প্রিন্ট এর তারিখঃ নভেম্বর ২১, ২০২৪, ৮:৫৫ পি.এম || প্রকাশের তারিখঃ মার্চ ১৯, ২০২৪, ১:৩৫ পি.এম
দুটি গদ্য একসাথে..........
নব্বই দশকের ট্রেন জার্ণিতে বাংলা ভাষায় যে ক'জন বুদ্ধিদীপ্ত কবির আগমন ঘটেছে, তাঁদের মধ্যে তৃষ্ণা বসাক একটি বিশিষ্ট নাম। একটি বিস্ময়। তাঁর কবিতা নদীর মতো বহমান ও স্রোতময়। তাঁর কবিতার স্বাদ অন্যরকম। প্রিয়পাঠক, আসুন তৃষ্ণা বসাকের কবিতার অন্দরমহলে প্রবেশ করি।
তৃষ্ণা বসাকের কবিতার সাম্রাজ্যে
-তৌফিক জহুর
লেখক জীবন একটা ভ্রমণ। যেদিন থেকে সাদা কাগজে অক্ষরের পর অক্ষরের ইমারত নির্মাণ করতে থাকেন সেদিন থেকেই শুরু হয় ভ্রমণ। সাহিত্য চর্চা একটা জীবন চায় একজন লেখকের কাছে। অর্থাৎ চর্চায় লেগে থাকতে হয়। একজন লেখক যখন বহুমাত্রিক, বহুবর্ণিল লেখার জন্ম দেন তখন তাঁর গন্তব্য নির্ধারণ করা মুশকিল। শুধু তাঁর সৃষ্টির মাঝে আকন্ঠ ডুবে রস আস্বাদনই তখন মুখ্য বিষয়। আমরা তৃষ্ণা বসাকের লেখক জার্ণি নিয়ে যদি বয়ান করতে চাই তাহলে আমাদের একটা সময়কে পেছনে ফিরে তাকাতে হবে। কবে, কিভাবে একজন লেখকের কলমের নিবে প্রথম অক্ষর উঁকি দিয়েছিল তা সেই লেখক বলতে পারবেন। তবে তৃষ্ণা বসাক যেহেতু নব্বই দশকের কবি তাই আমরা বলতেই পারি তিন দশক পূর্বে এই লেখক আঁতুড়ঘর থেকে এসেছেন। কোলকাতার “দেশ” পত্রিকায় ১৯৯২ সালে “সামগন্ধ রক্তের ভিতর” কবিতাটি প্রথম প্রকাশিত হয়। জন্মেই সুতীব্র চিৎকারে একটি শিশু পৃথিবীতে তার উপস্থিতি জানান দেয়। কবিতায় তাঁর এই উপস্থিতি সমসাময়িক কবিদের ভীষণভাবে আলোড়িত করে। প্রশ্ন উঠতে পারে কিভাবে আলোড়িত করে? উত্তর হচ্ছে, ভাষায়, শব্দের বহুমাত্রিক নিরীক্ষায়, উপমায়, উৎপ্রেক্ষায় ও চিত্রকল্পে। প্রত্যেক কবির থাকে সহজাত আত্মতাড়না। এই আত্মতাড়না থেকে সৃষ্টি হয় জীবনমুখী কবিতার বহুবর্র্ণিল মিশেল স্রোত। তৃষ্ণা বসাকের কবিতার ঠাসবুনন, শব্দের আদর, আমাদের এমন এক অর্থের দিকে নিয়ে যায় যা অকল্পনীয়, অচিন্তনীয়। তৃষ্ণা বসাকের কবিতার অন্তর্গত, নিগূঢ় অর্থ কল্পনার সীমানা অতিক্রম করে সুউচ্চ মসনদে আসন গ্রহণ করে। জগত সংসারের যাপিত জীবন, কল্পনার চোখ, পৃথিবী, আসমান, সমুদ্র, নদী, পাহাড়, পর্বত, ফুল, নারীসত্ত্বা সবকিছুকেই কবি ধারণ করছেন চিন্তা ও অভিজ্ঞতার স্বতন্ত্র জগত নির্মাণের মধ্য দিয়ে। ঝলসানো শব্দ নয় পরিমিত বোধ ও শব্দের আদর খেলা করে তৃষ্ণা বসাকের কবিতায়। তাঁর শব্দ চয়নের রুচিবোধ ও সৃষ্টি শক্তির সহজাত দক্ষতায় আমরা মুগ্ধ হই। তৃষ্ণা বসাক একজন কবি, একজন কথাশিল্পী। অসংখ্য শব্দ হুড়মুড় করে তাঁর ঘরে প্রবেশ করতে চায়। কিন্তু সব শব্দকেই একজন কবি হয়ে, একজন কথাশিল্পী হয়ে তিনি প্রশ্রয় দেন না। প্রথমেই বলেছিলাম তাঁর লড়াকু মন বিপ্লবী কিন্তু শব্দ প্রয়োগে অত্যন্ত রুচিশীল। তিনি গল্প, উপন্যাস, কবিতা, কল্পবিজ্ঞান, মৈথিলী অনুবাদকর্মে প্রতিমুহূর্তে পাঠকের সামনে খুলে দিচ্ছেন অনাস্বাদিত জগৎ। তাঁর ধারাবাহিক উপন্যাস “অজিত সিং বনাম অজিত সিং” বর্তমানে আলোচিত সৃষ্টি। সেই উপন্যাসের বিজ্ঞাপনের ভাষা একটু লিখছি, “বিগত প্রায় অর্ধশতাব্দী জুড়ে বাংলার অজস্র মুখের ভাঙাচোরা টুকরো খুঁজে চললেন তৃষ্ণা বসাক, তাঁর নতুন উপন্যাস “অজিত সিং বনাম অজিত সিং”-এ। সব কথনই রাজনৈতিক সেই আপ্তবাক্য মেনে একে কি বলা যাবে রাজনৈতিক থ্রিলার? সিটবেল্ট বাঁধুন হে পাঠক। ঝাঁকুনি লাগতে পারে।” বিজ্ঞাপনের শেষ লাইনটা লক্ষ্য করুন। সিটবেল্ট বেঁধে পড়তে বলেছেন। নইলে ঝাঁকুনি লাগতে পারে। এখানেই তৃষ্ণা বসাকের কারিশমা ভাষার ঠাসবুননে এতোটাই মোহবিস্ট করবে সিটবেল্ট না বাঁধলে পাঠ করতে যেয়ে ঝাঁকুনি লাগবে। আজকে আমরা মূলত বয়ান করবো তৃষ্ণা বসাকের কবিতার নির্মাণ কারুকাজ নিয়ে।
