, Contact: (+88) 01643-565087, 01922-619387; Mailing Address: House# 4/A, Main Road, Ati Model Town, Ati, Keraniganj, Dhaka-1312
© All rights reserved © MKProtidin.Com