সম্পাদকীয়

ভালোবাসা, সহমর্মিতা ও সাম্যের আলোয় গড়া হোক নতুন মানবিক বাংলাদেশ

ভালোবাসা, সহমর্মিতা ও সাম্যের আলোয় গড়া হোক নতুন মানবিক বাংলাদেশ

মোহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন : মানবিকতা একটি জাতির সভ্যতার সর্বোচ্চ মাপকাঠি। কেবল প্রযুক্তি, অবকাঠামো বা অর্থনৈতিক অগ্রগতি কোনো দেশকে উন্নত করে না—বরং মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা, সহানুভূতি ও ভালোবাসা না থাকলে সে উন্নয়ন নিস্ফল থেকে যায়। একটি মানবিক সমাজ গড়ে তুলতে হলে আগে মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখতে শিখতে হবে। উন্নয়ন তখনই টেকসই হয়, যখন তার ভেতর মানবিকতার আলো থাকে। তাই আজ সময়ের দাবি—একটি মানবিক বাংলাদেশ গড়া।

মানবিকতা মানে কেবল দয়া বা সহানুভূতি নয়; বরং এটি হলো মানুষে মানুষে শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, সহনশীলতা ও সহযোগিতার এক অবিচ্ছেদ্য বন্ধন। ধর্ম, বর্ণ, ভাষা বা রাজনৈতিক মতভেদ ভুলে সবাইকে মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন করাই মানবিকতার প্রকৃত রূপ।

সব ধর্মেই মানবিকতার শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। ইসলাম বলে, “যে ব্যক্তি একজন মানুষকে বাঁচায়, সে যেন সমগ্র মানবজাতিকে বাঁচাল।” অন্যান্য ধর্মও একইভাবে মানুষে মানুষে ভালোবাসা ও শান্তির বার্তা দেয়। তাই মানবিক বাংলাদেশ মানে ধর্মীয় মূল্যবোধের বাস্তব প্রয়োগ।

শুধু গণতন্ত্র বা অর্থনৈতিক উন্নয়ন নয়, প্রয়োজন এমন একটি বাংলাদেশ—যেখানে থাকবে মানুষের প্রতি ভালোবাসা, সহমর্মিতা ও মানবিক মূল্যবোধ। এমন একটি দেশে কেউ বেকার থাকবে না, নারী হবে নিরাপদ, থাকবে না মিথ্যা, প্রতারণা বা অসম্মানের সংস্কৃতি।


🌿 শিক্ষা ও মূল্যবোধের পুনরুজ্জীবন

একটি মানবিক বাংলাদেশ গড়তে হলে শিক্ষাব্যবস্থায় নৈতিক শিক্ষাকে গুরুত্ব দিতে হবে। শিক্ষাকে রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, মানবিক চেতনার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে হবে। সমাজে যে নৈতিক অবক্ষয় ও আত্মকেন্দ্রিকতার প্রবণতা বেড়ে চলেছে, তা রোধে সামাজিক মূল্যবোধকে ফিরিয়ে আনতে হবে।
শিশুদের ছোটবেলা থেকেই সত্যবাদিতা, শ্রদ্ধা, সহানুভূতি, দায়িত্ববোধ ও মানবিকতা শেখাতে হবে। অভিভাবক ও পরিবারকে হতে হবে নৈতিকতার জীবন্ত উদাহরণ। একইসাথে গণমাধ্যমকেও মানবিকতা বৃদ্ধিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে হবে।


⚖️ রাষ্ট্রের দায়িত্ব ও স্বাধীনতার চেতনা

বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে জনগণের জন্য “সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার” প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। সেটিই একটি মানবিক রাষ্ট্রের ভিত্তি। রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো নাগরিকের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকার সমানভাবে নিশ্চিত করা।

সাম্য না থাকলে সমাজের ভারসাম্য নষ্ট হয়। দীর্ঘ অপশাসন ও বৈষম্যের কারণে আজ সমাজে অস্থিরতা ও উগ্রতার জন্ম হয়েছে। তাই এখন সময়—স্বাধীনতার চেতনায় ফিরে গিয়ে সাম্য, ন্যায় ও মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার।


জনগণের অধিকার ও গণঅভ্যুত্থান

ইতিহাস সাক্ষী, জনগণের অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রে গণঅভ্যুত্থান ছিল শক্তিশালী মাধ্যম। আমেরিকান চিন্তাবিদ নোয়াম চমস্কি বলেছেন, “যখন একটি সরকার জনগণের মৌলিক চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হয়, তখন গণঅভ্যুত্থান অনিবার্য হয়ে ওঠে।”
তবে গণঅভ্যুত্থানকে সাফল্যের দিকে নিতে হলে প্রয়োজন সঠিক নেতৃত্ব ও জনসমর্থন। অন্যথায় তা বিশৃঙ্খলায় পর্যবসিত হতে পারে।


🌏 মানবিক ও পরিবেশবান্ধব রাষ্ট্রের স্বপ্ন

ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা ভেবে মানবিক রাষ্ট্র গঠনে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োজন। রাষ্ট্রের দায়িত্ব কেবল নাগরিকের নিরাপত্তা নয়, পরিবেশ, মাটি, পানি ও বাতাসের ভারসাম্য রক্ষা করাও সমান জরুরি।
একটি মানবিক রাষ্ট্র মানে এমন রাষ্ট্র, যেখানে প্রকৃতি ও মানুষ উভয়ই নিরাপদ থাকবে।


🤝 আমাদের করণীয়

মানবিক বাংলাদেশ গড়ার দায়িত্ব শুধু রাষ্ট্রের নয়, বরং আমাদের প্রত্যেকের।
দুর্নীতি, বৈষম্য ও অমানবিক আচরণের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
প্রয়োজন স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, আইনের শাসন এবং দুর্বল জনগোষ্ঠীর অধিকার রক্ষায় সক্রিয় ভূমিকা।

সংখ্যালঘু বা পাহাড়ি-বাঙালি বিভাজন ভুলে সবাইকে এক মানবিক পরিবারের সদস্য হিসেবে দেখতে হবে।
দেশে প্রতিহিংসার রাজনীতি বন্ধ করে প্রতিষ্ঠা করতে হবে সুশাসন, সাম্য ও ন্যায়বিচার


🌺 উপসংহার

আমরা চাই এমন এক বাংলাদেশ—
যেখানে প্রতিটি মানুষ সম্মানের সাথে বাঁচবে,
নারী-পুরুষ, ধনী-গরিব, শিশু-বৃদ্ধ সবাই সমান মর্যাদায় উন্নয়নের স্রোতে ভাসবে।
যেখানে থাকবে ভালোবাসা, সহানুভূতি ও সাম্যের আলো—
সেই বাংলাদেশই হবে প্রকৃত মানবিক বাংলাদেশ।