যুগের জ্বালা-যন্ত্রণা ও নৈরাশ্য থেকে শুরু করে শুভবোধ ও রেণেসাঁসের মানবতাবোধের আশাবাদ তাঁর কবিতার পথকে মসৃণ করেছে। দিক্ নির্ণয়ের জন্য জীবনাদর্শের ধ্রুবতারার সন্ধান পাই তাঁর কবিতায়। কবিতার ইতিহাস বাঁক বদলের ইতিহাস। ত্রিশোত্তর আধুনিক বাংলা কবিতার, সবচেয়ে সমৃদ্ধ দশক হিসেবে নব্বই দশকের সময় উল্লেখ করলে অত্যুক্তি করা হবে না। এই সময়ে উত্থান তৃষ্ণা বসাক। স্বভাবতই তাঁর কবিতার মাঝে তত্ত্বের ভান্ডারের চেয়ে সমসাময়িক বিষয়, ইতিহাস, ঐতিহ্য, মিথ নিয়ে তিনি কাব্যের সীমানা বাড়িয়েছেন। বিবর্তনের পথে তাঁর কবিতা নিরীক্ষার মধ্যে দিয়ে নিজস্ব ভাষা সৃষ্টি করে চলেছে। ইন্দ্রিয়ঘন, পরিবেশ সৃষ্টিতে তাঁর কবিতা চমৎকার উত্তাপ সৃষ্টি করে। আর সে কারণেই সৌন্দর্যের উপলব্ধি, প্রেমের বিশ্বব্যাপী চেতনা, মনুষত্ববোধ ও পরিপূর্ণতার আদর্শ আমরা খুঁজে পাই তাঁর কবিতার সাম্রাজ্যে। যেহেতু কবিমাত্রই মননশীল, কবিমাত্রই বিদ্রোহী। তাই আমরা তাঁর কবিতার মাঝে পরিবর্তনের রূপ খুঁজে পাই। কবির মনোভঙি যুগের পরিবর্তিত মানসিক ও সামাজিক পরিস্থিতির প্রভাবে ঘাত-প্রতিঘাতে গড়ে উঠেছে, কবিতায় তার স্বাক্ষর আমরা খুঁজে পাই। প্রত্যেক কবিকে তা তিনি প্রাচীন অথবা আধুনিক যাই হোন না কেন তাঁকে তাঁর ঐতিহ্যের উপর নির্ভর করতে হয় তখন তিনি ক্লাসিকধর্মী, আবার শুধুমাত্র ঐতিহ্যের উপর নির্ভর করে কাব্যরচিত হয়না, কবিকে নতুন উদ্ভাবনও করতে হয়, তখন তিনি রোমান্টিক। ঐতিহ্যকে কবি নিজের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী স্বতন্ত্রভাবে ব্যবহার করেন, এর মধ্যে আমরা কবির রোমান্টিক মনের পরিচয় পাই। সেজন্য কবিমাত্রই একাধারে ক্লাসিক ও রোমান্টিক। আমরা যখন পথ চলি তখন একটি পা সামনের দিকে আর একটি পা পিছনে। সামনের পা-টি এগিয়ে নিয়ে যায় আর পিছনেরটি ভারসম্য বজায় রাখে। তেমনি কবি যেমন নতুন দিগন্ত আবিষ্কার করেন, তেমনি আবার পুরনো ঐতিহ্যের আশ্রয়ও নেন, ভারসাম্য রক্ষার জন্য। এতোক্ষণ তৃষ্ণা বসাকের কবিতা নিয়ে যে বয়ান করে চলেছি তার স্বপক্ষে কয়েকটি কবিতার উদাহরণ দেয়া যাক। তাহলে কুয়াশা ভোর কেটে সোনালি সূর্যালো পরিষ্কার অনুভব করা যাবে। তৃষ্ণা বসাক ও তৌফিক জহুরের যৌথকাব্যগ্রন্থ “ঠান্ডা মাংস এবং আগুনের চুল্লি” থেকে কয়েকটি কবিতা উদ্ধৃত করছি।
১। “ কিন্তু যে কোনো কাজ শুরু করার আগে
আমাকে বারবার, রিওয়াইন্ড করে দেখে নিতে হয় বাবার মৃত্যু,
টেবিল থেকে টেবিলে ফাইলের কফিনে চড়ে
চালান হয়ে যায় ১৮টি শিশুর মৃতদেহ
ধূলো, পুরো ধূলোয় দু-চোখ আবৃত করে আমি বসে পড়ি,
মহার্ঘ বসনের মায়া না করে আমি বসে পড়ি রক্তকীর্ণ প্রান্তরে
সৌরবলয়ের মধ্যে আমি এক দগ্ধ ডানা মানুষ
হে মৃত্যু, আমাকে ভুল করেও প্রণত ভেবোনা”
[ধূলি রাষ্ট্র ঃ ঠা.মা.এ.আ.চু, পৃ-১২]
২। রক্তচাঁদের মতো সকাল
ধীরে ধীরে নদীর পাড় বেয়ে উঠে আসে
নদীতে পা ডুবিয়ে যে রমণীরা
তাদের গতরাতের
ব্যর্থতা, সাফল্যের গল্প বলেছিল
তারা ক্ষণিকের জন্য বাক্য হারা।
তাদের গলায় রক্তবীজের মালা, স্তনে নখরক্ষত,
একটি হারানো নূপুরের জন্য
তারা সারা পৃথিবী তোলপাড় করতে পারে!
