উজ্জ্বল রায়, নিজস্ব প্রতিবেদকঃ এখানে রয়েছে এগারসিন্দুর দুর্গ যেটি দখল করে কৌশলগত অবস্থান নিয়ে বীর ঈশাখাঁ মোগলদের সঙ্গে যুদ্ধবিগ্রহ করেছিলেন। লাল মাটি, সবুজ গাছগাছালি আর ঐতিহাসিক নিদর্শনে সমৃদ্ধ এগারসিন্দুর। এটি ছিল ঈশা খাঁর শক্ত ঘাঁটি।উ জ্জ্বল রায় নিজস্ব প্রতিবেদক জানান,জ নশ্রুতি রয়েছে, ১১টি নদীর মোহনায় ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে উঁচু শক্ত এঁটেল লাল মাটির এলাকা ব্যবসা বাণিজ্য ও বসবাসের স্থান হিসেবে উৎকৃষ্ট বিবেচিত হওয়ায় গঞ্জের হাট নামে এটি প্রসিদ্ধ ছিল। হাটটি ১১টি নদীর সংগমস্থলে হওয়ায় স্থানীয়রা ১১টি নদীকে সিন্দু আখ্যায়িত করে গঞ্জের হাট থেকে স্থানটির নামকরণ করেন এগারসিন্দুর। সেখানে ষোড়শ শতাব্দীতে বেবুদ নামে এক কোচ উপজাতি প্রধান এগারসিন্দুর দুর্গ নির্মাণ করেন। ঈশা খাঁ বেবুদ রাজার কাছ থেকে দুর্গটি দখল করেন এবং একে শক্তিশালী সামরিক ঘাঁটিতে পরিণত করেন।
১৮৯২ সালের ভূমিকম্পে দুর্গটি ধ্বংস হয়ে গেলেও আজো কিছুকিছু নিদর্শন আছে যা দেখে আন্দাজ করা যায় দুর্গটির অবস্থান। দুর্গটি ছিল বিশাল আকারের। দুর্গ এলাকায় এখনো খুঁজে পাওয়া যায় জাফরি ইট, অজানা সুরঙ্গ, মৃৎপাত্রের ভগ্নাংশ। এটি ছিল ঈশাখাঁর শক্ত ঘাঁটি। মোগলরা বারবার আক্রমণ করেও এ দুর্গের পতন ঘটাতে পারেনি। এখনো দুর্গের ভিতরে উঁচু একটি টিলার মতো ঢিবি দাঁড়িয়ে আছে যেখান থেকে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে কামান দাগানো হতো। এটিই বর্তমানে দুর্গের একমাত্র আকর্ষণ।
এ দুর্গের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা ঈশাখাঁ ও মোগল সেনাপতি রাজা মানসিংহের সম্মুখ যুদ্ধ। মানসিংহকে পরাজিত করেও তাকে হত্যা না করে বিরল উদারতার পরিচয় দিয়েছিলেন ঈশাখাঁ। তাঁর সৌজন্যতায় মুগ্ধ হয়ে মানসিংহ ঈশাখাঁর সঙ্গে সন্ধি করেছিলেন।
এছাড়া এগারসিন্দুর দুর্গে বহুল আলোচিত ঈশা খাঁ’র দ্বিতীয় বিবাহ মহাধুমধামে অনুষ্ঠিত হয়। সৈয়দ ইব্রাহীম মালেকুল উলামার কন্যা ও ঈশা খাঁর খালাতো বোন সৈয়দা ফাতেমা বানুকে ঈশা খাঁ প্রথমে বিবাহ করেন।
পরবর্তিতে বার ভূঁইয়া’র অন্যতম বিক্রমপুরের জমিদার চাঁদ রায়ের বাল্য বিধবা কন্যা স্বর্ণময়ীর সঙ্গে ঈশা খাঁ’র প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এ নিয়ে প্রচলিত কাহিনীটি হচ্ছে, মোগল বিরোধী প্রতিরোধ সংগ্রামের ব্যাপারে জমিদার চাঁদ রায়ের বাড়িতে শলাপরামর্শের জন্য ঈশা খাঁর যাতায়াত ছিল। বিধবা অথচ রাজকার্যে পারদর্শী স্বর্ণময়ী ওই পরামর্শ সভায় যোগ দিতেন। এভাবেই দু’জনের পরিচয় প্রেমের সম্পর্কে গড়ায়।
ঈশা খাঁ চাঁদ রায়ের কাছে বিয়ের আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব দেন। বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে উভয় পক্ষের মধ্যে মতবিরোধ হয় এবং যুদ্ধ বেধে যায়। যুদ্ধের সময় রায়নন্দিনী স্বর্ণময়ী ঈশা খাঁর নিকট সশস্ত্র রক্ষীসহ দ্রুতগামী নৌকা পাঠানোর অনুরোধ জানিয়ে শ্রীমন্ত খাঁ নামে এক বিশ্বস্থ রাজ কর্মচারীকে পাঠান।
