আমার সন্তানেরা জানেও না, কোনো এক যুগে ছবি তোলার জন্য ২৫ মাইল (৩৫ কিঃ মিঃ) পথ পাড়ি দিয়ে শহরে যেতে হতো। আমার তল্লাটের নিকটবর্তী ফটো স্টুডিও ওটাই সর্ব নিম্ন দুরত্ব। ভোর ৫ টায় ভোরের ট্রেন,পরেরটা ৭.৪০ এ "খড়ির গাড়ি" বা খড়ির ট্রেন নামেই তার পরিচিতি, আশেপাশের কয়েক জেলার লোক এই ট্রেনে শাকসবজি, জ্বালানি কাঠ বা গরুর গবরের তৈরি খড়ি বিক্রির জন্য শহরে নিয়ে যেতো। যা বিশেষ কায়দায় ট্রেনের বগীর বাইরে জানালার ভেতর রশি পরিয়ে বেঁধে রাখা হতো। ব্যাপকভাবে খড়ি পরিবহনের কারনে ট্রেনের নামটাই বদলে যায়...
সন্ধ্যায় ফিরতী ট্রেন...
ফটো স্টুডিওর ভেতরে অন্য রকম পরিবেশ, দেয়ালে হাতে আঁকা ছবি, ছোট্ট একটা নদী বা খাল, তার পাড়ে কিছু গাঢ় ফুল ও গাছ (সেসব ফুল বাস্তব জীবনে কোথাও দেখিনি)। নদীর একপাশে ব্রিজ, সেই ব্রিজের উপর দিয়ে একটা বিমান উড়ে যাচ্ছে, তার গায়ে বলাকার ছবি আঁকা ও বিমান লেখা থাকতো। ছবি তোলার জন্য বড়দের বেতের চেয়ার আর ছোটদের জন্য প্লাষ্টিকের ফিতা প্যাচানো গ্রিলের গোল চেয়ার বা টুল। কপালে ফোটা দিয়ে গোল চেয়ারে বসানো, পায়ে লম্বা মোজা, জুতা পরে হাফ প্যান্ট পরা গুলুগুলু বাবু গুলোকে কী দারুণ লাগতো..!
ফটোতোলার দিন মাথায় তেল দেয়া ছিলো কঠোরভাবে নিষিদ্ধ...
ফটোশুটের পাশের রুমটা সাজুগুজু করার, সে রুমে পুরাতন ড্রেসিং টেবিল, তার কাঁচ পিছনের পারা উঠে যাওয়ায় কিছুটা ঝাপসা, সামনে পাউডার দানিতে খুব কম সময়ই সামান্য পাউডার থাকতো, পাউডার প্যাডটারও অবন্থা করুণ। টেবিলে দুই তিনটা ময়লা চিরুনি (গণ), যার একটার মাঝের দাঁত ভাঙ্গা থাকবেই।
সাজগোজ শেষে সিঙ্গেল ছবিতে একা বেতের চেয়ারে বসতে হতো ক্যামেরাম্যান যেভাবে বলবে ঠিক সেভাবেই হাত পা রাখতে হতো, নাহলে ক্যামেরাম্যানের কড়া ধমক, "ছবিটাই শেষ করে ফেলবেন"। মেয়েদের ছবি তোলার ক্ষেত্রে তর্জনী আঙ্গুল গালে রেখে উদাস চাহনি কিংবা মিষ্টি হাঁসি দেবার নিয়ম।
নববিবাহিত'দের ছিলো দু'ধরেনের পোজ, এক; দু'জনে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে হাফ ছবি নাহয় নববধূকে চেয়ারে বসিয়ে হাতলে বরকে বসতে হতো। নববধূর জন্য ফ্রি চশমা সার্ভিসের ছিলো, (নায়িকার সানগ্লাস) এখনকার শীল-পাটায় ধার দেয়া লোকেরা যে চশমা ব্যবহার করে...!
এছাড়াও ফ্রি হ্যাট, টাই এবং সংযোগ বিহীন এন্যালগ টেলিফোন সেটও থাকতো। অনেকেই ছবি তোলার জন্য জীবনে প্রথমবারের মতো টাই পরতো আর মেয়েরা এনালগ ফোনের হ্যান্ডসেট কানে লাগিয়ে খুব মনঃযোগ দিয়ে ফোনে কথা বলছে এমন ভঙ্গিমায় ছবি তুলতো...
সব প্রস্তুতি শেষে, কড়া ফোকাস লাইট জ্বালানো হতো, তখন অাবার ঘামা শুরু,, ক্যামেরার ফ্লাশের সময় কোন অবস্থাতেই চোখের পাতা নড়ানো যাবে না, তাহলে ছবিতে চারটা চোখ দেখা যেতো। তাই চোখের পাতা টানটান করে রাখতে হতো, কার কারও ছবিতে চোখের মনি ফুটে বেরিয়ে আসার মতোও দেখা যেতো..!! সব কিছু সহ্য করার পর মহান ক্যামেরাম্যানের সেই অমর বানী, "স্মাইল প্লিজ",
তারপরেই ক্লিক...
এক সপ্তাহ পরে ছবি আনতে যেতে হবে, তিনভাগের দু'ভাগ টাকা এখনই অগ্রিম জমা দেন...
ঝাপসা আয়না আর দাঁতভাঙ্গা ময়লা চিরুনি, বহুদিন তোমাদের সাথে দেখা হয়না। কালের খেয়ায় আমরা ভেসে চলেছি, হয়তো আর কখনোই দেখা হবে না। যেখানেই থাকো ভালো থেকো, আমায় মনে রাখো আর নাইবা রাখো, দূর শুধু এটুকুই বলবো, "স্মাইল প্লিজ...
লেখকঃ বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমির আইন প্রশিক্ষক হাসান হাফিজুর রহমান।
সম্পাদক : মোঃ কবির নেওয়াজ রাজ, E-mail: mkprotidin@gmail.com, Contact: (+88) 01643-565087, 01922-619387; Mailing Address: House# 4/A, Main Road, Ati Model Town, Ati, Keraniganj, Dhaka-1312
© All rights reserved © MKProtidin.Com