কিন্তু এমন সকাল তারা কখনো দেখেনি
চেরিফুলের ফাঁক দিয়ে
রক্তচাঁদের মতো সকাল
রাঢ়ভূমিতে এই প্রথম।
[রক্তচাঁদের মতো সকালে ও রাঢ়ভূমির রমণীরা ঃ ঠা.মা.এ.আ.চু, পৃ-১৫ ]
৩। তোমার উন্মুখ শরীরের নিচে এ শহরকে আর আগের মতো পাবেনা
রাতের অন্ধকারে একে চিরে চলে যাবে, যেন কন্ডোমবিহীন জিপ,
আর এ পাড়ে থাকবে পারাপারহীন ফ্লাইওভারের মতো
তোমার অশ্বারোহীর মতো পুরুষাঙ্গের নিচে এ শহরকে আর আগের মতো পাবে না
কমলা লেবুর মতো স্তন দুটি, ঠান্ডা যেন সদ্য ফ্রিজ থেকে বার করা
রেশম বেড়ালের মতো যোনি, কাঠ, এখনি মাছি বসবে
রোদ ঠিকরানো নিতম্ব বেয়ে কয়েকটি পিঁপড়ে
নিজেদের মধ্যে ব্যস্তভাবে কথা বলতে বলতে উঠে যাচ্ছে
তুমি অনেক চড়াই উতরাই ভেঙে এসে ওর বুকের ওপর মুখ থুবড়ে পড়ে আছো
ওর স্তনের সুপেয় তরল কখন শুকিয়ে গেছে, বুঝতে পারোনি
তোমার উন্মুখ শরীরের নিচে এ শহরকে আর আগের মতো পাবেনা।
[ঠান্ডা মাংস ঃ ঠা.মা.এ.আ.চু, পৃ-১৭]
জীবন সম্বন্ধে বিশিষ্ট মনোভঙি আমাদের আকৃষ্ট করে। তৃষ্ণা বসাক নিজের বক্তব্য বিষয়ের উপযুক্ত ভাষা নির্মাণে আত্মনিয়োগ করেছেন। কাব্যের যেহেতু একটি নিজস্ব জগৎ আছে কবি সেই জগতে পুরোপুরি প্রবেশ করে নিজের কণ্ঠস্বর আমাদের শোনান। আমরা একটি কথা বলতে পারি, তৃষ্ণার কবিতার ভাষায় আবেগের তারল্য, উচ্ছাস, প্রবণতা ও অতিকথনের ভারে চোরাবালিতে নিমজ্জিত নয়। তাঁর কবিতা আমাদের যাপিত জীবনের অনেক কিছুই ইংগিত দেয়। একটি নিজস্ব জগৎ সৃষ্টির লক্ষ্যে কবি তাঁর কবিতায় চিত্র আঁকছেন। যে কবি যত বেশি স্বতন্ত্র ও অভিনব তিনি তত বেশি কবিতায় বিশাল ক্যানভাস আঁকতে সক্ষম হন। কবির চেতনাকে জীবনের মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে। আর যখন তা দাঁড়িয়ে যায় আমরা অদ্ভুত এক সৌন্দর্যের সাগরে ডুবতে থাকি।
“ যদি আমার বেড়ালের নাম মজন্তালি হয়
কিংবা আমার কুকুর পুষতে ভালো লাগে
অথবা ধরুন আমার কোনো পোষ্যই নেই,
যদি আমার নাকটা ঠিক আপনার মতো না হয়,
যদি আমার স্তন থাকে কিংবা না থাকে আর আমি
একজোড়া সুডৌল স্তন নির্মাণের স্বপ্ন দেখি,
যদি আপনি এমন একটা ভাষায় কথা বলি যা আপনি জানেন না
কিংবা আমার কোনো ভাষাই না থাকে, তো?
যদি আমাদের পাড়ার সব বাড়ি রামধনু রঙের হয়,
যদি আমরা মাঝে মাঝে প্রথম পাতে তেতো না খেয়ে শেষ পাতে খাই
যদি আমার বোন কাঁথা না বুনে দিনরাত আঁক কষে,
আর আমার মা ছাদে উঠে হঠাৎ হঠাৎ ঝুলঝাড়– দিয়ে দু’চারটে তারা
পেড়ে আনে আমরা খেলব বলে,
যদি আমার কোনো বাপ-মা নাই থাকে
ল্যাবপ্রসূত আমাকে যদি একটা সঙ্কেত দেয়া হয়
আর যদি সেই নম্বরটা আপনার মামা শ্বশুরের পছন্দ না হয়
যদি
যদি
যদি
যদি
যদি
[যদি ঃ ঠা.মা.এ.আ.চু, পৃ-২৩]
মানুষের সবচেয়ে বড়ো ক্ষমতা বুদ্ধি নয়, হৃদয় নয়- কল্পনা। কবিতা এতো শক্তিশালী হয়ে ওঠে এজন্যেই যে কল্পনা তার পিছনে সবচেয়ে প্রবলভাবে সবচেয়ে উজ্জ্বলভাবে কাজ করে যায়। তৃষ্ণা বসাকের ‘যদি’ কবিতাটি যতোবার পাঠ করি এর অন্তর্গত ব্যাখ্যা হৃদয়ে আলোড়ন তোলে। নব্বই দশকের কবিতায় এই প্রগতিমনষ্কতা যেখানে গোপনীয়তা, নীরবতা, একাকিত্বের আরাধনা। যেখানে ‘মা’ হচ্ছেন মিথ। আবার সমাজকে তির্যকভাবে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়া- কবির প্রগতি কোনো বাইরের শাস্ত্র আচার অনুষ্ঠান বা মতপন্থা নয়, কবির প্রগতি একমাত্র তাঁর নিজস্ব নিয়মে চলা, স্বরচিত শাস্ত্র মানা।
“রক্তচাঁদের মতো সকাল ও রাঢ়ভূমির রমনীরা” কবিতাটি সমাজের এমন একটি বিষয় ইংগিত দিয়ে যায় যা সমাজব্যবস্থার একটা অংশ। যা এড়িয়ে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। কিন্তু এখানে যে বিষয়টি লক্ষ্যণীয় তা হলো কবিতাটির নির্মাণ কাঠামোতো এর সৌন্দর্য নির্মাণ। শব্দের আদর মাখিয়ে তৃষ্ণা বসাক কবিতাটি সৃষ্টি করেছে। কবি যে একক একটি আলাদা সত্ত্বা, তাঁর দেখার ভঙি আলাদা, শব্দ চয়ন আলাদা তা এই কবিতায় দারুণ মুন্সিয়ানায় তৃষ্ণা বসাক অঙ্কন করেছেন। কবিতা লেখার জন্য নিজের গভীর বিবরে ঢুকে যাওয়া চাই। সেখানে সমাজ, রাষ্ট্র নেই আছে অপার অনন্ত আমি। সেখানকার সমুদ্রের নাম আমি, আর সমুদ্রের মাঝখানে যে একখানি সবুজে ছাওয়া দ্বীপ আছে, তার নামও আমি। সেই দ্বীপে যে জাহাজ, নৌকা, স্পিডবোড বাঁধা আছে তার নামও আমি। কবিতা এমন এক জিনিস যা আত্মার সর্বস্ব দখল করে। কবিতা আক্রান্ত একজন মানুষের কাছে পৃথিবীর সব কিছুই বিস্বাদ মনে হয়। যদি সে সহীহভাবে কবিতায় আকন্ঠ ডুবে যায়। চিত্রকল্পের ঠাসবুননে নির্মাণ করেছেন “লাইব্রেরি, শার্টখোলো”-কবিতাটি। আমরা লক্ষ্য করি ঃ
“ লাইব্রেরি, শার্ট খোলো,
আমাকে আর বাহিরে দাঁড় করিয়ে রেখোনা।
জিপার একটানে ছিঁড়ে গলন্ত অক্ষর চেটে নেব,
তোমার গ্রিক ভাষ্কর্যের মতো শরীর,
গোপন অঙ্গ বিভঙ্গে বই আমি কামার্ত পাঠক-
তোমার প্রথম সোপানে আমি সমস্ত পাপভার নামিয়ে রাখলাম
যেন পচা মাংসের পসরা।
লাইব্রেরির সিঁড়িতে কেউ মাংস রাখে? আমি তো রেখেছি
এমন কি আমার দুই স্তন,
তাও দুটো কাচের পেপারওয়েটের মতো তোমার করতলে
তুমি দেখো, দেখে যাও
কাচের কাগজচাপার মধ্যে গোলাপি ডালপালা
সবুজ মরুভূমি আর পার্পল পৃথিবী !
