৩ নভেম্বর, ১৯১২ সাল... নারায়ণগঞ্জ স্টিমার ঘাট সেদিন লোকে লোকারণ্য। বছর বাইশের এক তরুণী বিয়ের পর প্রথম শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছে । কিন্তু এতে দেখার কি আছে ? কারণটা হলো পাত্রটি জাপানি আর শ্বশুরবাড়ি কয়েক হাজার মাইল দূরে টোকিও ! কৌতুহলী ঢাকাবাসী এমন অদ্ভুত ঘটনা সাতজন্মেও শোনেনি, তাই এতো ভীড় । নারায়ণগঞ্জ থেকে তারা স্টিমারে যাবে গোয়ালন্দ, সেখান থেকে ট্রেনে কলকাতা। কলকাতা থেকে জাহাজে করে জাপান।
এক বাঙালি ঘরের তরুণী আজ থেকে একশো বছর আগে ঠিক কতটা সাহসী আর আত্মবিশ্বাসী হলে নিজের দেশ নিজের পরিবার-পরিজন ছেড়ে অজানা-অচেনা এক দেশে বসবাস করার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন ভাবুন একবার ! সে দেশের মানুষ বা তাদের সংস্কৃতি সম্পর্কে তিনি কেন, তার দেশের মানুষও বলতে গেলে তখন কিছুই জানতো না। আবার কখনও নিজের দেশে ফিরে আসতে পারবেন কিনা তারও কোন নিশ্চয়তা ছিলো না সেদিন ।
মেয়েটির নাম হরিপ্রভা,জন্ম ১৮৯০ সালে ঢাকার খিলগাঁও গ্রামে। ম্যাট্রিক পাশ করেছিলেন সেখানকার ইডেন স্কুল থেকে । বাবা শশীভূষণ বসু মল্লিক ছিলেন ব্রাহ্মসমাজী, ঢাকায় নিরাশ্রয় নারী, শিশু কল্যাণে 'মাতৃনিকেতন'নামে একটি আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বড় মেয়ে হিসেবে ঐ আশ্রমের কাজ করার সুবাদে পরিচয় হয় জাপানি যুবক উয়েমন তাকেদার সাথে। উয়েমেন তখন পূর্ববাংলার খ্যাতনামা 'ঢাকা বুলবুল সোপ ফ্যাক্টরি'-তে হেড মিস্ত্রী হিসেবে কাজ করতেন। পরিচয়ের অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তাদের পরস্পরকে ভালো লেগে যায়। তারপর দু'পরিবারের সম্মতিতে ১৯০৭ সালে ১৭ বছর বয়সে উয়েমেন তাকেদার সাথে হরিপ্রভা মল্লিকের বিয়ে হয়। এই বিয়ে ছিল সেসময়ের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। সেই প্রথম কোন বাঙালি মেয়ে বিয়ে করলো এক জাপানি কে। যে গোঁড়া ধার্মিক দেশে নয় বছর বয়সে মেয়ের বিয়ে না হলে পরিবারের মুখে চুনকালি পড়তো, হতে হতো সমাজচ্যুত,সেখানে মেয়ের পছন্দকে গুরুত্ব দিয়ে এক ভিনদেশীর সাথে ১৭ বছর বয়সে মেয়ের বিয়ে, সত্যিই ছিলো সে আমলের এক চাঞ্চল্যকর ঘটনা।
বিয়ের পর স্বামীর উপাধি নিয়ে তার নাম হলো হরিপ্রভা তাকেদা। শশীভূষণ মেয়ে-জামাইকে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেন। ওনার সহযোগিতায় জাপানি জামাই ঢাকায় গড়ে তোলেন 'ইন্দো-জাপানিজ সোপ ফ্যাক্টরি' নামে একটি সাবানের কারখানা। কিন্তু বছর খানেক চলার বন্ধ হয়ে যায় কারখানাটি । ব্যবসা গুটিয়ে উয়েমন সস্ত্রীক তখন জাপান চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। হরিপ্রভা-উয়েমন দম্পতির জাপান যাত্রার খবরে চারদিকে রীতিমত হৈ চৈ পরে গেলো।
চার মাস জাপানে কাটিয়ে তারা দুজনে ঢাকায় ফিরে আসেন। দু'বছর পর ১৯১৫ সালে হরিপ্রভা তার জাপান ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নিয়ে একটি বই প্রকাশ করেন.... নাম- 'বঙ্গমহিলার জাপান যাত্রা'। ৬১ পৃষ্ঠার বইটির দাম ছিল চার আনা! ছাগল-ভেড়া আর শুঁটকি মাছের সঙ্গে জাহাজের দিনগুলি, এসরাজ বাজানো, শ্বশুরবাড়ির আতিথেয়তা, ভালবাসা, 'ইন্দোজেন'(ভারতীয় মহিলা)-কে নিয়ে জাপানিদের ঔৎসুক্য, সেখানকার জীবনযাত্রা –এ সব কিছুই তিনি তুলে ধরেন বইটিতে৷