পরিকল্পনা অনুযায়ী শ্রীমন্ত খাঁর সাথে ‘কোটিশ্বরের’ মন্দিরে পূজা দেওয়ার ছল করে স্বর্ণময়ী নৌকাযোগে প্রথমে সোনারগাঁও এবং পরে এগারসিন্দুরে এসে পৌঁছান। এদিকে যুদ্ধে চাঁদ রায় ও কেদার রায় পরাজিত হন। যুদ্ধের পর এগারসিন্দুর দুর্গে মহাধুমধামে তাঁদের বিবাহ অনুষ্ঠিত হয়। ইসলাম ধর্ম গ্রহণের পর স্বর্ণময়ীর নাম রাখা হয় অলী নিয়ামৎ খানম।
দুর্গের পাশেই রয়েছে বিশালায়তনের বেবুদ রাজার দীঘি এবং প্রাচীন দু’টি মসজিদ। বেবুদ রাজা প্রজাদের জলকষ্ট দূর করতে ৫০ একর জমির ওপর একটি দীঘি করেছিলেন। এর পানি এখনো খুব স্বচ্ছ। এর তিন পাশে সবুজ গাছাগাছালির কারণে পুকুরটিকে আরো সুন্দর দেখায়। এর স্বচ্ছ জলে যখন গাছের ছায়া পড়ে তখন আশপাশ যেন আরো সুন্দর হয়ে ফুটে থাকে।
প্রাচীন মসজিদ দু’টির মধ্যে শাহ মাহমুদের মসজিদ, ভিটা ও বালাখানা পুরাকীর্তির অনন্য নিদর্শন। একটি পুকুরও আছে মসজিদের সামনে। ১৬০০ সালের দিকে এটি নির্মিত হয়েছিল। এর প্রধান বিশেষত্ব হলো প্রবেশদ্বারটি ঠিক দোচালা ঘরের আদলে তৈরি করা। এটিই বালাখানা নামে পরিচিত। বালাখানার জন্য মসজিদটির সৌন্দর্য বহুগুণে বেড়েছে।
বর্গাকৃতির এ মসজিদটির প্রত্যেক বাহু ৩২ ফুট দীর্ঘ। ৪ কোণায় ৮টি কোণাকার বুরুজ দ্বারা মজবুত করা হয়েছে। বুরুজগুলো কয়েকটি স্তরে বিভক্ত এবং প্রতিটি বুরুজের শীর্ষে ছোট গম্বুজ রয়েছে। মসজিদে বিরাট আকৃতির একটি গম্বুজ রয়েছে এবং গম্বুজটির শীর্ষে কলসাকৃতির চূড়া রয়েছে। ভেতরে পশ্চিমের দেয়ালে ৩টি মেহরাব রয়েছে।
সম্রাট শাহজাহানের রাজত্বকালে ১৬৫২ সালে অপূর্ব সুন্দর সাদী মসজিদটি নির্মিত হয়। পোড়ামাটির অলঙ্করণসমৃদ্ধ ইটের তৈরি ছোট এই মসজিদটি দেখার মতো একটি জিনিস। এ ধরনের টেরাকোটা মসজিদ খুব একটা চোখে পড়ে না। বর্গাকৃতির এই মসজিদটির প্রতিটি বাহু ২৭ ফুট দীর্ঘ। মসজিদটি ১ গম্বুজ বিশিষ্ট। ৪ কোণায় ৪টি বুরুজ রয়েছে এবং প্রতিটি বুরুজের শীর্ষে গম্বুজ রয়েছে।
মসজিদের পূর্বদিকের দেয়ালে ছোট-বড় ৩টি এবং উত্তর ও দক্ষিণ দেয়ালে ১টি করে প্রবেশদ্বার রয়েছে। ভেতরে ৩টি মেহরাবই অপূর্ব সুন্দর। মূল মেহরাবটি অপেক্ষাকৃত বড় এবং পোড়ামাটির চিত্র ফলকের সাহায্যে সুনিপুণভাবে অলংকৃত। মসজিদের প্রধান প্রবেশদ্বারের মাথায় আরবী ও ফার্সি ভাষায় লিখিত ১টি শিলালিপি রয়েছে।
এ গ্রামে আরো কিছু ঐতিহাসিক স্থাপত্য নিদর্শন আছে তার মধ্যে নিরগীন শাহ ও শাহ গরীবউল্লাহর মাজার, অধিকারী মঠ, মঠখলা কালী মন্দির, দেওল মন্দির, নীলকরের কুঠি উল্লেখ করার মতো। তাছাড়া ছোট ছোট মাটির ঘরে থরে থরে সাজানো গ্রামের শ্যামলসবুজ ছায়াঘেরা শান্ত পরিবেশের দূর্নিবার আকর্ষণ তো রয়েছেইপাকুন্দিয়া উপজেলা সদর থেকে প্রায় আট কিলোমিটার দূরে এগারসিন্দুর। গ্রামের নামেই পাকুন্দিয়ার এই ইউনিয়নের নাম। এখানে রয়েছে এগারসিন্দুর দুর্গ যেটি দখল করে কৌশলগত অবস্থান নিয়ে বীর ঈশাখাঁ মোগলদের সঙ্গে যুদ্ধবিগ্রহ করেছিলেন। লাল মাটি, সবুজ গাছগাছালি আর ঐতিহাসিক নিদর্শনে সমৃদ্ধ এগারসিন্দুর। এটি ছিল ঈশা খাঁর শক্ত ঘাঁটি।
সম্পাদক : মোঃ কবির নেওয়াজ রাজ, E-mail: mkprotidin@gmail.com, Contact: (+88) 01643-565087, 01922-619387; Mailing Address: House# 4/A, Main Road, Ati Model Town, Ati, Keraniganj, Dhaka-1312
© All rights reserved © MKProtidin.Com