আমি আরও উঠি,
চক্রাকার সিঁড়ি, তোমার উরু ঘিরে ঘিরে উঠেছে
সিঁড়ির প্রতিটা ধাপের নিচে নিচে বই-
একটু জায়গাও নষ্ট করা হয়নি,
আমি উঠতে উঠতে পড়ি
করতে করতে পড়ি
পড়তে পড়তে করি !
করি- এই ক্রিয়াপদ আমাকে পাঠক হিসেবে উত্থান দেয় .....
[লাইব্রেরী শার্ট খোলো ঃ ঠা.মা.এ.আ.চু পৃষ্ঠা -২০]
কবিতা মানে রূপান্তর। কবিতা মানে বদল। কবিতা মানে পরিবর্তন। কবিতা মানে তির্যকতা। কবিতায় সব কিছুই প্রতীক। শব্দ, ছন্দ, চরণ, চিত্রকল্প, মিল-অনুপ্রাস, যতিচ্ছেদ, উপমা- উৎপ্রেক্ষা সব কিছুই প্রতীক। এই শব্দগুলো এখানে যুক্ত করলাম- “লাইব্রেরি, শার্ট খোলো” কবিতাটি পাঠ করে। ‘লাইব্রেরি’- এখানে কবি কি অর্থে ব্যবহার করেছেন। অতিন্দ্রীয় অনুভবে ধ্যানে কবি ‘লাইব্রেরি’ কে পবিত্র উপাসনালয়ের সঙ্গে তুলনা করেছেন। যেখানে পচা মাংস রাখা যায় না। “লাইব্রেরির সিঁড়িতে কেউ মাংস রাখে? আমি তো রেখেছি/এমনকি আমার দুই স্তন”- কবিতা সত্ত্বার গভীরতম তল থেকে উত্থিত হয়। সাহিত্যের আর কোনো মাধ্যম অতো গভীরে যেতে পারেনা। তাতে ধরা পড়ে এমন অনেক কিছু যা দৃশ্যজগতের অন্তর্গত; এমন অনেক কিছু যা অদৃশ্যজগতের অংশ। কবিতা একই সঙ্গে কাজ করে মনন ও কল্পনা ও অনুভূতি ও উপলব্ধি ও অভিজ্ঞতা নিয়ে। তৃষ্ণা বসাকের কবিতা দৃশ্যজগৎ ও অদৃশ্যজগৎ মিলেমিশে কবিতায় অন্য এক সত্যতর জগৎ জাগ্রত করেছে। কোলাহলময় পৃথিবীতে নির্জন, নিরব, জায়গা হচ্ছে লাইব্রেরি। লাইব্রেরির শেলফে-শেলফে যে অসংখ্য গ্রন্থ বসে থাকে তা শান্ত কিন্তু বইয়ের পৃষ্ঠায়-পৃষ্ঠায় যে বাক্যবন্ধ রয়েছে তা হৃদয়ে উত্তাল ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি করে। কবি অসংখ্য বইয়ের একজন বিদগ্ধ পাঠক। প্রাণের উদার বিস্মিত জাগরণ ঘটে লাইব্রেরির সংস্পর্শে গেলে। লাইব্রেরি মানেই শত-শত জ্ঞানের দরোজা। আর লাইব্রেরিতে জ্ঞান চর্চা মানে, মাঠে প্রজাপতির মতো কিংবা নিজের ক্ষেতে চাষির মতো স্বাধীন ও আনন্দময়।
লাইব্রেরি নিয়ে তৃষ্ণা বসাকের আর একটি কবিতা আমরা লক্ষ্য করি ঃ
“ এ ভারি মজার লাইব্রেরি,
যেখানে আসার সময় ব্যাগে সুইমিং কস্টিউম নিয়ে আসতে হয়
আমি ভাসতে ভাসতে পড়ি
ডুবতে ডুবতে পড়ি
সাঁতারের চিৎ, উপুড়, প্রজাপতি, এমনকি প্রণয়-রুদ্ধ ভঙিমাও
আমার শেখা হয়ে যায়।
লাইব্রেরিতে তো লোক শেখার জন্যেই আসে, আমিও এসেছি
এতোটাই নতশীর যে প্রবেশের দরজাই প্রথমে খুঁজে পাচ্ছিলাম না,
তারপর দেখি, কোনো দরজাই নেই
এটা একটা ওপেন লাইব্রেরি
সবুজ সিরাপের মতো ছোটো ছোট বনবীথি দিয়ে ঘেরা
তাই অনেকেই প্রথমে ঢোকার রাস্তা খুঁজে পায়না
আমি পেয়েছি।
আমি অনেক দূরের এক গ্রহ থেকে হাঁটতে-হাঁটতে
এখানে এসেছি পাঠ করে তৃপ্ত হব বলে,
আমাকে নেবে না লাইব্রেরি?
