খালক্ ই খুদা , মুলক্ ই বাদশাহ, হুকুম্ ই সিপাহি অর্থাৎ আল্লাহর দুনিয়া, বাদশাহর রাজ্য, সিপাহির হুকুম… বিদ্রোহের দাবানল ছড়িয়ে পড়েছে গোটা ভারতবর্ষে। চট্টগ্রাম বিদ্রোহের সময় নিহত সৈন্যদের ঐতিহ্যবাহী অন্দরকিল্লা শাহী মসজিদের আঙ্গিনায় কবরস্থ করা হলো। এবার গন্তব্য ঢাকা…
১৯ শে নভেম্বর রাতে সিপাহীরা দখলকৃত হাতি ও ঘোড়ার পিঠে অস্ত্রশস্ত্র ও রসদ চাপিয়ে ঢাকা অভিমুখে চট্টগ্রাম ত্যাগ করে, উদ্দেশ্য ঢাকার ৭৩ নম্বর নেটিভ পদাতিক বাহিনীর সাথে যোগ দেয়া..
ততক্ষণে ঢাকার অবস্থা আরও খারাপ, কঠোর দমন চলছে সেখানে, সেসময় লালবাগ দূর্গের ভেতরের সেনা ছাউনিতে ছিলো ৭৩ দেশীয় পদাতিক বাহিনী। দ্রোহ দমনে কর্তৃপক্ষ ৫৪তম রেজিমেন্টের ৩ টি কোম্পানি এবং একশত নৌসেনা ঢাকায় প্রেরণ করে। একই সাথে শ্রীহট্ট যশোর, রংপুর, দিনাজপুর এবং বাংলার আরও কয়েকটি জেলায় একটি করে নৌ-ব্রিগেড পাঠানো হয়। প্রধানত ইউরোপীয় বাসিন্দাদের নিয়ে গঠিত স্বেচ্ছাসেবীদের সংগঠিত করে ঢাকা রক্ষা করার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। নৌ-বিগ্রেড ঢাকা পৌঁছে সেখানে নিয়োজিত সিপাহিদের নিরস্ত্র করতে গেলে অবস্থা চরমে পৌছে। ব্রিটিশ প্রশাসন সিদ্ধান্ত নেয় যে সরকারি রাজকোষ পাহারায় নিযুক্ত দেশীয় সৈন্য ও লালবাগ দুর্গে অবস্থানরত সৈন্যদের কাছ থেকে অস্ত্র প্রত্যাহার করা হবে। রাজকোষ পাহারায় থাকা ট্রেজারি গার্ডদের অস্ত্র কেড়ে নেওয়া হলো সহজেই কিন্তু সমস্যা দেখা দিলো লালবাগ দুর্গে।
সকাল ৫টায় ব্রিটিশ নৌসেনা সিপাহিদের অস্ত্রমুক্ত করতে গেলে শক্ত প্রতিরোধের মুখোমুখি হয় তারা। দুর্গের দক্ষিণ-পূর্বের তোরণ সংলগ্ন দুর্গ দেয়ালের ভাঙ্গা অংশ দিয়ে ইংরেজ সৈন্যরা ঢোকার চেষ্টা করলে সেখানে শুরু হয় সংঘর্ষ। ইংরেজ সৈন্যদের তুলনায় খুব সামান্য সৈন্য ও অস্ত্রবল ছিল দেশীয় সিপাহীদের। সিপাহীরা পরীবিবির কবরের কাছাকাছি কামান স্থাপন করে গোলা ছুড়তে থাকে, ইংরেজরাও শক্তিবৃদ্ধি করে, কয়েক ঘণ্টা যুদ্ধের পর পরাস্ত হয় সিপাহিরা ব্রিটিশ সৈন্যদের বুলেট আর বেয়োনেটের আঘাতে প্রায় ৪০ জন্য সিপাহী মৃত্যুবরণ করে আর আহত হয় বহু সেনা। কেউ কেউ পেছনের জঙ্গল দিয়ে পালিয়ে যায়, যাদের অনেকে ময়মনসিংহ হয়ে রংপুর দিয়ে জয়পাইগুড়ি যাওয়ার পথে তিস্তা নদী পারর হবার সময় ধরা পড়ে।
বাঁকীরা জলপাইগুড়ি যেতে না পেরে নেপালে পালিয়ে যায়, পরে তাদের আর কোন খোঁজ পাওয়া যায় নি। অধিকাংশ পলাতক সিপাহি পরে গ্রেফতার হয় এবং সংক্ষিপ্ত আদালতের বিচারে তাদের মৃত্যুদন্ড ও দীপান্তর দন্ড দেয়া হয়। নিহত সিপাহিদের লাশ লালবাগ দুর্গের ভেতরের পুকুরে ফেলা দেয়া হয়, আর চক বাজার ও আণ্টাঘরের ময়দানে গাছে ঝুলিয়ে বন্দি সিপাহীদের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। বিদ্রোহেরর অভিযোগে একজন মহিলারও ফাঁসি কার্যকর করা হয় এখানে। সদরঘাটের কাছে আজকের বাহাদুর শাহ পার্কটিই ছিল সেকালের আন্টাঘরের ময়দান, সবচেয়ে বেশি বিদ্রোহীর ফাঁসি দেয়া হয়েছিল এই ময়দানেরই বটগাছে। ভবিষ্যৎতে ইংরেজ 'দের বিরুদ্ধে কেউ যাতে পুনরায় বিদ্রোহ করার সাহস না পায় সেজন্য ফাঁসির পরেও মৃতদেহ গুলো আরও কিছুদিন গাছে ঝুলিয়ে রাখা হতো।
এরপর বহুদিন নাকি এলাকার লোক মাঝরাতে দূর্গের ভেতর থেকে সমবেত কান্নার আওয়াজ আর "পানি" "পানি" বলে চিৎকার শুনতে পেতো। স্বাধীনতার জন্য সেই কান্না বাঙ্গালীর কানে পৌছতে আরও বহু বছর লেগে যায়।
চলবে....
লেখকঃ বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমির আইন প্রশিক্ষক
Hasan Hafizur Rahman
সম্পাদক : মোঃ কবির নেওয়াজ রাজ, E-mail: mkprotidin@gmail.com, Contact: (+88) 01643-565087, 01922-619387; Mailing Address: House# 4/A, Main Road, Ati Model Town, Ati, Keraniganj, Dhaka-1312
© All rights reserved © MKProtidin.Com