আমরা যাঁরা লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনে সম্পৃক্ত, আমরা যাঁরা দশক ওয়ারী উত্থানপর্বের কবিদের বিষয়ে খোঁজ খবর রাখি, আমরা গভীর অনুসন্ধিৎসা মন নিয়ে পাঠ করি তাঁদের সৃষ্টি। বোঝার চেষ্টা করি কেবলমাত্র চেতনার জগৎ এ নয়, কবির অবচেতনার সম্বন্ধেও বোঝার চেষ্টা করি তাঁর কবিতার আকাশ থেকে। কবির অবচেতনা বা মগ্ন চৈতন্যের প্রতি কবির সচেতনতা খুঁজি তাঁর কবিতার দেহে। যেখানে কবি সাজিয়ে রাখেন শব্দের উত্তরণ। অর্থাৎ তিনি ক্রমশ নিজেকেই ছাড়িয়ে যান। খন্ড জীবনের ক্ষুদ্র পরিপ্রেক্ষিতে একজন তরুণ কবি যেভাবে দেখেন, তিনি সে ভাবনা বিশাল ক্যানভাসে আঁকার চেষ্টা করেন। এক একজন কবি সফল ভাবে এঁকে যান শুরুতেই। তাঁর চিন্তার টেলিস্কোপ অত্যন্ত যুগ সংকট উতরিয়ে যায়। সৌন্দর্য বোধকে প্রতিষ্ঠিত করতে আমিত্ববোধ কবিতার শরীর থেকে ঝেরে ফেলেন। আত্মলীন সৌন্দর্যের জগৎ পরিভ্রমণে অনুকূল পরিবেশ নিজে তৈরি করেন। ফলে অন্কুরিত কবিতা পল্লবিত হয়ে ওঠে একদিন। দ্বিতীয় দশকের কবি দীপশিখা চক্রবর্তীর ” এ শহরে সবাই আগন্তুক ” এর পাঠ পরবর্তী বয়ান শুরু করতে যেয়ে আমি কবি প্রসঙ্গে এমন অবতারণা করলাম।
পুরাতন মনোভঙ্গি কোনোদিনই সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করা যাবেনা। বিবর্তনের পথেই যা কিছু পরিবর্তন ঘটেছে। কবিতার সামিয়ানার নিচে অসংখ্য কবি যশপ্রার্থী প্রতিদিনই আসছেন বানের স্রোতে ভেসে। কিন্তু সবাই শেষ পর্যন্ত টিকে থাকতে পারেননা, কোনোদিন পারেওনি। কবিতার আঙিনা হলো লেগে থাকার আঙিনা। কঠোর অধ্যবসায়ের মধ্যে দিয়ে এ জার্ণি চলে চিরটাকাল। কবিকে একটা জীবন দিয়ে দিতে হয়। তারপরও কেউ কেউ কবিতা সুন্দরীর দেখা হয়তো পাননা। কিন্তু কেউ কেউ অতি সহজে কবিতা সুন্দরীর সান্নিধ্য লাভ করেন। আজকে যে কবির কবিতা নিয়ে কথা বলছি, তাঁর কবিতার শব্দচয়ন, বাক্য গঠন, নির্মাণ শৈলী, মুক্তছন্দের যো সৌন্দর্য তাঁর কবিতার মধ্যে উপলব্ধি করেছি, সে বিষয়ে বয়ান করছি। কবিতা একজন পাঠকের হৃদয়ে আলোড়ন তোলে তখনই, যখন সেই কবিতার সরলতা, আলো-আঁধারির চাঁদ মেঘ, এবং রিদম পাঠকের হৃদয় অব্দি পৌঁছে যায়। কবি দীপশিখা চক্রবর্তীর কবিতা শুধু চপলচরণে নৃত্য করেই পাঠকের হৃদয় ভোলায় না, কাব্যাঙ্গে একটা ম্যাসেজও দেয়। এই ম্যাসেজের রস যখন পাঠক পরিপূর্ণভাবে আস্বাদন করতে পারে তখনই পাঠক তাঁর কবিতার ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে ওঠে। সমাজ, প্রকৃতি, মানবতা, প্রেম, আকাঙ্খা কবির কবিতার উপজীব্য বিষয়। মানুষের অভ্রভেদী মহিমার জয়গান আছে তাঁর কবিতায়। কবির প্রেমবোধ ও রসবোধ অত্যন্ত উঁচু স্তরের। কবি বাসনাকে বাদ দিয়ে অতীন্দ্রিয়ের সাধনা করেননি, আবার বাসনার মধ্যে, সাধনার মধ্যে নিমজ্জিত হয়ে অতীন্দ্রিয়কে ভোলেননি।
ইন্দ্রিয়জ রূপতৃষ্ণা আর অতীন্দ্রিয় রূপতৃষ্ণার প্রবলতার ঢেউয়ে ভেসে যাননি। তিনি শব্দ প্রয়োগে সংযত। জীবন সম্বন্ধে তাঁর বিশিষ্ট মনোভঙ্গি বেশ আকৃষ্ট করে। আমরা কয়েকটি কবিতা লক্ষ্য করিঃ
১.
