কবিরা মানুষের জীবনের ছবি আঁকেন। ভালোবাসার আকাশ বোনেন। সুন্দর পৃথিবী গড়ার স্বপ্ন জাগিয়ে তোলেন কালের কপোলতলে। নজরুলও তেমনি এক প্রতিভাবময় শিল্পী। সাম্য, প্রেম ও মানবতার কবি। প্রেম সমুদ্রের তরঙ্গমালা তার হৃদয়ে বহমান। এ প্রেম মহা জাগতিক। চিরন্তন প্রেমের অনির্বাণ শিখায় কবিহৃদয় বলীয়ান। মানুষের স্বাধীনতা মুক্তিই তার লক্ষ্য। তার শক্তি দুর্জয় দুর্বাব। কারো সাধ্য নেই সামনে দাঁড়াবার। উন্নত শিরে গেয়েছেন মানুষের জয়গান। এ মহাবিশ্বসৃষ্টির মূলে মানুষের প্রতি স্র্রষ্টার ভালোবাসা। রষ্টার প্রতি নিবেদন সমর্পণ কবিহৃদয়ে চিরন্তন প্রেমের বান বয়ে যায়। আলোকিত মননে অনুরণিত হয় প্রেমের ঝংকার। কবিতার শরীর প্রাণ আধ্যাত্মিক নান্দনিকতায় ভরে ওঠে। শিল্পীত হয় নব জীবনের হাতছানি। অনাবিল আনন্দের অনুভূতি উচ্চারিত হয় কবির কণ্ঠে-
আল্লা পরম প্রিয়তম মোর, আল্লা ত দূরে নয়,
নিত্য আমারে জড়াইয়া থাকে পরম সে প্রেমময়!
মানুষ কল্পলোকের ডানায় উড়ে বেড়ায় দিগন্তপাণে। এর গতি অসীম। বিশ্বজগৎ ভ্রমণ শেষ হয়ে যায় এক নিমিষে। শিল্পীরা মানুষের কল্পরাজ্যের ডানা বিস্তারিত করেন। নজরুলের কল্পনার আকাশ যেমন বিশাল মানুষের প্রতি ভালোবাসাও তেমনি প্রবল। অন্তরের গহিনে সুপ্ত প্রেম জাগরিত হয় তার কবিতায়-গানে। মানুষের মনেও সঞ্চারিত হয় সে গানের আভা। প্রেমের চিরায়ত অনুরাগ। মনোলোক উদ্ভাসিত হয় অপার্থিব স্ন্দুরের আকর্ষণে। আত্মায় প্রশান্তি অনুভূত হয়। মহাসত্যের সান্নিধ্য লাভের আকাক্সক্ষা তীব্রতা পায়-
পরম নিত্য পরম পূর্ণ টানে মোরে নিশিদিন,
আমি তাই অপরাজেয় সর্ব্বভয় ও মৃতুহীন!
মানুষের জীবনের মূলে রয়েছে প্রেম। প্রেমের স্পর্শে জীবন গতিশীল। প্রেম সুনির্দিষ্ট বলয়ে আবদ্ধ নয়। বৈষয়িক প্রেম সাময়িক সহজেই নির্বাপিত হয়ে যায়। ঐশ্বরিক প্রেমের শিখা চিরন্তন। চিরায়ত প্রেমের বহ্নিশিখায় প্রোজ্জ্বল কবি নজরুল। এ প্রেম পৃথিবীর সব মানুষের তরে। তার এ যুদ্ধ বিশ্বময় মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে। ধরণীর সব নিপীড়িত মানুষের তরে নজরুলের বিদ্রোহ। মানুষের মর্যাদা সর্বোচ্চে। রাষ্ট্র, শাসক মানুষের ওপর অত্যাচার নিপীড়ন চালাতে পারে না। মানুষের অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে কবি দৃৃঢ় প্রতিজ্ঞ। অবসর নেই কোনো বিশ্রামের। অনাবিল প্রেমের পরশই কবির শক্তিমূল। মানুষের হৃদয়েও এ প্রেমের জ্যোতি বিচ্ছুরিত করেন কবি-
মানুষ আবার তাঁর প্রেমে নেয়ে চিরপবিত্র হোক
জ্বিনের দুনিয়া লভুক আবার জান্নাতের আলোক।