[আমাকে নেবে না লাইব্রেরি ঃ ঠা.মা.এ.আ.চু, পৃষ্ঠা-২১]
শিল্পবোধ ও জীবন চেতনায় জ্ঞানের পথ যখন কবি, আবিষ্কার করে ফেলেন তখন দেখা যায় নির্মল রৌদ্রে একটা বিশাল সুনীল আকাশ তিনি নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছেন। শুরুতেই বলেছিলাম নব্বই দশকের অধিকাংশ কবির কবিতায় কলাকৌশল সম্পূর্ণ আধুনিক কিন্তু বিষয় গরিমায় অনেকের কবিতায় প্রাচীনতাও আছে। শত-শত বছর আগের নির্মাণ ‘লাইব্রেরি’। সেই বিষয়কে নিয়ে তৃষ্ণা বসাক আবেগের জলধারাকে মানবসৃষ্ট লোকের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত করে সমুদ্রে মিশিয়েছেন। তাঁর শুভবোধের নির্মাণ কৌশলে আমরা ডুবে গিয়ে খুঁজে পাই ঝিনুক, মণি, মুক্তো। তাঁর কাব্যভাষা আলাদাভাবে নির্মিত। তাঁর কবিতার পথ নিজস্ব। কোনো-কোনো কবি থেমে যান। গতানুগতিক লেখাই লিখে যান চিরটাকাল। সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে সমানভাবে অগ্রসর হয়ে যেতে পারেন না। তার কারণ তাঁদের চিন্তা ও চৈতন্য থেমে পড়ে; তাঁদের শরীর সত্ত্বার চলিষ্ণু থেকেও মানস সত্ত্বার স্থির হয়ে পড়ে। তাঁরা আর হয়ে ওঠেন না। কিন্তু তৃষ্ণা বসাক অবাক ব্যতিক্রম ও সচল। তৃষ্ণার কবি মন সর্বত্রগামী। যেহেতু কবিতা সর্বত্র থাকে তাই এই কবিতা প্রকৃতিকে অনুসরণ করেনা; কবিতা জীবনকে অনুসরণ করে না; কবিতার একমাত্র কাজ ব্যক্তিমনের অনুসরণ-প্রতিসরণ, ব্যক্তিমনের ফলন-প্রতিফলন। এ কারণেই তৃষ্ণা বসাকের কবিতা পাঠে আনন্দ-যন্ত্রণা মিলে আমাদের পাঠক হৃদয়ে গড়ে ওঠে দ্বিতীয় কবিতা পৃথিবী। আদ্রে র্যাবো বলেছেন “দ্রষ্টা হতে হবে, নিজেকে তৈরি করতে হবে দ্রষ্টা।” কবিতার একটা স্বতন্ত্র পথ নির্মাণ করে ইতোমধ্যে বিদগ্ধ পাঠককূলের নজর কেড়েছেন তৃষ্ণা বসাক। বাংলা কবিতায় নব্বই দশকে তৃষ্ণা বসাক একটি বিশিষ্ট নাম। একজন দ্রষ্টা।
তৃষ্ণা বসাকের " যে কোথাও ফেরেনা " কবিতা কিতাবের একটি তরজমা
প্রাককথনঃ গত শতাব্দীর অস্তমিত সূর্যের শেষ দশকটা পৃথিবীর জন্য সবদিক মিলিয়ে গুরুত্বপূর্ণ। রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, মুক্তবাজার অর্থনীতি, বিজ্ঞান চর্চার ব্যাপকতা, ইন্টারনেট, মুঠোফোন, স্বাস্থ্যসেবার যুগান্তকারী ঘটনা এবং সাহিত্যের আঙিনায় বৈশাখের ঝড়ে আম পরার মতো অনেক কিছু একসাথে একযোগে ফসফরাসের আলোর বৃষ্টি হতে থাকে। পৃথিবীর এই ব্যাপক পরিবর্তনের সময় নব্বই দশকের কবিতার আকাশে যাঁরা ডানা মেলেন, তাঁদের কবিতায় পাওয়া যায় অসংখ্য বিষয়। নতুন সব দৃষ্টি নিয়ে তাঁদের কবিতা ঘুড়ির মতো উড়তে থাকে। দৃষ্টিনন্দন এসব ঘুড়ি পাঠকের নজর কাড়তে সক্ষম হয়। বিষয়ের বৈচিত্র্যময় আয়োজন, নতুন উপমায় সাজুগুজু করে এসব ঘুড়ি জানান দেয় তাঁদের নিজস্বতা। নব্বই দশকের কবিতা জার্ণিতে পশ্চিমবঙ্গের যে ট্রেনটি স্টেশন ছাড়ে সেখানে অসংখ্য কবি যশপ্রার্থী ছিলেন। যাঁরা শুরুতেই তাঁদের নিজস্ব জাত চিনিয়েছেন কলমের ডগায় অক্ষরের বন্যা বইয়ে দিয়ে। সেই নব্বই দশকের ট্রেনে একজন কবি ছিলেন। যাঁর কবিতা নিয়ে আজ আমরা পাঠ পরবর্তী বয়ান করতে যাচ্ছি। তিনি তৃষ্ণা বসাক।
কবিতার আঙিনায় নানা রঙের পাখিঃ
নব্বই দশকের গুরুত্বপূর্ণ কবি তৃষ্ণা বসাক সাহিত্য কে দেখছেন অনেক বড়ো ক্যানভাস থেকে।সাহিত্যের বিকাশ, প্রকাশ ও ভিত্তিস্তর নির্মাণের জন্য তিনি জীবন ও সৃষ্টি কে একবিন্দুতে স্থাপন করে একটা ধ্যানের মধ্যে দিয়ে লিখে চলেছেন। যেহেতু এখানে কবি তৃষ্ণা বসাক এর " যে কোথাও ফেরেনা " কাব্যগ্রন্থ নিয়ে কথা বলছি সমালোচকের দৃষ্টিতে, তাই এখানে আমি একাগ্র, সজাগ, দায়িত্বশীল, রুচিনিষ্ঠ ও নিরপেক্ষ অনুসন্ধানে মত্ত থাকতে চাই। যেকোনো সৃষ্টিই একটা খরস্রোতা নদী।যার সৌন্দর্যে চক্ষু শীতল হয়। আত্মার আরাম হয়। সেই সৃষ্টি কে যথোপযুক্তভাবে আবিষ্কার করাই হলো সমালোচনা সাহিত্যের একমাত্র কাজ। কথাগুলো এজন্যই লিখলাম কারণ, প্রকৃতি, সমাজ, রাষ্ট্র, ইতিহাস, ঐতিহ্য, প্রেম, সংস্কৃতি, যাপিতজীবন এবং ছন্দ যা কবিতার শরীরে হিরে মানিক জহরত এর মতো সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে- এতোসব বিষয় নিয়ে এই কাব্যগ্রন্থের আগমন। অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে পৃষ্ঠা ওল্টাতে হচ্ছে। কারণ, নব্বই দশকের কবি তৃষ্ণা বসাক এই কাব্য গ্রন্থে ত্রিশ বছরের লিখে যাওয়া কবিতার ডালি সাজিয়েছেন। যা বিস্মিত করেছে।কারণ কবিতাগুলো বাঁকে বাঁকে বাঁক বদল করেছে নিজের অবয়ব ও চিন্তা। তিনি আত্মসর্বস্ব ও স্মৃতিচারী হয়েছেন, অবচেতনাকে প্রাধান্য দিয়েছেন। এসবের মধ্যে যখন কবিতা সৃষ্টি হয়েছে, সেখানে কাহিনির সূত্র, চিন্তার পারম্পর্য ও ব্যাকরণের চমৎকার শৃঙ্খলা মেনে চেতন- মনের সৃষ্টি ক্ষমতাই প্রকাশ করেছেন। তাঁর এই গ্রন্থের কবিতাগুলো পাঠ করতে যেয়ে বারবার মনে হয়েছে তিনি বাস্তব জগতের বিষয়কেই নিজের সত্তার সঙ্গে মিলিয়ে কবিতার পংক্তি সৃষ্টি করেছেন। বাস্তব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বিশুদ্ধ স্মৃতি নিয়ে মানুষ বসবাস করতে পারেনা। যতই ইন্দ্রিয়ের দ্বার রুদ্ধ করে অন্তর্জগতের মধ্যে বিলীন হবার চেষ্টা করা যাক না কেনো,আমাদের অজ্ঞাতেই প্রতিদিনের জাগ্রত জীবন স্মৃতির কাঠামো বদলে দেয়। নতুন অভিজ্ঞতা ও অতীত স্মৃতি প্রতিদিন কবিকে জীবন্ত ও সমৃদ্ধ করে তোলে। আমরা তৃষ্ণা বসাকের কয়েকটি কবিতার মধ্যে এর সত্যতা খুঁজি।
১.