” প্রতি মুহূর্তে সরে সরে যায় মাটি
হালকা হয়ে আসে মায়ের আঁচল, বাবার হাত
আমাদের ছুটতেই হয়
সকাল হতেই অদৃশ্য হয়ে যাওয়া তারাদের পেছনে,
সমাধিস্থ মনুষ্যত্বের হিংস্রতায় ক্ষত বিক্ষত হয় আলো
স্থির হয়ে আসে সময়
পুরো শরীর থেকে নিংড়ে নেয় সত্ত্বা,
কেউ সব বুঝেও জিতে যাওয়ার অভিনয়ে মাতি
কেউ হঠাৎ ভেঙে ফেলি পেনের নিব,
লেপটে যাওয়া কালিতে পড়ে থাকে হাসি- অর্ধেক বোকা জীবনের।
( এ শহরে সবাই আগন্তুকঃ অভিনয়, পৃষ্ঠা -০৫)
২.
আজকাল আলো দেখলেই মেপে নিই তার আত্মদহন
বোধশূন্য ক্লান্তিকে গুঁড়িয়ে খুঁজি নিপুণতার রঙ,
কোথাও কোনো ছায়া নেই
নেই উবে যাওয়া কোলাহলের বুদবুদ
শুধুই গড়িয়ে যায় প্রহর
এতসব উটকো কথায় শোক জন্মায় সম্পর্কের চোখে,
অভিমানী উচ্চারণে আড়াল হয় দীর্ঘশ্বাস,
তবুও মেনে নিতে হয়
পরাজিত হতে হয় কাব্যের উপচে পড়া শূন্যতার কাছেও
যেন এও এক সুখ
মনের খিদেটুকুই ঈশ্বর!
চোখের ভিতর বাড়তে থাকা জীবনের ঘনত্ব ঠিক বুঝিয়ে দেয়-
ভারহীন কোনো পথে নিজস্বতা এঁকে দেওয়া অতই সহজ নয়!
( এ শহরে সবাই আগন্তুকঃ দহন, পৃষ্ঠা -০৮)
০৩.
আধিভৌতিক এক শূন্যের রাস্তা
ভেঙে ভেঙে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে আশ্রয়!
আকাশ মেঘলা। কুয়াশার মিথ্যে ছাউনি।
ভয়ন্কর এক আগুন-পাখি খুবলে নেয় মেঘের সমস্ত আলো
অন্ধকারের সমীকরণে সাজে মঞ্চ!
অক্ষমতার ঠোঁটে আতঙ্কের সংলাপ জড়ানো শুধুই,
এর কোনো শেষ নেই
এর কোনো ক্লান্তি নেই
শুধু আলো,আরো আলোর যাত্রা করে জীবন,নিঃশব্দে!
