এই পুতুলটার আজকে জন্মদিন....
সে বলেছে অন্যকিছু চায়না, তাকে নিয়ে একটা গল্প লিখতে হবে, তার জন্য উৎসর্গকৃত গল্পটি
সবে নিউজ ফিড দেখা শুরু করেছি, আর কিচেন থেকে ঝাঁঝাল আওয়াজ, 'ওই মোবাইল নিয়ে আর কতক্ষণ ? মেয়েটা যে না খেয়ে আছে, সেদিকে খেয়াল করবে কে? বাপ বেটি মিলে আমার জীবন টাই শেষ করে দিলো…
রেকর্ড বাজা শুরু হলে আর থামবে না, তাই কথা বাড়তে দেয়া যাবে না।মোবাইল রেখে ছুটলাম আমার আদরের রাজকন্যার নিকটে। স্কুল থেকে ফিরে এখন পর্যন্ত কিছুই খায়নি, ফুপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে, গাল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে…
আমার আদরের মেয়ে, পুতুল নামে ডাকলে খুব খুশী হয়। বয়সের তুলনায় অনেক বুদ্ধি ওর, একটু সময় নিলো কান্না থামাতে।কাছে বসাতে নরম হাতে চোখ মুছে আস্তে আস্তে কান্না থামলো। কান্নার কারণ তখনো অজানা,পুতুল টার কি হয়েছে? বলতেই মুখে এক চিলতে হাঁসির দেখা মিললো…
কি হয়েছে মামনি? খাও নি কেন এখনো? খাইয়ে দিবো? ভাত মেখে মুখের কাছে নিতেই মুখ সরিয়ে নিলো। ব্যাপার কি, খাচ্ছো না কেন? খেতে পারি, যদি একটা প্রমিজ করো। আমি যা চাইবো তোমাকে তাই দিতে হবে, বলো দিবে কিনা?
চিন্তায় পড়ে গেলাম, এমনিতেই মাসের শেষে নিজেকে শ্রীলংকা মনে হয়,মাসের এখনো অর্ধেক বাঁকি।না-জানি কি চেয়ে বসে! হাতের অবস্থা কিন্তু ভালো না বাবা বলতেই, তড়িৎ জবাব, না আব্বু দামী কিছুই না…
সাহস ফিরে পেলাম, খাওয়া শেষ হলো। চেয়ার থেকে উঠে এসে আমার কাঁধে হাত রাখলো, বাবা কাল শুক্রবার ছুটির দিনে আমি মাথা ন্যাড়া করবো।
থতমত খেয়ে গেলাম, বলে কি মেয়ে, সবে কৈশরে পা রাখছে, ওর মা অনেক যত্নে চুলগুলো পরিপাটি করছে। আর ও যখন মাথা দুলিয়ে হাঁটে কিংবা দৌড়ায় চুল গুলোও এপাশ ওপাশ ডানে বামে ছুটে বেড়ায়। দেখতে অসাধারন লাগে, আর সেই চুলই কিনা কেটে ফেলতে চাইছে। মনে হয় উনি লুকিয়ে আমাদের কথা শুনছিলেন, মেয়েরা কখনও মাথা ন্যাড়া করে?অসম্ভব! খেঁকিয়ে উঠলেন তিনি। টিভি রুম থেকে ছুটে এলেন মা, তারও একই কথা, 'আমাদের ফ্যামেলীতে এটা কখনোই সম্ভব না!' মাও ধমক দিলেন, কী দিন এলোরে বাবা! গজগজ করতে করতে ফিরে গেলেন। মামনি তুমি অন্য কিছু চাও, ব্যাপারটা একদমই ভালো ঠেকছে না। কিন্তু কোনই কাজ হলো না।
আবারও অশ্রু বর্ষণ শুরু হলো…
এখন কথা উল্টাচ্ছো কেন বাবা? তুমিই তো কথা দিয়ে তা রাখতে শিখিয়েছ, রাজা হরিশচন্দ্রের সেই প্রতিশ্রুতির গল্পটাই বা কেন শুনিয়েছিলে? কোনও প্রমিজ করলে তা রাখতে হয় বাবা। 'তুমি কিন্তু তোমার প্রমিজ থেকে সরে গেছো।“ আমার মা এবং স্ত্রী কোন ভাবেই রাজী নয়। তারপরও রাতে অনেক ভূগোল বুঝিয়ে রাজী করলাম ওদের।
