ঢাকাই মিডিয়াপাড়ায় নঈম নিজাম-পীর হাবিবের দীর্ঘ তিন যুগের অভাবনীয় জুটি ছিন্ন হলো কাল। সম্পাদক নঈম নিজামকে গুড বাই জানিয়ে তার অতিঘনিষ্ঠ নির্বাহী সম্পাদক, প্রখ্যাত কলাম লেখক পীর হাবিবুর রহমান পাড়ি জমিয়েছেন চিরতরে। বেশ কিছুদিন ধরেই তিনি দূরারোগ্য ক্যান্সারে ভুগছিলেন। এরইমধ্যে শুক্রবার রাতে স্ট্রোক, শনিবার বিকেল চারটা পাঁচেই সব শেষ। পীর হাবিবের অন্তিম বিদায়ে জুটির আরেক স্বজন বাংলাদেশ প্রতিদিনের সফল সম্পাদক নঈম নিজাম শুধু লিখতে পারলেন “এটা কী করলেন? বললেন, সারা জীবন একসঙ্গে চলবেন-মানতে পারছি না....আমাকে একা করে দিলেন, একা রেখে গেলেন....।” এ দুটি লাইনের অভিব্যক্তি যারাই পাঠ করেছেন, তাদেরই চোখ ভিঁজে উঠেছে, ভারি হয়েছে কন্ঠস্বর।
সেই ১৯৮৪-৮৫ সালে আজকের কাগজ’এর জামানা। মাঠ পর্যায়ে তখন উভয়েই তারুণ্যদীপ্ত রিপোর্টার। পলিটিক্যাল বিটের তুলকালাম সব সংবাদ প্রকাশ করে হৈচৈ বাধাতে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই। বঙ্গবন্ধু এভিনিউ, পল্টন আর মতিঝিলের সমাবেশ স্থল ঘোরাফেরা, ছোটাছুটিতেই বন্ধুত্ব গড়ে উঠে। দিনে দিনেই তা দৃঢ় হয়েছে, অভিন্ন পরিবারের অভিন্ন মানুষ হয়ে উঠেছেন তারা। এরশাদের আর্মি শাসনসহ রাজনীতির অনেক ভাঙ্গাগড়ায় তারাও কখনো কখনো একজন থেকে আরেকজন ছিটকে পড়েছেন, হয়তো পাল্টেছে কর্মস্থল। কিন্তু খুব বেশি সময় তাদেরকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা যায়নি। ১৯৯৭ সালেই শুরু হলো আরেক জামানা, বাংলাবাজার পত্রিকার অন্যরকম জাগরণ তখন দেশ জুড়ে। সেখানে পীর হাবিবুর রহমান ঘুরে খুঁজে নঈম নিজামকেও হাজির করেন। আবার শুরু হয় যুগপদ সাংবাদিকতা। একদিন নঈম সাহেবের লীড তো পরদিনই লীড প্রকাশ হয় পীর সাহেবের। তখন থেকেই মূলত উভয়ের নিজস্ব পাঠক গোষ্ঠী গড়ে উঠে দেশজুড়ে।
এরপরও তাদের চড়াই উৎড়াই হয়েছে আরো কয়েক দফা। নিউজ মিডিয়া নামের সম্পূর্ণ ভিন্নধারার প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার রুপকার নঈম নিজাম এসটিভি ইউএসএ ঘুরে এটিএন বাংলা চ্যানেলে ঘাঁটি বানান। সেখানেই গড়ে তোলেন টিভি নিউজের কাঠামো। অন্যদিকে পীর হাবিবুর রহমান তখন দৈনিক যুগান্তরের হিট রিপোর্টার। আবার নানা পালা বদল শেষে ২০১৪ সালে বসুন্ধরা গ্রুপ পরিচালিত বংলাদেশ প্রতিদিনে যোগ দিয়ে তিনি পত্রিকাটিকে দেশের শীর্ষস্থানে উত্তীর্ণ করেন। ফলে সেখানেই ডাক পড়ে পীর হাবিবের। অন্তিম বিদায় পর্যন্ত