মাজহারুল রাসেল : সোনারগাঁয়ে হুমকির মুখে ভেষজ উদ্ভিদ। নেই সংরক্ষণের কার্যকরী কোনো উদ্যোগ।
কবিরাজি, আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা ও অ্যালোপেথিক ওষুধ তৈরিতে ভেসজ উদ্ভিদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সংরক্ষণের অভাবে সারা দেশের মতো এক সময়ের ভেষজ গাছ-গাছড়া সমৃদ্ধ সোনারগাঁ অঞ্চল থেকে উজাড় হয়ে যাচ্ছে মূল্যবান ও উপকারী সব ভেষজ উদ্ভিদ।নগরায়ণ, প্রয়োজনীয় পরিচর্যা, অসচেতনতা আর যত্রতত্র গাছ কেটে বসতি স্থাপনের ফলে অযত্ন অবহেলায় মহামূল্যবান এসব ভেষজ উদ্ভিদ হয়ে যাচ্ছে বিলুপ্ত। এসব কারণে কবিরাজি চিকিৎসাও এখন ক্লিনিক্যালি ডেথ। সংরক্ষণ করা গেলে উপজেলার ভেষজ উদ্ভিদের চাহিদা মেটানো সম্ভব বলে অভিমত উপজেলা কৃষি কর্মকর্তাদের ।
সোনারগাঁ এক সময় ছিল ভেষজ উদ্ভিদের বিপুল ভাণ্ডার। উপজেলার বিভিন্ন গ্রামাঞ্চলে বসতবাড়ি, নদী, পুকুরপাড়সহ বিভিন্ন অনাবাদি জমিতে থানকুনি, অর্জুন, মেহগনি, কালো তুলসী, রাম তুলসী, মেহেদি, চন্দনসহ বিভিন্ন গাছ ও লতাপাতার দেখা মিলতো।
এছাড়া এখানকার বেশিরভাগ এলাকায় ছিল প্রচুর গাছপালা, বন-বাদাড়, ঝোপঝাড় ও লতাগুল্ম সমৃদ্ধ। এসব বন-বাদাড়, ঝোপঝাড়ে প্রাকৃতিকভাবেই জন্ম নিতো ভেষজগুণ সমৃদ্ধ শত শত প্রজাতির উদ্ভিদ। যে কারণে স্বল্প ব্যয়ে সহজলভ্য কবিরাজি চিকিৎসা পদ্ধতি এ অঞ্চলে লাভ করে ব্যাপক জনপ্রিয়তা।
জনসংখ্যা বৃদ্ধির ঊর্ধ্বগতি, ইটভাটায় জ্বালানি কাঠ ব্যবহার, নতুন স্থাপনা নির্মাণসহ নানা কারণে ঝোপঝাড় পরিস্কার, গাছপালা কাটা ও আবহাওয়ার বিরূপ প্রতিক্রিয়ার ফলে এ অঞ্চলের প্রাণীকূল যেমন বিলুপ্ত হয়েছে, তেমন উপকারী সব গাছ-গাছড়াও উজাড় হয়ে যাচ্ছে। বৃক্ষ, গুল্ম, বিরুৎ সবই হারিয়ে যাচ্ছে কোথাও দ্রুত, কোথাও ধীরে ধীরে। এর ফলে কবিরাজি চিকিৎসাও পড়েছে মহা সঙ্কটে।
এমনিতেই বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায় কবিরাজি চিকিৎসা বিলীন হতে চলেছে। তার উপর ভেষজ উদ্ভিদের এ মহাসঙ্কট ভাবিয়ে তুলছে উপজেলার গ্রামাঞ্চলের কবিরাজদের। এ দুর্গতিকে অনেক কবিরাজ ‘মরার উপর খাড়ার ঘা’ হিসেবে দেখছেন। ফলে অনেকেই বাধ্য হয়ে কবিরাজি পেশা বদল করছেন। ঝুঁকে পড়ছেন অন্য পেশায়। ভেষজ উদ্ভিদের এমন আকাল গ্রামাঞ্চলের কবিরাজদের পেশা ত্যাগে বাধ্য করছে বলে একাধিক কবিরাজ মনে করেন।
উপজেলার স্থানীয় কয়েক জন কবিরাজ জানান, একসময় যেখানে সেখানে থানকুনি, বিলাই আছড়া, কাটানটে, ভাং, কালো ধুতরা, বনবেগুন, উলটকম্বল, রাম চন্ডাল, কালো তুলসী, রাম তুলসী, শতমূলী, অগ্নিশ্বর, রক্তচিতা, দুধরাজ, ফণিমনসা, ন্যাড়াসেজার, কালোমেঘ, বনধনে, লজ্জাবতী, বিষকাটালী, নীলকণ্ঠ, আকন্দ, সর্পগন্ধ্যা, বিশলা করণী, ঈশ্বরীমূল, পিপুল, বাসক, দাদমর্দন, একাঙ্গি, ভেরেন্ডা, তাল মাঘনা, যজ্ঞ ডুমুর, ভুই আমলা, স্বর্ণলতাসহ নানা জাতের গাছ-গাছড়া প্রাকৃতিকভাবেই জন্ম নিতো।
ফলে প্রয়োজনীয় গাছ-গাছড়ার জন্যও চিন্তাভাবনা করতে হতো না। কিন্তু এখন ৩/৪টি বাদে বাকি সব গাছ-গাছড়ার সন্ধান পাওয়া দুষ্কর।
জানা গেছে, প্রতিবেশী কয়েকটি দেশে ভেষজ উদ্ভিদ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে ও বাণিজ্যিক ভিত্তিতে আবাদ করা হলেও আমাদের দেশে এখনও ভেষজ উদ্ভিদ আবাদ তো দূরের কথা, যেসব স্থানে ভেষজ উদ্ভিদের অফুরন্ত ভাণ্ডার ছিল সে স্থানগুলো সংরক্ষণেরও ন্যূনতম উদ্যোগ নেই। এ উদ্যোগহীনতা কিংবা ব্যর্থতায় প্রতি বছর ভেষজ উদ্ভিদ আমদানিতে মোটা অংকের মাশুল গুণতে হচ্ছে।
উপজেলা উদ্ভিদ ও কৃষি বিশ্লেষক মহল মনে করেন, পরিচর্যা ও ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে বসতবাড়ির আঙিনায়, খোলা জায়গায়, পতিত জমিতে এমনকি রাস্তার দুধারে ভেষজ উদ্ভিদের চারা রোপণ করে এ মহামূল্যবান সম্পদ রক্ষা করা যেতে পারে। আর এটা সম্ভব হলেই বিশাল অঙ্কের রাজস্ব বেঁচে যাবে। ভেষজ উদ্ভিদের অফুরান ভাণ্ডার সোনারগাঁ ফিরে পাবে সেই হীরের দ্যুতি ছড়ানো গৌরব। পদক্ষেপ নেওয়ার সময় এখনই।
এ ব্যাপারে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মনিরা আক্তার বলেন, সংরক্ষণের উদ্যোগ যে নেই তা বলা যাবে না। সংরক্ষণ হচ্ছে। তবে এগুলো সংরক্ষণের ব্যাপারে আরও উদ্যোগী হওয়া দরকার।