৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসে আমরা বাংলাদেশসহ বিশ্বের সব নারীকে অভিনন্দন জানাচ্ছি। বাংলাদেশে কয়েক দশক ধরে সমাজ ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধির যে ধারা চলছে, তা আগামী দিনগুলোয় আরও বেগবান হবে—আজকের দিনে আমরা এই শুভকামনা করি।
দীর্ঘ ও অবিরাম সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের নারীসমাজ ধীরে ধীরে সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে; তবে অত্যন্ত জটিল ও পুরোনো অনেক সমস্যা দূর করার ক্ষেত্রে এখনো বিভিন্ন গুরুতর প্রতিবন্ধকতা রয়ে গেছে। সেসবের মধ্যে সবচেয়ে গুরুতর হলো নারীর প্রতি সমাজের সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গি, যার ফলে নারীর রাজনৈতিক, সামাজিক ও মানবিক অধিকারগুলো বাস্তবায়ন দুরূহ বলে প্রতিভাত হচ্ছে। নাগরিক হিসেবে পুরুষের সমান অধিকার থাকা সত্ত্বেও নারীরা অনেক ক্ষেত্রে বঞ্চিত হচ্ছেন; নারী সহিংস অপরাধের শিকার হলে তার যথাযথ প্রতিকার পাওয়ার আইনি বিধান ও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও ধর্ষণ থেকে শুরু করে অন্যান্য সহিংসতার শিকার নারীদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা যায়নি। বিশেষত, ধর্ষণের অপরাধ আদালতে প্রমাণ করার ক্ষেত্রে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসহ সমাজের ক্ষমতাবান ও প্রভাবশালীদের পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি বাধা হিসেবে কাজ করে। ধর্ষণের শিকার নারীর ব্যক্তিগত চরিত্র সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ ও প্রকাশ করার অতি আপত্তিকর প্রবণতা আইনের যথাযথ প্রয়োগে বিঘ্ন ঘটায়। ধর্ষণ, ধর্ষণের পরে খুন ছাড়াও আমাদের নারীদের ওপর নানা ধরনের সহিংসতা চলছে। ৮৭ শতাংশ নারী নিজের ঘরেই নিগ্রহের শিকার; গণপরিবহনে যৌন নিপীড়নের শিকার ৯৪ শতাংশ নারী।
নারীর নিরাপত্তার অবস্থা যখন এমন হতাশাব্যঞ্জক, তখন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডসহ নানা ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে—এটা সার্বিক বিবেচনায় কতটা অগ্রগতি, তা ভেবে দেখার বিষয়। তা ছাড়া অধিকার ভোগের ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের বৈষম্য এখনো রয়ে গেছে পারিবারিক ও উত্তরাধিকার আইনে। নারী উন্নয়ন নীতি ঘোষণা করা হয়েছে, তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
একটি গুরুতর সমস্যা বাল্যবিবাহ; এটা সারা পৃথিবীতে কমছে, কিন্তু বাংলাদেশে বাড়ছে। ইউনিসেফ বলছে, বাংলাদেশে বাল্যবিবাহের হার ৫৯ শতাংশ, কিন্তু সরকার বলছে ৫২ শতাংশের বেশি নয়। সেটা যা–ই হোক, বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনে বয়সের সীমা বিশেষ ক্ষেত্রে শিথিল করার ফল নেতিবাচক হচ্ছে। নারীর বিয়ের বয়স কোনো অবস্থাতেই ১৮ বছরের নিচে হওয়া উচিত নয়।
শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও আর্থসামাজিক কর্মকাণ্ডে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদেও তাঁরা অধিষ্ঠিত। স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলোয় নারী প্রতিনিধিত্ব বেড়েছে। কিন্তু আমরা যদি ঘরে-বাইরে তাঁদের নিরাপত্তাই দিতে না পারি, তাহলে এই সংখ্যা বৃদ্ধি কিংবা রাজনীতির শীর্ষ পদে নারীর অবস্থান দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে, আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে দৃশ্যমান পরিবর্তন আনবে না।
এ বছরের আন্তর্জাতিক নারী দিবসের প্রতিপাদ্য, ‘ভাবি সমান, হই চৌকস, বদলাই নতুনে’ (থিংক ইক্যুয়াল, বিল্ড স্মার্ট, ইনোভেট ফর চেঞ্জ)। নারী ও পুরুষ সমান নাগরিক, সমান মানুষ—এটা শুধু স্লোগানই নয়, মানবসভ্যতার শোভন অগ্রগতির প্রাথমিক শর্ত। সমানভাবে ভাবলেই সমাজের চৌকসভাবে এগিয়ে চলার পথ প্রশস্ত হতে পারে, সমাজবদলের জন্য নতুন নতুন উদ্ভাবনের জানালা খুলে যেতে পারে। চাই শিক্ষা ও সংস্কৃতির জাগরণ, যা আমাদের সমাজকে সব ধরনের অন্ধত্ব, অনাচার ও কূপমণ্ডূকতা থেকে মুক্ত করে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে, যেখানে নারী-পুরুষের কোনো বৈষম্য থাকবে না। নারী নিজেকে অসহায় বা দুর্বল ভাববেন না।
কবি লিখেছেন, ‘বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর/ অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’জনগোষ্ঠীর সেই অর্ধেক অংশকে পেছনে ফেলে রেখে আমরা কি সামনে এগিয়ে যেতে পারি?
সূত্রঃ প্রথম আলো
সম্পাদক : মোঃ কবির নেওয়াজ রাজ, E-mail: mkprotidin@gmail.com, Contact: (+88) 01643-565087, 01922-619387; Mailing Address: House# 4/A, Main Road, Ati Model Town, Ati, Keraniganj, Dhaka-1312
© All rights reserved © MKProtidin.Com