পীর হাবিবুর রহমান এ পত্রিকাতেই নির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন, অপরদিকে নঈম নিজাম হচ্ছেন বাংলাদেশ প্রতিদিনের সম্পাদক। বসুন্ধরার মিডিয়া হিসেবে সুপরিচিত বাংলাদেশ প্রতিদিনে উভয়ের জন্য পৃথক পৃথক অভিজাত অফিস সাজানো। সুযোগ সুবিধা কোনো কিছুরই ঘটিতি নেই। কিন্তু দিনের বেশিরভাগ সময়ই সম্পাদক নির্বাহী সম্পাদক জুটি যে কোনো একজনের রুমেই কাটাতেন। দেশ সমাজের আলাপ আলোচনা, রাজনীতির গতিপথ, সরকারের রকম সকম থেকে পরিবারের টুকিটাকি নিয়েও সমঝোতামূলক আলোচনায় তাদের ক্লান্তি ছিল না মোটেও। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতেও তাদের সক্রিয় ভূমিকা থাকতো জুটিবদ্ধভাবেই।
অফিসেও কর্মিদের ভুলত্রুটিতে একজন ক্ষুব্ধ হয়ে গালমন্দ করলেও সাথে সাথে আরেকজন ভালবাসা, মমত্ব দিয়ে মুহূর্তেই কর্মমুখী করে তুলতেন সবাইকে। এ এক অভাবনীয় গুণের ব্যতিক্রম জুটি, সর্বত্রই যেন ছিল তাদের সফলতা আর সফলতা। তাদের দু’জনকে মিডিয়াপাড়ায় আলাদা করে দেখতেন না কেউ। অসম্ভব হাস্যরস, গল্পে গল্পে কাজ করার নতুন নতুন প্রক্রিয়া উদ্ভাবন করতেন তারা। সেব প্রক্রিয়ার সফলতায় দু’জনের চোখে মুখেই কর্মিরা হাসি খুশির ঝিলিক দেখতে পেতেন। গতকাল তাদেরই একজন পীর হাবিবুর রহমানের মৃত্যু সংবাদ ভাসতেই শোক বিহবল হয়ে পড়েন নঈম নিজাম। মুখে কোনো কথা বলতে পারছিলেন না তিনি, নিজের ফেসবুক ওয়ালে শুধু দুটি লাইন লিখেন এই সফল সম্পাদক। “এটা কী করলেন? বললেন, সারা জীবন একসঙ্গে চলবেন-মানতে পারছি না....আমাকে একা করে দিলেন, একা রেখে গেলেন....।” আর কিছু লিখতে পারেননি তিনি। সংবরণ করতে না পারা অশ্রু স্রোতে ঝাপসা হয়ে গেছে তার দৃষ্টি। কিন্তু টাইম লাইনে নঈম নিজামের লেখা দুটি লাইন যারাই পড়েছেন তাদেরই চোখ ভিঁজে উঠেছে, কেঁপে উঠেছে গলার স্বর। পীর হাবিবের বিদায়ের মধ্য দিয়ে মুষঢ়ে পড়েছেন নঈম নিজাম, সমাপ্তি ঘটেছে ঈর্ষনীয় জুটির। ব্যতিক্রম বন্ধুত্বের অভাবনীয় জুটির ভালবাসা, আন্তরিকতার গভীরতা সবাইকে কাঁদিয়ে ছেড়েছে।
লেখকঃ বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন সেল এর ইনচার্জ জনাব সাইদুর রহমান রিমন।
সম্পাদক : মোঃ কবির নেওয়াজ রাজ, E-mail: mkprotidin@gmail.com, Contact: (+88) 01643-565087, 01922-619387; Mailing Address: House# 4/A, Main Road, Ati Model Town, Ati, Keraniganj, Dhaka-1312
© All rights reserved © MKProtidin.Com