সংকেতের শোভাযাত্রায় স্থিরতার বাতাস জানিয়ে যায়
সমস্ত থেমে যাওয়ার গল্প কিন্তু মারাত্মক বিষ ছুঁয়ে লেখা যায়না সবসময়।
( এ শহরে সবাই আগন্তুকঃ শূন্যের সংলাপ,পৃষ্ঠা -১১)
তিনটি কবিতার উদাহরণ দিলাম। কবিতাগুলো গদ্য ফরমেটে লেখা হয়েছে। গদ্য কবিতার প্যাটার্ন ক্রমশ পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। শব্দ ব্যবহারে, চিন্তার নতুন নতুন দুয়ার খুলে দিচ্ছে সাম্প্রতিক তরুণ কবিদের কবিতা। শিশির কুমার দাশ তাঁর ” গদ্য ও পদ্যের দ্বন্দ্ব ” গ্রন্থের সূচনা করেছেন দারুণ একটা ঘটনা দিয়ে। শিশিরকুমার দাশ লিখছেন, ” পল জুদ্যাঁ চল্লিশ বছর বয়সে জেনেছিল যে তাকে যদি তার প্রেমিকার কাছে চিঠি লিখতে হয়,তাহলে লিখতে হবে গদ্যে অথবা পদ্যে,আর কোন উপায় নেই। সে আরও অবাক হয়ে জেনেছিল যে সে গদ্যেই কথা বলে থাকে।চল্লিশ বছর ধরে সে গদ্যে কথা বলছে,বা গদ্য বলছে এই ব্যাপারটা তার কাছে বিস্ময়কর উপলব্ধি। ” মুখের গদ্যের সঙ্গে লিখিত গদ্যের গঠনগত কোনো পার্থক্য নেই। না পদ গঠনে, না পদ ব্যবহারে,না অন্বয়ে। মুখের গদ্যের ধ্বনি বা ধ্বনিসজ্জা প্রতিবিম্বিত হচ্ছে লিখিত গদ্যে ধ্বনির প্রতীক বর্ণে ও বর্ণসজ্জায়।
দীপশিখা চক্রবর্তী যখন লিখছেন, ” প্রতি মুহূর্তে সরে সরে যায় মাটি/ হালকা হয়ে আসে মায়ের আঁচল, বাবার হাত/ আমাদের ছুটতেই হয়/ সকাল হতেই অদৃশ্য হয়ে যাওয়া তারাদের পেছনে”…. ভাষাটা গদ্য। এটা কিন্তু মুখের ভাষা নয়।এটা কবিতার ভাষা। কারণ, আমরা যা লিখি তা আমরা বলিনা,আমরা যা বলি তা আমরা লিখিনা। মুখের গদ্য ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে ভিন্ন – ধ্বনিগুণে ও উচ্চারণের প্রকৃতিতে।লেখায় সেই ধ্বনিগত ব্যক্তিত্বের পার্থক্য অবলুপ্ত।লেখার লক্ষ্য শুধু সাধারণীকরণ নয়, নির্দিষ্টকরণ। সে কারণেই মুখের ভাষায় আমরা বলতে পারি, সবসময় সরে যাচ্ছে মাটি, কিন্তু লিখিত ভাষায় কবি বলছেন, ” প্রতি মুহূর্তে সরে সরে যায় মাটি”… অর্থাৎ একটা দ্যোতনা সৃষ্টি হচ্ছে লেখায়। যেহেতু গদ্য ভাষা তৈরি করতে হয় নানা উদ্দেশ্যে নানা প্রয়োজনে তাই এ ভাষার মান উন্নত ও রুচিকর। দীপশিখা চক্রবর্তী সেই উন্নত ও রুচিকর ভাষা প্রয়োগে, উপমার ব্যবহারে যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। কবিতায় এমন এমন শব্দ একজন কবি প্রয়োগ করেন যা পাঠকের হৃদয়ে দ্যোতনা সৃষ্টি করে। হৃদয় আলোড়িত হয়। আমরা কবির কয়েকটা পংক্তির দিকে নজর দেই।
* মুঠোফোনের আশ্রয়ে ঘরময় ছড়িয়ে পড়ে গজলের আশ্চর্য সুর