পরদিন সকালে ওকে নিয়ে গেলাম সেলুনে।একবারে মাথা পরিষ্কার! সাদা মাথা, গোলগাল মুখ, অনেকদিন পর ন্যাড়া করার পর অদ্ভূত লাগছে ওকে। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই, ওর চোখ গুলো উজ্জ্বল আর মুখে আত্মতৃপ্তির হাসি। মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝলাম না…
সাপ্তাহিক ছুটি শেষ, আজ সকালে অনেকদিন পর ওকে নিয়ে স্কুলে রওনা হলাম।স্কুল গেটে নামতেই দেখলাম ওর ক্লাশমেট সাবা তার বাবা মায়ের সাথে দাঁড়িয়ে, অনেক দিন পর উনাদের সাথে দেখা…
এতক্ষণ খেয়ালই করিনি সাবাও মাথা ন্যাড়া করেছে, হাসিমুখে হাত ধরাধরি করে গেট পেরিয়ে স্কুলে ঢুকে গেলো ওরা। ব্যাপার টা কী ভাবি ওরা সবাই দলবেঁধে ন্যাড়া হলো নাকি?
না ভাই, আমাদের মেয়েটা… বলেই একটু দম নিলেন ভাবী, ভাই সাবা খুব অসুস্থ্য,,, ওর লিউকেমিয়া, কেমো থেরাপি দিতে হচ্ছে, সাইড ইফেক্টে ওর চুল পড়ে যাচ্ছে। ও গত তিন মাস রেগুলার স্কুলে আসতে পারেনি, এদিকে আবার টাক মাথা নিয়ে ক্লাশমেট অনেকেই টিজিং করতো।আপনার মেয়েই ওকে সাহস জুটিয়েছে, ও বলেছে, "তোমার মতো আমি চুল রাখবো না, দেখি ওরা কজনকে ক্ষ্যাপাতে পারে" পুতুল ওর পাশে দাঁড়িয়েছে আর কেউ যাতে শুধু একা ওকেই টিজিং করতে না পারে সেজন্য আপনার মেয়েও মাথা ন্যাড়া করে নিয়েছে। আজ আপনার মেয়ের সাহসেই ও স্কুলে এসেছে। পুতুল না এলে হয়তো গেট থেকেই ফিরে যেতাম। এটুকু বলে আর চোখের পানি ধরে রাখতে পারলেন না ভাবী, পাশে দাঁড়ানো ভাইয়েরও একই অবস্থা। উনারা অপলক দৃষ্টিতে স্কুল মাঠের দিকে তাকিয়ে আছেন, পুতুল আর ওর বান্ধবী স্টুডেন্ট'দের ভিড়ে মিশে গেছে। বাচ্চাগুলো মাঠে দৌড়াদৌড়ি করছে, মন দিয়ে উনারা দু'জন সেটাই দেখছেন। ওদের দুজনেরই চোখের নিচের কালোদাগ ছাপিয়ে শুকনো হাসির রেখা। উনাদের দেখতে কেন জানিনা আমারও ভিষণ ভালো লাগছে...
পুনশ্চ : দুনিয়ায় যে শুধু নিজেকে নিয়ে থাকে সে সুখি নয়, প্রকৃত সুখি তো তারাই যারা সুখটা অন্যের সাথে শেয়ার করে সুখি হয়।
কলমেঃ বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমির আইন প্রশিক্ষক হাসান হাফিজুর রহমা।
সম্পাদক : মোঃ কবির নেওয়াজ রাজ, E-mail: mkprotidin@gmail.com, Contact: (+88) 01643-565087, 01922-619387; Mailing Address: House# 4/A, Main Road, Ati Model Town, Ati, Keraniganj, Dhaka-1312
© All rights reserved © MKProtidin.Com