হলুদ না গোলাপি
রঙটাই ঠিকঠাক মনে পড়ছে না
ষাটখানা জানলা-দরজা
শেষ গিয়েছিলাম ১৬ মার্চ,
আর একদিন ২০ মে সন্ধ্যেবেলা উঠোন পর্যন্ত
যেখানে মাকে শোয়ানো হয়েছিল
সেই শরীর মাড়িয়ে ভেতরে যাওয়া হয়নি,
ওখানেই আমার প্রবেশ থেমে আছে
থেমে আছে দেওয়ালে পেনসিলের আঁকিঝুঁকি,
( যে কোথাও ফেরেনাঃ যে কোথাও ফেরেনা, পৃষ্ঠা -৭৬)
২.
বুকের মেঝেতে কারা যেন পেরেক পুঁতেছে,
রাস্তায় ছড়িয়ে গেছে অসংখ্য শোকমগ্ন খই,
দিয়েছে হরিধ্বনি,
তবুও কি আত্মা ফিরে যায়?
তোমার শরীর ছাড়িয়ে আত্মা আরো বড়ো হয়ে ওঠে
আরো বেশি দাবী করে
বলে ' শুধু পিন্ড নয়,হৃদয়ের রক্তপিন্ড দাও'
বলে'শুধু অশ্রু কেন,অনুতপ্ত প্রেম এনে দাও,
কেন শুধু গীতা কেন?
শব্দ আনো,তোমাদের নিজস্ব শব্দ,
পৃথিবীর বুকের জিনিস!
জন্মদিন থেমে যায়,মৃত্যুদিন বড় হয়ে ওঠে,
লেখো লেখো,আমি প্রতিদিন বেঁচে উঠি,
বেড়ে চলি,
ক্ষিতি-অপ-তেজ-ব্যেম- মরুত শরীর থেকে ধূলো ঝেড়ে
আবার নতুন ভ্রূণে যাই,
মাতৃগর্ভে খেলা করি....'
(যে কোথাও ফেরেনাঃ পিতৃতর্পণ, পৃষ্ঠা -১১,১২)
৩.
সীমান্তে দুপুর হলো,সাঁজোয়া বাহিনী
গরুর লেজের নিচে হাতড়ায় সোনার বিস্কুট
আর এরা সাতবোন, চুলের চুল্লিতে
গুঁজে রাখে মনস্তাপ, চিরুনির মতো
ফুলনদী আজ যদি ঠাকুরপুকুরে
তার চুল উঠে গেছে, চিরুনির দাঁড়া
অশ্রুমতি ঘিলু বেয়ে নেমেছে গলায়
এদেশে গরাস আর ভিনদেশে থালা!
ভাতছড়া, গড়িয়ার, ময়মনসিংহের
ঢাকা নবাবপুর থেকে টালা চন্দ্রনাথ
নোনা ইলিশের স্বাদ জিভে পুঁতে রেখে
কিউসেক গীতিকা শেখে নদীভগিনীরা..
(যে কোথাও ফেরেনাঃ কিউসেক গীতিকা, পৃষ্ঠা-৯৭)
চিত্রকল্পের বাগানে বসে আছে প্রজাপতিঃ
চিত্রকল্প,রূপকল্প এবং উপমা আমরা প্রতিদিনের কথাবার্তায় প্রচুর পরিমাণে ব্যবহার করি। কয়েক হাজার বছর ধরে এ সমাজে উপমা ব্যবহার হয়ে আসছে। সেজন্যই উপমা কখনোই অস্বাভাবিক ও দৃষ্টিকটু বলে মনে হয় না। সেজন্যই উপমা কবিতার সবচেয়ে স্বাভাবিক অলংকার। হাজার হাজার বছর ধরে ক্রমাগতই উপমা ব্যবহৃত হয়েছে, হচ্ছে, হবে।ফলে উপমা কবিদের অত্যন্ত নিকটতম বন্ধু। তৃষ্ণা বসাক চিত্রকল্পের বাগানে উপমা এমনভাবে সাজিয়েছেন যা আমাদের চমকে দেয়। বিচিত্র বিষয়ের বৈচিত্র্যময় আয়োজনে তিনি সময়ের কাছে ভূগোল, ইতিহাস, বিজ্ঞান এর মধ্যে দিয়ে নিরন্তর একটা সময়কে উপস্থাপন করে চলেছেন। যে সময়ে প্রেম আছে, যন্ত্রণা আছে। এসবের মধ্যে তাঁর শিল্পপ্রেরণা, জীবনচেতনা দুটোকেই এমনভাবে ক্যানভাসে এঁকেছেন যা তাঁর সময়ে মহৎকর্ম হিসেবে ধরে নেয়া যায়। তাঁর নিজস্ব প্যাটার্নের মধ্যে একটা জগৎ তৈরি করতে পেরেছেন। তাঁর চিত্রকল্পের আঙিনায় পা দিলে বোঝা যায়, এ শব্দের বাগানের স্রষ্টা কে? নব্বই দশকে বাংলাদেশ ও ভারতে অল্প কয়েকজন কবি স্বতন্ত্র পথ নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছেন। তৃষ্ণা বসাক তাঁদের একজন।
জীবনানন্দ দাশ, " কবিতার কথা" প্রবন্ধে লিখেছেন, " কবিতা জীবনের নানারকম সমস্যার উদঘাটন ;কিন্তু উদঘাটন দার্শনিকের মতো নয়; যা উদঘাটিত হল তা যে কোনো জঠরের থেকেই হোক আসবে সৌন্দর্য রূপে, আমার কল্পনাকে তৃপ্তি দেবে;যদি তা না দেয় তা হলে উদঘাটিত সিদ্ধান্ত হয়তো পুরনো চিন্তার নতুন আবৃত্তি, কিংবা হয়তো নতুন কোনো চিন্তাও( যা হবার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে), কিন্তু তবুও তা কবিতা হলোনা,হল কেবলমাত্র মনোবীজরাশি।কিন্তু সেই উদঘাটন - পুরনোর ভিতরে সেই নতুন কিংবা সেই সজীব নতুন যদি আমার কল্পনাকে তৃপ্ত করতে পারে, আমার সৌন্দর্যবোধকে আনন্দ দিতে পারে, তাহলে তার কবিতাগত মূল্য পাওয়া গেল; আরো নানারকম মূল্য -যে সবের কথা আগে আমি বলেছি,তার থাকতে পারে, আমার জীবনের ভিতর তা আরও খানিকটা জ্ঞানবীজের মতো ছড়াতে পারে,আমার অনুভূতির পরিধি বাড়িয়ে দিতে পারে, আমার দৃষ্টি স্থূলতাকে উঁচু মঠের মতো যেন একটা মৌন সূক্ষ্মশীর্ষ আমোদের আস্বাদ দিতে পারে ; এবং কল্পনার আভায় আলোকিত হয়ে এসমস্ত জিনিস যত বিশাল ও গভীরভাবে সে নিয়ে আসবে কবিতার প্রাচীন প্রদীপ- ততই নক্ষত্রের নূতনতম কক্ষ পরিবর্তনের স্বীকৃতি ও আবেগের মতো জ্বলতে থাকবে ( পৃষ্ঠা -১৫)।"
