আমাদের জমানায় বাবা মা সন্তানের সাথে সন্মানজনক দূরত্ব বজায় রাখতেন ! আদর -স্নেহ -আবদার -আহ্লাদ সবই ছিল তবে কোথায় যেন একটা আড়াল ছিলো ! ঠিক যেন, হেমন্ত মুখার্জির গানের মতো -
সব কথা বলা হলো বাকী রয়ে গেল শুধু বলিতে
সব কথা শোনা হলো বাকী রয়ে গেলো শুধু শুনিতে!
সব বললেও সব বলা যেত না, একটু ফাঁক রয়ে যেত ! সেই ফাঁকটুকুই বিরাট ফাঁকি ! কারণ , দিনশেষে তারা বন্ধু ছিলেন না -ছিলেন অভিভাবক!
ক্লাস এইট থেকে টেন -ভিকারুননিসা নুন সকুলে এই তিনটি বছর জানের দোস্ত টাইপের বন্ধু ছিলো ! এসএসসি পরীক্ষার রেজাল্টের পর কেমন যেন অল্প অল্প পাল্টানো শুরু করলো বন্ধুত্ব! পুরাই পল্টি নিলো যখন এইচএসসির পর কেউ মেডিকেলে, কেউ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলো আবার কেউ কোথাও এডমিশন টেস্টে টিকলো না ! এখন তারা কেউ যেন কারও বন্ধু নয়- তারা পরস্পর প্রতিদ্বন্দ্বী!
মেডিকেল কলেজে ভর্তির দিনই মা বলে দিলেন - খবরদার, ছেলেদের সাথে মিশবা না- মোম আর আগুন কখনও বন্ধু হয়না !
আমি আম্মাজানের কথা বিশ্বাসে করলাম না আবার পুরোপুরি অবিশ্বাসও করলাম না! পরবর্তীতে দেখলাম, প্রথম অবস্থায় বন্ধুভাব দেখালেও ক’দিন যেতে না যেতেই তারা মোমের মতো গলে গলে পরছে !
মেডিক্যাল কলেজে একসাথে আইটেমের পড়া তৈরি করতে করতে আর কেন্টিনে ভেজিটেবল রোলে কামড় বসাতে গিয়ে কেউ কেউ বান্ধবী হয়েছিলো বটে তবে বিয়ের পর সবাই ওমুকের বউ আর তমুকের পুত্রবধূ হয়ে গেল ! বন্ধুত্বের মোড়কে সামাজিক মর্যাদার রেষারেষি! কার শ্বশুরবাড়ি কতটা বনেদী, কার স্বামী কতটা হ্যান্ডসাম ,কার দেনমোহর কতটা ভারী - এসব দমবন্ধ করা আলাপে বন্ধুত্বের বিলোপ ঘটলো !
সংসারজীবনে ঢুকে বন্ধুত্ব মেইনটেইন করা কঠিন ! বন্ধুদের সময় দেয়ার মতো সময় কই ??? আমার নানী বলতেন, “ঘর জ্বালানি পর ভুলানি “মেয়েদেরই শুধু বন্ধু বান্ধব থাকে ! সংসারকে স্বর্গ বানাতে হলে বন্ধু বান্ধবীদের সংসর্গ ত্যাগ করতে হবে !
বিয়ের পর স্বামীই নাকি মেয়েদের বন্ধু!
বন্ধু তো তারাই যারা সিংগাড়ার বিল ভাগাভাগি করে দেবে, একদিন সিনেপ্লেক্সে একজন মুভি দেখালে পরেরদিন চাইনিজ রেস্টুরেন্টের বিল আরেকজন দিবে !
অধিকাংশ মেয়েরা যেখানে নিজেরা স্বনির্ভর হলেও ভরণপোষণের ব্যপারে স্বামীর উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল সেখানে স্বামী বন্ধু ভাবাপন্ন হলেও বন্ধু নন ! তারা প্রচ্ছন্নভাবে অভিভাবক!!!
আমার স্বামী কায়েস সাহেব বলেন, তোমার বন্ধুর দরকার কি ? আমিই তোমার বন্ধু! বিপদে আপদে একমাত্র আমি ছাড়া কাকে পাশে পাবে ???
যিনি ঠিকানা দেন - তিনি সর্বদাই সঠিক!
তবুও আমি মাথা নেড়ে বলি , কিন্তু-
কিন্তু কি ?!
আমি কিন্তুটাকে নদীতে ফেলি !
প্রতিটি নারী তার অন্তরে একটি গভীর খরস্রোতা নদী লালন করে! সেই নদীতে পলির মতো জমে আছে কতশত না বলা কথা !
নদীটাই নারীর একমাত্র বন্ধু!
পুরো জীবনে তার কোন বন্ধু হয়না !!!