জীবন হয়ে গেছে আলুময়, যে কোনও পদের খাবারে আলু থাকবেই, আলু ছাড়া খাবার অসহায়। এখন আলুর দিকে চাইতেই ডর লাগে, কী জানি কি পুরোনো রাগের প্রতিশোধ নিচ্ছে ওরা।
ইতিহাস হাতড়ে জানলাম, প্রায় ১০ হাজার বছর আগে আলুর চাষ শুরু হয় দক্ষিন আমেরিকার দেশ পেরুতে। টমেটো, ভুট্টা, মরিচের মতো আলুরও ইউরোপ আগমন ১৬ শতকে স্প্যানিশ নাবিকের হাত ধরে, তবে ইউরোপীয়দের পাতে উঠতে আরও ২ শতক লেগে যায় আলুর! ১৮ শতকে ইউরোপে প্রচন্ড জনপ্রিয় হয়ে উঠে আলু, তারপর গ্রাস করেছে খাবারের সব পদ, ছড়িয়ে পড়েছে ধরিত্রীময়।
তবে জাতে উঠতে কম অপমান সহ্য করতে হয়নি আলুকে, স্প্যানিশরা মনে করত আলু অভিজাত ইউরোপীয়দের খাবার হবার যোগ্য নয়, ওসব শুধুমাত্র নেটিভ আমেরিকানদেরই খাওয়া মানায়।
গ্রেট ব্রিটেনে আলুর প্রবেশ জলদস্যু ফ্রান্সিস ড্রেকের নৌকায় চড়ে। তবে উত্তর আয়ারল্যান্ড ও স্কটল্যান্ডের প্রোটেস্ট্যান্টরা অচেনা এ সবজি চাষে অস্বীকার করে, কারণ বাইবেলে এর কথা উল্লেখ ছিল না। পরে অবশ্য আইরিশ ক্যাথলিকরা মন্ত্রপুতঃ পবিত্র জল ছিটিয়ে আলুকে আত্মীভূত করে। বাধা জয় করে আঠার শতকের প্রথম দশকেই আলু আইরিশদের প্রধান খাদ্য হয়ে ওঠে।
ইউরোপীয়রা প্রথমে ভেবেছিল, আলু বিষাক্ত জিনিস, এটি বেলাডোনা এবং টমেটো সহ নাইটশেড পরিবারের অন্তর্গত, যা অখাদ্য বলেও সন্দেহ করা হতো। ইউরোপে দীর্ঘ সময় আলু কেবল পশু প্রাণীদের খাদ্য ছিল,খাদ্য হিসেবে প্রাণীদের এটা বেশ পছন্দের ছিল!
আর রাশিয়ানরা আলুকে বলতো "শয়তানের আপেল!" কারণ শয়তানের কারসাজি ছাড়া কোনরকম আলোবাতাস পানি ছাড়াই মাটির নিচে আপেলের মসৃণ জিনিস জন্মানো সম্ভব নয়, তাই "শয়তানের আপেল" খাওয়া মানে শয়তানের দোস্ত হয়ে যাওয়া, রাশিয়ানরা আলু থেকে দূরে থেকেছে বহুসময়।
রাশিয়ায় প্রথম পিটার আই-এর হাত ধরে আলুর আগমন। সাহিত্যে বর্ণিত আছে, পিটার দ্য গ্রেট রটারডাম থেকে এক ব্যাগ আলু উপহার পান, আর তিনি তা চাষের জন্য নির্দেশ দিয়ে কিছু কূটকৌশল নেন।
সৈন্যরা সারাদিন আলু পাহারা দিতো, তারা রাতে ঘুমাতে গেলে কিছু নিযুক্ত স্পাই আশেপাশের কৃষকদের আলু চুরি করতে প্রলোভন দিতো। ফলে, এতে তারা আলু চুরি করতে শুরু করে এবং গোপনে তাদের নিজেদের ক্ষেতে রোপণ করতে থাকে।
এইভাবে, রাশিয়া জুড়ে খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে আলু, অচিরেই "দ্বিতীয় রুটি"র খ্যাতি অর্জন করে আলু। পুষ্টিগুণ এর কারণে আলু জার্মান ভাষায় "ক্রাফ্ট টিউফেল" নামেও পরিচিত, যার অর্থ শয়তান শক্তি!!