তৃষ্ণা বসাক এর কবিতা আমাদের কল্পনার আভায় ঝাঁকুনি দেয়। আমাদের চিন্তার এন্টেনায় দ্যুতি ছড়ায়। আমাদের ভাবতে বাধ্য করে তাঁর কবিতার সৌন্দর্য জগতের ঠাসবুননি। তৃষ্ণা বসাক কবিতায় চিত্রকল্প আঁকতে যেয়ে এমনভাবে শব্দের আদর প্রয়োগ করেছেন যা পাঠে আমাদের আত্মা আরাম বোধ করে। দুটি কবিতা লক্ষ্য করিঃ
" ভোর এসে কাজের মাসীর মতো
অধৈর্য হাতে ডোরবেল টিপে যেতেই
গোলাপজামের রেণু চোখেমুখে ঢুকে যায়
আর আমাকে প্রায় ধাক্কা দিয়ে ভেতরে ঢুকে আসে ভোর
নিজেই চা করে লোড়ো বিস্কুট ডুবিয়ে ডুবিয়ে খায়,
বারান্দায় জমা গতরাতের দুঃস্বপ্ন ঝাঁট দিয়ে বাইরে ফেলে
গ্রিলের প্রতিটি জটিল নকশা রোদ দিয়ে ধুয়ে দ্যায়
তারপর আরও দশ বিশ সহস্র বাড়ি সারবে বলে
চটি ফটফটিয়ে বেরিয়ে পড়ে! "
(যে কোথাও ফেরেনাঃ ভোর, পৃষ্ঠা -২৫)
" রক্ত চাঁদের মতো সকাল
ধীরে ধীরে নদীর পাড় বেয়ে উঠে আসে,
নদীতে পা ডুবিয়ে যে রমণীরা
তাদের গতরাতের
ব্যর্থতা,সাফল্যের গল্প বলছিল,
তারা ক্ষণিকের জন্য বাক্যহারা!
তাদের গলায় রক্তবীজের মালা,সৃতনে নখরক্ষত
একটি হারানো নূপুরের জন্য
তারা সারা পৃথিবী তোলপাড় করতে পারে!
কিন্তু এমন সকাল তারা কখনও দেখেনি,
চেরিফুলের ফাঁক দিয়ে
রক্ত চাঁদের মতো সকাল
রাঢ়ভূমিতে এই প্রথম। "
(যে কোথাও ফেরেনাঃ রক্ত চাঁদের মতো সকাল ও রাঢ়ভূমিী রমণীরা, পৃষ্ঠা -৯৪)
কবিতার পাঠক চিরকালই স্বল্প। সাম্প্রতিক কবিতায় ধোঁয়াটে, দুর্বোধ্য কলাকৌশল, অর্থহীন বাক্যবিন্যাসের দ্বারা কবিতার শরীরে যে মেঘলা আকাশ সৃষ্টি করা হচ্ছে, তা অশনি সংকেত। অল্প পাঠকের সবচেয়ে উজ্জ্বল ও গুরুত্বপূর্ণ শাখায় যদি হালফিল অবস্থা এমন করুণ হয়,তাহলে ভবিষ্যতে বাংলা কবিতার জায়গা কোথায় যাবে, তা আন্দাজ করলে গা শিউরে ওঠে। কবি তৃষ্ণা বসাকের কবিতার আকাশ মেঘযুক্ত নয়।ঝরঝরে সুনীল রৌদ্রময় আকাশ। যা পাঠে পাঠকের আত্মা আরাম পায়। কবির হৃদয়ের ঝড়কে তিনি উপমার নান্দনিকতায় সৃষ্টি করেছেন কবিতায়। জগতের অনেক বিষয় তিনি তাঁর কবিতার শরীরে গেঁথেছেন। ফলে রূপের মাঝে অপরূপের সম্মোহন ঘটেছে। প্রকৃতির মাঝে তৃষ্ণা খুঁজে ফেরেন বিচিত্র আলপনা। যা তাঁর উপমা, চিত্রকল্প, রূপকের মধ্যে দিয়ে বাক্যের সুললিত ধ্বনিতে অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে আনন্দ ছড়ায়।
" যে কোথাও ফেরেনা " কাব্যগ্রন্থ নিয়ে কথা বলছি। আমরা তৃষ্ণার কবিতায় শব্দ চয়ন ও বাক্য বিন্যাসে সমাজমনস্কতা, বিজ্ঞান চেতনা, বিশ্বাসের জায়গা, ধর্মীয় মনস্তাত্ত্বিক চিন্তাধারা নিয়ে কথা বলে এ লেখার পরিসমাপ্তি টানবো। তৃষ্ণা বসাকের কবিতায় বাস্তব রস ও অন্তরের নিগূঢ় রসের সমন্বয় আমাদের বিস্মিত করে। অন্তরের তাগিদে শিল্প সৃষ্টির প্রয়াসে তৃষ্ণা বসাক অনিবার্যভাবে মুখোমুখি দাঁড়াবার সাহসে বলিয়ান। গত শতাব্দীর অস্তমিত সূর্যের শেষ রশ্মির নাম নব্বই দশক। শতাব্দীর শেষ দেশীয় আন্তর্জাতিক বিষয়গুলো তিনি খুব কাছ থেকে দেখেছেন, যা তাঁর কবিতায় উঠে এসেছে। যেখানে সংশয়, সন্দেহ, জীবনের পদে পদে জিজ্ঞাসা রয়েছে। যুক্তি, গণতন্ত্র, সাম্রাজ্যবাদ, মুক্তবাজার অর্থনীতির স্বপ্নস্বর্গের সিঁড়ি নির্মাণ শুরু। সেই সময়ের কবিদের মানসিক বিকাশটা হয়েছে সম্পূর্ণ মননধর্মী। সমসাময়িক বন্ধুদের আত্মবিরোধ, অনিকেত মনোভাব ডিঙিয়ে তিনি সৃষ্টির মাঝেই আকন্ঠ ডুবে ছিলেন। তিনি তাঁর এ কাব্য গ্রন্থের চল্লিশ পৃষ্ঠায় " এ পৃথিবী, জেনে রেখো,শুধু পথিকের".... কবিতায় যখন বলছেন, " পথও সরল নয়,আঁকাবাঁকা এবং বন্ধুর/ স্থানে স্থানে পথরেখা মুছে গেছে, অথচ যেতে হবে বহুদূর,/ বাঁকে বাঁকে পথবন্ধু,জলছত্র, সবুজ সুপেয়/ পেছনের রাস্তাগুলো যতটা সম্ভব ভুলে যেও"... নিষ্ঠুর এবং যান্ত্রিক নগর সভ্যতার বাইরে বিচাল এক ব্যাপ্তির জন্য কবি আকুল।তাঁর জীবনের নোঙর এত শক্ত যে তাঁর দিগন্ত পিপাসা মিটছে না।