*তোমাকে না ছুঁতে পেরে অশান্ত হয়েছে নরম আলো
*আকাশের বিমূর্ত ভালোবাসার ছায়া মাপতে চায় স্বাধীনতার ডানা
*আগুন জলের হয়না প্রেম ডুবছে মেঘের বাড়ি
*এখানে গভীর ঘুম আসেনা রাতে,যেন এক প্রতীক্ষার সমাধি থেকে ডাক ভেসে আসে অন্ধকার চুঁইয়ে
*তবুও রোদ-পোড়া বিকেলের পরে আমি বৃষ্টি ছুঁয়ে দেখি, সামিয়ানা পাতি এক নতুন জন্মের
*আর তুমি! যেন ঠিক আমার সমস্ত আবেগ বুঝে যাওয়া আয়না
*জীবনের ওপর যেন বিছিয়ে দিয়েছি অভিশাপের কার্পেট
*রোদেলা আলো-রঙ খসখসে হাতে মেখে ঝুঁকে পড়ি আগুনের দিকে
*দেওয়ালে আলপিন দিয়ে গাঁথা থাকবে কিছু অনিয়মের ফ্রেম
*বুক পুড়িয়ে কোনোদিন ক্ষণিকের শোক লিখতে পারেনি সলতের আগুন
আলাদা আলাদা কবিতা থেকে বাক্যগুলো নেয়া হয়েছে। যেখানে প্রত্যেকটি বাক্যে উপমার যে স্টাইল তা কবির একক চিন্তার উপাদান। যা পাঠে আমরা আনন্দিত হই। নতুন কিছু দেখি তাঁর কলমের যাদুতে। কবিতার প্রথম পাঠই হলো তার আসল পাঠ।তার পরে এমন এক বিশ্বাসে আমরা নিজেদেরকে আচ্ছন্ন করে ফেলি যে আমরা মনে করি আমাদের অনুভূতি, উপলব্ধির পুনরাবৃত্তি ঘটছে। কবিতা হলো প্রতিবার এক নতুন অভিজ্ঞতা। একটি কবিতা প্রতিবার পড়ার সময় এই অভিজ্ঞতা হয় এবং এটাই হলো কবিতা। কবিতা একটি শিল্প।সুক্ষ্মতম শিল্প। এই শিল্প যিনি সৃষ্টি করছেন তিনি নিঃসন্দেহে অত্যন্ত উঁচু মানের শব্দ প্রকৌশলী। খরস্রোতা নদী বয়ে চলে এবং পানির পরিবর্তন হয়। কবিতাও তেমনি।কবির বাঁকে বাঁকে অভিজ্ঞতা এসে কবিতার নির্মাণ শৈলী পাল্টে দেয়।জগৎ এ রয়েছে বড়ো বেশি সৌন্দর্য। সৌন্দর্য জগৎকে প্রতিনিয়ত প্লাবিত করছে। যে কবি যত বেশি এই সৌন্দর্যে অবগাহন করতে পারবেন, তাঁর কবিতা ততোটাই আধুনিক ও স্বপ্ন বিলাসী হয়ে উঠবে। কবি দীপশিখা চক্রবর্তীর কবিতার কিতাব, ” এ শহরে সবাই আগন্তুক ” পাঠে আমার মনে হয়েছে, তিনি স্বপ্নের ফেরিওয়ালা হয়ে ঠিকঠাক পথে এগুচ্ছেন। কবিতার পথ দীর্ঘ। দু’ চারটে কাব্য গ্রন্থ নয় চিরটাকাল কবিতার জন্য অপেক্ষা করতে হয়। তাঁর কবিতার অন্দরমহলে প্রবেশ করে এটুকু উপলব্ধি করেছি, তিনি অপেক্ষা করছেন, কবিতার ট্রেনে চেপে রওনা দিয়েছেন সেই অমৃতলোকে যেখানে পৌঁছাতে পারলে একজন কবি অমরত্ব লাভ করেন। কবিতা যেহেতু শৈল্পিক বুননে একত্রিত শব্দগুচ্ছের মধ্য দিয়ে সুন্দরের প্রকাশ। দীপশিখা চক্রবর্তী সেই সুন্দর প্রকাশ করে চলেছেন একাগ্রতায়, নিষ্ঠায়, ধ্যানে, স্বপ্নে, জাগরণে।
১২ জুলাই ২০২২, মঙ্গলবার, মোহাম্মদপুর, ঢাকা।