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জাপান ভ্রমণে যান হরিপ্রভার চার বছর পর ১৯১৬ সালে। আর তার লেখা 'জাপানযাত্রী'বইটি প্রকাশিত হয় ১৯১৯ সালে। সে হিসেবেও হরিপ্রভার বইটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এ বইটি লেখার জন্য পরবর্তীতে 'প্রবাসী'সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, সাহিত্যিক অন্নদাশঙ্কর রায়, কবি বুদ্ধদেব বসু ও লেখিকা প্রতিভা বসু হরিপ্রভা তাকেদার অনেক প্রশংসা করেছেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে জাপান সরকার ভারত থেকে সব জাপানিকে দেশে ফিরিয়ে নেয়। স্বামী উয়েমেন তাকেদার সাথে হরিপ্রভাও তখন দ্বিতীয়বারের মত জাপান যান। সেটা ১৯৪১ সাল। যুদ্ধবিদ্ধস্ত জাপানে গিয়ে হরিপ্রভা পড়লেন অথৈ সাগরে! স্বামীর দিকের আত্মীয়-স্বজন সব ছন্নছাড়া,ঘরবাড়ি ভেঙে গেছে বোমায় । না আছে থাকার জায়গা না কোন রোজগার । তার উপর স্বামী উয়েমেন হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পরলেন।
বিপদের দিনে এগিয়ে আসলেন বিপ্লবী রাসবিহারী বসু। সে সময় তিনি টোকিও তে ছিলেন। হরিপ্রভা রাসবিহারী বসুর সহযোগিতায় টোকিও রেডিও-তে 'আজাদ হিন্দ ফৌজ'-এর হয়ে বাংলায় সংবাদ পাঠের চাকুরী পান। তাঁর মাধ্যমেই পরিচয় হয় নেতাজি সুভাষচন্দ্রের সাথে৷ এই সাক্ষাৎকার ঘুরিয়ে দেয় তার জীবনের মোড় । যে চাকরী একদিন নিয়েছিলেন জীবন বাঁচানোর তাগিদে, সেই চাকুরীই পরে করেছেন প্রবল দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে, জীবনের তোয়াক্কা না করে। জাপানের অন্যান্য শহরের মত টোকিও শহরও তখন মিত্র বাহিনীর মূহুর্মুহু বোমা বর্ষণে কেঁপেকেঁপে উঠছে, যখন-তখন যেখানে-সেখানে বোমা পড়ছে। বোমা হামলার ভয়ে রাতে কেউ আলো জ্বালাতো না। চারদিক ঘুটঘুটে অন্ধকার। তারমধ্যে সেই বিধ্বস্থ টোকিও শহরের রাস্তা দিয়ে দুঃসাহসী এই বাঙালি বধূ হেঁটে হেঁটে রেডিও স্টেশনে যেতেন। আঘাত থেকে বাঁচার জন্য মাথায় থাকতো শুধু একটা হেলমেট। এভাবেই এই বীরাঙ্গনা নিজের জীবন বিপন্ন করে ১৯৪২ থেকে ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত নিয়মিত টোকিও রেডিও-তে 'আজাদ হিন্দ ফৌজ'-এর সৈনিকদের জন্য বাংলায় খবর পাঠ করে গেছেন।
পরাজিত ও যুদ্ধ বিধ্বস্ত জাপান ছেড়ে স্বামীকে নিয়ে ১৯৪৭-এ ভারত ফেরেন হরিপ্রভা, ওঠেন জলপাইগুড়িতে বোনের বাসায়। স্বামীর মৃত্যুর পর বোনপোর সাথে চলে আসেন কলকাতায় । নিজের পরিচয় দিয়ে সরকারি সাহায্যের প্রত্যাশী হননি কোনদিন। আজাদী সেনাবাহিনীর সাথে প্রত্যক্ষ যোগ থাকায় কোনও সরকারও সেদিন বাড়ায়নি সাহায্যের হাত !
১৯৭২ সাল...
যে কলকাতা শহর থেকে একদিন নববধূর বেশে জাহাজে যাত্রা করেছিলেন শ্বশুরবাড়িতে, সেখান থেকেই সংস্কার মুক্ত আধুনিক এই বঙ্গনারী রওয়ানা হলেন মহাপ্রস্থানের পথে..
আমরা তাকে মনে না রাখলেও হরিপ্রভার জাপান যাত্রার শতবর্ষ উপলক্ষ্যে ২০১২ সালে মরহুম চিত্র পরিচালক তানভীর মোকাম্মেল " জাপানি বধু" নামে একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেছেন....
লেখকঃ বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমির আইন প্রশিক্ষক হাসান হাফিজুর রহমান।
সম্পাদক : মোঃ কবির নেওয়াজ রাজ, E-mail: mkprotidin@gmail.com, Contact: (+88) 01643-565087, 01922-619387; Mailing Address: House# 4/A, Main Road, Ati Model Town, Ati, Keraniganj, Dhaka-1312
© All rights reserved © MKProtidin.Com