সম্ভবনার নোঙর কোথায় সে সম্বন্ধে তিনি জানেননা, শুধু এগোতে চান। বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে। আধুনিক কাব্যের প্রধান লক্ষ্যণ বাকরীতি ও কাব্যরীতির মিলন, সেটি তৃষ্ণা বসাকের কবিতায় দেখা যায় মাঝে মাঝে, তবে পাশ্চাত্য সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য থেকে সচেতনভাবে বাহুল্য বর্জন করে বাক্যগঠনে মিতব্যয়ী তিনি স্বদেশ, মৃত্তিকায় কাব্যের বিস্তার ঘটিয়েছেন। একদিকে তিনি আন্তর্জাতিক আঙিনার গোলাপের সৌরভ গ্রহণ করেও প্রয়োগ করেছেন স্বদেশের গোলাপ অন্যদিকে মানবিক বিষয়ে মানবাত্মার জন্য বেদনা, জীবনের কুৎসিত, নিষ্ঠুর,দুঃখ দৈন্যময় রূপ সম্বন্ধে মানুষকে জাগানোর জন্য তাঁর কবিতায় চিত্র এঁকেছেন। তৃষ্ণা বসাকের অন্তরে ভাবাবেগ যথেষ্ট প্রখর, কিন্তু বাক্য গঠনে বাগবাহুল্য নেই, সেখানে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত বাষ্পোচ্ছাস। এজন্যই তাঁর কবিতা নজরকাড়ে। যেহেতু কবিতার প্রথম পাঠই হলো আসল পাঠ,তার পরে এমন এক বিশ্বাসে আমরা নিজেদের আচ্ছন্ন করে ফেলি,আমরা মনে করি আমাদের অনুভূতি, উপলব্ধির বারবার আগমন ঘটছে। কবিতা হলো প্রতিবার এক নতুন অভিজ্ঞতা। একটি কবিতা প্রতিবার পড়ার সময় এই অভিজ্ঞতা হয়। তৃষ্ণা বসাক নব্বই দশকের কবি। এ সময়ের কবিদের শুরুর কবিতাগুলোয় অনেকের মাঝে জীবনানন্দ দাশের প্রবল ছায়া লক্ষ্য করা যায়। একটা ঘোরের মধ্যে দিয়ে এ সময়ের কবিদের পথচলা। কিন্তু তৃষ্ণা বসাক এ পথে হেঁটে যাননি। আশ্চর্য হয়ে তন্নতন্ন করে খুঁজেও কোনো প্রভাব মেলেনি। বরং নতুন চিন্তার ছাতা মেলে দিয়েছেন কবিতায়। কোনো কোনো কবি তপস্যা করেন একটি উৎকৃষ্ট কবিতা সৃষ্টির জন্য। যে কবিতাকে আমরা সিগনেচার পোয়েট্রি বলি।তৃষ্ণা বসাক বেশ কয়েকটি সিগনেচার পোয়েট্রি সৃষ্টি করেছেন। একটি উদাহরণ দিচ্ছি। কবিতার শিরোনাম, "যদি"। " যদি আমার বেড়ালের নাম মজন্তালি হয়,/ কিংবা আমার কুকুর পুষতে ভালো লাগে,/অথবা ধরুন আমার কোনো পোষ্যই নেই /যদি আমার নাকটা ঠিক আপনার মতো না হয়/যদি আমার স্তন থাকে কিংবা না থাকে/ আর আমি একজোড়া সুডৌল স্তন নির্মাণের স্বপ্ন দেখি,/যদি আমি এমন একটা ভাষায় কথা বলি যা আপনি জানেননা,/ কিংবা আমার কোনো ভাষাই না থাকে,তো?/যদি আমাদের পাড়ার সব বাড়ি রামধনু রঙের হয়,/ যদি আমরা মাঝে মাঝে প্রথম পাতে তেতো না খেয়ে শেষ পাতে খাই,/ যদি আমার বোন কাঁথা না বুনে দিনরাত আঁক কষে/আর আমার মা ছাদে উঠে হঠাৎ হঠাৎ / ঝুলঝাড়ু দিয়ে দু চারটে তারা পেড়ে আনে/ আমরা খেলব বলে/ যদি আমার কোনো বাপ মা নাই থাকে / ল্যাবপ্রসূত আমাকে যদি একটা সন্কেত দেয়া হয়/ আর যদি সেই নম্বরটা আপনার মামাশ্বশুরের পছন্দ না হয় / যদি/ যদি/ যদি/ যদি/ যদি... ( যদি, পৃষ্ঠা -১৪৮)।
এখানে কবিতা নিজেই নিজেকে নির্মাণ করেছে। যেহেতু কবিতা হলো শৈল্পিক বুননে একত্রিত শব্দগুচ্ছের মধ্যে দিয়ে সুন্দরের প্রকাশ। কবিতাকে আমরা এভাবেই চিনি।কবিতাকে আমরা সংজ্ঞায়িত করতে পারিনা সঠিকভাবে। যেমন আমরা সংজ্ঞায়িত করতে পারিনা কফির স্বাদ, চুম্বনের স্বাদ কিংবা ক্রোধ, ভালোবাসা, ঘৃণার অর্থ, সূর্যোদয় কিংবা সূর্যাস্তের অর্থ। আবার দেশের প্রতি ভালোবাসার কোনো মাপযন্ত্র নেই । এই জিনিসগুলো এতই গভীর যে সেগুলোকে কেবল সাধারণ প্রতীকের দ্বারাই প্রকাশ করা যায়। আমরা কেবল, কবিতা পাঠ করে খুঁজে পাই কবিতার স্পর্শকে, কাব্যের সেই বিশেষ অনুরণনকে অনুভব করি। যে কবি যত বেশি স্বতন্ত্র ও অভিনব তিনি তত বেশি নিঃসঙ্গ। আর নিঃসঙ্গতায় ধ্যানে মশগুল হওয়া যায়। সৃষ্টির অভিনবত্বের খোঁজ মেলে। তৃষ্ণা বসাক কবিতায় নিজের স্বর প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছেন।
সহায়ক গ্রন্থ :
১. ঠান্ডা মাংস এবং আগুনের চুল্লি ( তৌফিক জহুর - তৃষ্ণা বসাক)
২. যে কোথাও ফেরেনা : তৃষ্ণা বসাক
৩. করতলে মহাদেশ : আবদুল মান্নান সৈয়দ
৪.আল মাহমুদ এবং অন্যান্য : তৌফিক জহুর