বাঘ মেরে যে জ্যোতি বাঘা যতীন হয়েছেন তিনি ব্রিটিশ ক্যাপ্টেন সহ আর তিন সেনাকে একাই জলপাইগুড়ি স্টেশনে উত্তমমাধ্যম দিয়ে ধরাশায়ী করে ফেলবেন এই ঘটনায় আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই৷ ১৯০৭ সালে জলপাইগুড়ি রেল স্টেশনে ব্রিটিশ ক্যাপ্টেনের চরম অশালীন ভাষার সমুচিত জবাব দিয়েছিলেন একা, গুঁড়িয়ে দিয়েছিলেন ব্রিটিশ ক্যাপ্টেন সহ চারজনের প্রতিরোধ তিনি, পাল্টা মারে চারজন কে ধরাশায়ী করেন বাঘা যতীন। ইংরেজদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াইয়ে আত্মবলিদান দেওয়া বীর বিপ্লবী৷
পিতৃদেব উমেশচন্দ্র এসে ছেলের মুখ দেখলেন, নাম রাখলেন জ্যোতি,সারা দেশের মানুষ অবশ্য তাঁকে চিনেছিলেন "বাঘা যতীন" নামে৷
যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের "বাঘা যতীন" নামে পরিচিত হওয়ার নেপথ্যে আছে অসীম শৌর্য আর বীরত্বের অনবদ্য এক কাহিনী৷ বাঘের সঙ্গে মুখোমুখি লড়াই করে বাঘ মারার স্বীকৃতি হিসেবে জ্যোতি পেয়েছিলেন "বাঘা যতীন" উপাধি..
দিনটি ছিল ১৯০৬ এর এপ্রিল মাস, বাংলায় ২৮ চৈত্র৷ আগেরদিন জ্যোতি অফিস করেছে কলকাতায়, তারপর সন্ধ্যের ট্রেনে কয়ায় ফিরেছে বেশ রাতে৷ সকাল-সকাল ঘুম ভেঙে গেলে পুজোতলায় দাঁড়িয়ে দাঁতন করছে,খালি গা, আট হাতের একটা ধুতি কোমরে জড়ানো৷ সবার সঙ্গে কুশল বিনিময় পর্বটা শুরু হয়েছে, জমিদারের খাজনা বাকি, কিছু একটা করতে হবে, কেউ বলছেন একটা বিদ্যালয় হোক গ্রামে, একটি ছেলে কৃষ্ণনগরে পড়তে যেতে চায় সে খরচ জ্যোতি ব্যয় করবে৷ আলোচনা শলা পরামর্শ যেন মুহূর্তে স্তব্ধ হয়ে গেল, দু'মাইল দূরের রাধাপাড়া গ্রাম থেকে ক'জন চাষী এসেছে, চোখে-মুখে উৎকণ্ঠা, তারা বললেন, "দাদাবাবু গাঁয়ে একটা কেঁদো আয়চে" কেঁদো মানে ছোটখাট বাঘ!! চাষীরা বললেন ক'দিন ধরে বাঘটা এর গরু, তার ছাগল ধরে মেরে নিয়ে যাচ্ছে৷ চল-দেখেই আসি কেমন তোদের কেঁদো',ধুতিটা মালকোঁচা মেরে ঘর থেকে একটা কুকরি (দার্জিলিং থেকে কেনা) আনতে যাবে... তখন দিদি বাধ সাধলেন 'হ্যাঁ রে কোথায় চললি? না রে, অমন ন্যাড়া হাতে যাওয়া টা আমার ভাল লাগছে না-একটা বন্দুক অন্তত নে সঙ্গে, "ভারি তো কেঁদো, ঘুরে দেখে আসি"...