ফ্রান্সে ১৭৪৮ সাল থেকে ১৭৭২ সাল পর্যন্ত আলু অবৈধ ছিল। ফরাসিরা বিশ্বাস করতো আলু মানুষের শরীরে বিভিন্ন রোগ সৃষ্টি করে, বিশেষ করে কুষ্ঠ রোগ!
ফরাসি সেনাবাহিনীর ফার্মাসিস্ট এন্টোইন পারমেন্টিয়ার সাত বছরের যুদ্ধে (১৭৫৬-১৭৬৩) প্রুশিয়ানদের হাতে বন্দী হন। হামবুর্গের কারাগারে থাকাকালে তাকে নিয়মিত আলু খাওয়ানো হতো। জেলখানায় আলু খেয়ে খেয়ে তিনি বুঝতে পারেন আলু মোটেও বিষাক্ত নয়। মুক্তি পেয়ে ফ্রান্সে ফিরে আসার পর, আলুর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি করার কাজে নেমে পড়েন।
পারমেন্টিয়ার কিছু কৌশল ব্যবহার করেন যেমন আলুর চাষ বাড়ানো এবং আলু ক্ষেত পাহারা দেওয়ার জন্য সৈন্য নিয়োগ করা। যাতে লোকজন মনে করে আলু খুব মুল্যবান একটা খাদ্য। এমনকি, বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিনের মতো সম্মানীত অতিথিকে তিনি ডিনারে শুধুমাত্র আলু দিয়ে আপ্যায়ন করেন।
এককালে যে ফ্রান্সে আলু ছিল অবৈধ, পরে সেখানেই সবচেয়ে জনপ্রিয় আলুর খাবারের নাম ফ্রেঞ্চ ফ্রাই। (অবশ্য ফ্রেঞ্চ ফ্রাইয়ের জন্মের ইতিহাস ভিন্ন)
একসময়, অাভিজাত্যের অংশ হিসেবে রাজা ষোড়শ লুই তাঁর ইউনিফরমে আর রানী মারি অ্যান্টোয়েনেট তার কর্সেজে আলুর ফুল পরতে শুরু করেন।
যুদ্ধে জয়ী প্রুশিয়ান (জার্মানির অঙ্গরাজ্য) রাজা ফ্রেডেরিক দ্য গ্রেট (১৭১২-১৭৮৬) আলু চাষে উৎসাহিত করতে শাহী ফরমান জারি করেন, যে কারণে তাঁকে ‘পটেটো কিং' বা “আলু রাজা” নামে ডাকা হতো!
বতেতো ভারতবর্ষে আগমন করে পর্তুগীজদের মাধ্যমে সপ্তাদশ শতকের শেষভাগে, তবে বঙ্গে চাষ শুরু ওয়ারেন হেস্টিংস(১৭৭২-১৭৮৫) এর হাত ধরে। মোগলদের অভিজাত খাবার বিরিয়ানিতে আলু ঢুকে পড়ে ১৮৫৬ সালে গভর্নর জেনারেল লর্ড ডালহৌসি কর্তৃক ক্ষমতাচ্যুত হয়ে কলকাতার মেটিয়াবুরুজে আশ্রয় নেয়া লখনৌ ও আওধের শেষ নবাব ওয়াজেদ আলী শাহের হাত দিয়ে। "খানে কা অউর খিলানে কা শওখিন" নবাব খরচ বাঁচাতে বিরিয়ানিতে নাকি আলু যোগ করেন!
হয়তো এতদিনে সেসব পুরোনো অপমানের শোধ নিচ্ছে সেই অবহেলিত আলু। আবার এমনও হতে পারে কতিপয় আপু/ভাইয়াদের মতো আলুও সবাইকে খুশী রাখতে চায় (সবাইকে খুশি রাখতে চাওয়াদের শেষ পরিণতি এখানে বলা সমীচিন নয়)। তবে নিরীহ আলুর সরলমনে সব খাবারের সাথে মিশে চলতে চাওয়াটাই তার জীবনের বড় ভুল, সেটাই হয়তো, "আলুর ...... ~O-O~"!!!
সম্পাদক : মোঃ কবির নেওয়াজ রাজ, E-mail: mkprotidin@gmail.com, Contact: (+88) 01643-565087, 01922-619387; Mailing Address: House# 4/A, Main Road, Ati Model Town, Ati, Keraniganj, Dhaka-1312
© All rights reserved © MKProtidin.Com