জ্যোতির পেছনে ছুটতে ছুটতে আসছে বড় মামার ছেলে ফণী, মেজমামার ছেলে অমূল্য তাদের অনেক আগে রাধাপাড়ার চাষীদের সঙ্গে জ্যোতি এগিয়ে চলেছেন৷ ভাইয়েরা বায়না ধরেছে দাদার সঙ্গে যাবে, অমূল্য একটা পাখি মারা বন্দুক নিয়েছে৷ দাদা জ্যোতি বলল ওটা দিয়ে বাঘ মারা যায়! লজ্জা পেয়ে লুকিয়ে ফেলল পাখিমারা বন্দুকটা! রাধাপাড়া গ্রাম শেষ হওয়ার মুখে আখের ক্ষেত, জ্যোতি যেন দেখলেন আখ গাছগুলো সামান্য দুলছে, সাহস টা বরাবর ছিল,ব্যাপারটা বুঝতে ক্ষেতের ভেতর হামাগুড়ি দিয়ে জ্যোতি ঢুকলেন কয়েক হাত, হ্যাঁ গ্রামের লোক একদম সঠিক বলেছে, এ যে সত্যিই বাঘ!
'এই তোদের কেঁদো? উঠে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে বললেন, ততক্ষনে উত্তেজনা সামলাতে না পেরে অমূল্য পাখিমারার বন্দুকের ট্রিগারে চাপ দিয়ে ফেলেছে৷ভয় হয়ত বাঘ নিজেও পেয়েছিল নিজের জীবন বাঁচাতে অমূল্যর দিকে ছুটে গেল, বাঘের ধাক্কায় সে ছিটকে গেল হাত পাঁচেক দূরে৷ এসবে বিন্দুমাত্র ভয় পেলেন না জ্যোতি৷ ভয় তাঁর জীবনের অভিধানে কোনও দিন ছিল না, ছোটবেলায় মা শরৎশশী নিজে তাঁকে গড়াই নদীতে স্নান করাতে নিয়ে যেতেন, কি শীত কি বর্ষা মায়ের ভ্রুক্ষেপ নেই, ভরা জোয়ারে কাপড়ের একমুড়ো কোমরে বেঁধে ছেলেকে ছেড়ে দিতেন জোয়ারের জলে, ঢেউয়ের ফনায় ছোট্ট একমাত্র ছেলে যখন অবসন্ন হয়ে উঠত, তখন শাড়ির অন্য মুড়ো ধরে মা জল থেকে তুলে আনতেন একমাত্র ছেলেকে, এভাবেই যতীন্দ্রনাথ শিখেছিল বিপদ কে তুচ্ছ করা৷ গায়ে সাংঘাতিক জোর ছিল যতীন্দ্রনাথের, সঙ্গে মনে অদম্য সাহস, মায়ের সঙ্গে ছেলেবেলায় নদীর জোয়ারের জলে সাঁতার কেটে শিখে ছিলো ভয় কে তুচ্ছ করতে..
অমূল্য ছিটকে গেলেও জ্যোতি একটু ঝুঁকে দাঁড়িয়ে হুঙ্কার দিয়ে ফিরে দাঁড়াল বাঘের দিকে, মুহূর্তে বাঘ ঝাঁপিয়ে পড়ল জ্যোতির উপর, কিন্তু এ কি, কুস্তির প্যাঁচ জানা জ্যোতি সামান্য সরে গিয়ে এক লহমায় বাঁ বগলে চেপে ধরল বাঘের ঘাড়,ডান হাত দিয়ে চালাল ছোরার ঘা, কুস্তির প্যাঁচে বাঘকে সাপটে ধরেছে মাটিতে, ভয়ঙ্কর মল্লযুদ্ধ বাঘ বনাম মানুষ৷ উভয়ের ক্ষেত্রেই একটি শর্ত, জানে বাঁচতে হলে অপরকে হত্যা করতে হবে। তাই চললো মরণপণ যুদ্ধ। কখনো বাঘ জ্যোতিকে পেড়ে ফেলে মাটির উপর, আবার জ্যোতি চেপে বসে তার বুকে৷ আশ পাশের লোকজন এসেছেন কিন্তু বাঘ-মানুষের এমন ধস্তাধস্তিতে কাকে মারতে কাকে মারবে, তারা অপেক্ষা করছেন লড়াইটা শেষ হওয়ার, বাঘটা ক্রমেই নিস্তেজ হয়ে আসছে লক্ষ করলে জ্যোতি, সে নিজেও ক্লান্ত, তবে এই সুবর্ণ সুযোগ, দেহের সব শক্তি এক করে ছোরা দিয়ে কুপোতে লাগল বাঘ কে,আস্তে আস্তে বাঘ নিস্তেজ হয়ে গেল,তবে মরার আগে জ্যোতির ডান হাঁটুতে মরণ কামড় বসিয়ে দিলো, দরদর করে রক্ত বের হচ্ছে, গ্রামবাসী পাঁজাকোলা করে জ্যোতিকে নিয়ে চলল বাড়িতে, পিছনে মরা বাঘ নিয়ে শোভাযাত্রা...
দিদি বিনোদবালা দেবীর খাতায় লিপিবদ্ধ এই কাহিনী, চন্ডীমণ্ডপের দালানে জ্যোতির জন্য বিছানা পেতে দিলেন দিদি, তাঁর খাতায় লেখা 'তাঁকে দেখে তাঁর আত্নীয় স্বজন সবাই ভয়ে তটস্থ হয়ে পড়লেন৷ কিন্তু জ্যোতির মুখে হাসি আর অবিচল দৃঢ় মনোভাব সবাইকে ভরসা দিতে লাগল৷ জীবনে কখনো কোনও শারীরিক ব্যথা বা মানসিক দূর্বলতা তাঁকে কাতর করতে পারেনি৷ মামারা ভাল চিকিৎসকদের ডেকে পাঠালেন, ক্ষতস্থান ধুয়ে তারা ওষুধ লাগিয়ে দিয়েছেন, ব্যান্ডেজ করেছেন৷ শোভাবাজারে মেজমামাকে তার করে দেওয়া হ'লো। স্টেশনে মুখোমুখি লড়াইয়ে বাঘ কে মেরে ফেলা জ্যোতিকে দেখতে আট-দশ গ্রামের মানুষের ভিড়, কলকাতায় যতীন্দ্রনাথের অপারেশান করলেন মেজমামার বন্ধু ডাঃ সুরেশপ্রসাদ সর্বাধিকারী৷ আস্তে আস্তে ডাঃ সর্বাধিকারীর শুশ্রূষায় যতীন্দ্রনাথ সুস্থ হয়ে ওঠেন, তিনি বাঘ মারার স্বীকৃতি হিসেবে যতীনের নাম দিলেন, "বাঘা যতীন"
বালেশ্বরের সন্নিকটে বুড়ীবলামের তীরে সঙ্গীদের নিয়ে যতীন্দ্রনাথের ইংরেজ পুলিশের বিরুদ্ধে অসীম বীরত্বের সঙ্গে মুখোমুখি লড়াই ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাসে অবিস্মরণীয় অধ্যায়, যুদ্ধক্ষেত্রে চিত্তপ্রিয় প্রাণ দিলেন দেশের জন্য, যতীনের তলপেটে গুলি লাগে এবং পরের দিন ১০ সেপ্টেম্বর ৩৫ বছর বয়সে শহীদ হলেন এই বীর বিপ্লবী ৷
বাঘা যতীন যদি একজন ইংরেজ হতেন তবে তাঁর মূর্তিটি সেন্ট্রাল লন্ডনের ট্রাফলগার স্কয়ারে নেলসনের কলামের পাশে তৈরি করা হতো। যতীনের শৌর্যে ও বীরত্বের প্রতি শ্রদ্ধায় বলেছিলেন কুখ্যাত ব্রিটিশ পুলিশ অফিসার বিপ্লবীদের চির শত্রু চার্লস টেগার্ট...
তথ্য ও চিত্র কৃতজ্ঞতা: পৃথ্বীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়।
লেখকঃ বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমির আইন প্রশিক্ষক হাসান হাফিজুর রহমান।
সম্পাদক : মোঃ কবির নেওয়াজ রাজ, E-mail: mkprotidin@gmail.com, Contact: (+88) 01643-565087, 01922-619387; Mailing Address: House# 4/A, Main Road, Ati Model Town, Ati, Keraniganj, Dhaka-1312
© All rights reserved © MKProtidin.Com