পরম সৌন্দর্যে মিলনের দুর্নিবার আকাক্সক্ষায় মানুষের মনপ্রাণ ব্যাকুল হয়ে ওঠে। বাঁশির সুরে হৃদয় আলোড়িত হয়। এ অপার্থিব বিরহ-বেদনার কোনো তুলনা নেই। আত্মার আর্তনাদে আকাশ বাতাস মুখরিত। ধীরে ধীরে পার্থিব সব ভালোলাগা গৌণ রূপে আবির্ভূত হয়। পরম সত্তায় মিলনের বাসনায় হৃদয় আকর্ষিত হয়। এ আকর্ষণ ক্রমেই বৃদ্ধি পেতে থাকে। সৃষ্টি রহস্যের পর্দা একে একে উন্মোচিত হয়ে যায়। প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের অন্তরালে তাঁরই ভালোবাসার নিদর্শন ফোটে ওঠে। মননে পরম সত্তার অস্তিত্ব অনুভ‚ত হয়। কবির দৃষ্টিতে চিরন্তন প্রেমের ফল্গুধারাই পারে ধরণীকে বানাতে প্রেমের স্বর্গ শান্তির আবাস। গভীর ভালোবাসায় হৃদয়প্রাণ প্রশান্তিতে ভরে ওঠে-
তাঁরি নাম লয়ে বলি, “বিশ্বের অবিশ্বাসীরা শোনো,
তাঁর সাথে ভাব হয় যার, তার অভাবে থাকে না কোনো।”
তাঁহারি কৃপায় তাঁরে ভালবেসো ব’লে আমি চ’লে যাই,
তাঁরে যে পেয়েছে, দুনিয়ায় তার কোনো চাওয়া-পাওয়া নাই।
অনাবিল প্রেমের নিরন্তর আকর্ষণে বৈষয়িক ভাবনাগুলো আকাশে বাতাসে মিশে যায়। ঐশ্বরিক প্রেমের রসহ্যময় দিগন্ত একে একে খুলতে থাকে। বিস্ময়কর সৃষ্টিজগতের প্রতি দৃষ্টি নিপতিত হয়। আকাশের নীলিমা পাখির কলতানি সমুদ্রের তরঙ্গমালা সর্বত্রই পরম প্রেমের ঝংকার হৃদয়কে আন্দোলিত করে। নিপূণ কারিগরের শৈল্পিক সৌন্দর্যের আভায় মনোলোক দ্বীপ্তমান হয়ে ওঠে। পরম সত্তার পর্দা উন্মোচিত করার বাসনা প্রবল হতে থাকে। ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়। দুর্গম গিরিপথ পাহাড় পর্বতও সমতল ভ‚মি মনে হয়। আকাশ মহাকাশের ব্যবধান তুচ্ছ হয়ে যায়। প্রেমের অনাবিল পরশে দুর্বার সাহস হৃদয়ে সঞ্চারিত হয়-
দুর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার
লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশিথে যাত্রীরা হুশিয়ার।
কবিদের কাছে ভাষা কাল দেশ খুবই গৌণ, ভাবের সম্মিলনই মূখ্য। একজন কবি প্রাণিত হন পৃথিবীর অন্য প্রান্তের কবিপ্রতিভার অনলস্পর্শে। নজরুলও ফারসি কবিতার পরশে সিক্ত। তার কল্পরাজ্যে নব দিগন্ত উন্মোচিত হয়। হাফিজ রুমি খৈয়াম সাদির কবিতার প্রভাবে নজরুলের মনোলোকে নতুন ভুবন তৈরি হয়। ভাব ভাষা চেতনার বোধিতে নব প্রাণের সঞ্চার ঘটে। ঐশ্বরিক চেতনায় মনপ্রাণ বিগলিত হয়। নতুন নতুন বাগানের সৌরভে হৃদয় আলোড়িত হয়। বাংলা সাহিত্যও মোহিত হয় এ পুস্পের সুরভিতে। ফারসি কবিতার বাংলায়নে অতুলনীয় শৈল্পিক গুণে ভ‚ষিত নজরুল। হাফিজের গজল ফারসি ছন্দরীতি অনুসরণে অনুবাদ নজরুলের অমর সৃষ্টি। সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজমশহের আমন্ত্রণে হাফিজ সাড়া না দিলেও নজরুলের হৃদয়নিংড়ানো ভালোবাসা তিনি উপেক্ষা করতে পারেননি। নজরুলই হাফিজকে সর্বপ্রথম বাংলায় নিয়ে আসেন। কবির কলিজার ধন বুলবুলের চিরবিদায়লগ্নে সমাধিযাত্রার অপর প্রান্ত দিয়ে নজরুলের ঘরে প্রবেশ করেন ইরানের বুলবুল হাফিজ শিরাজি। ইরানি কবিদের প্রেমময় আবেগের উচ্ছাস ঝড়ে পড়ে নজরুলের কবিতায়। রুবাইয়াতে খৈয়ামের বাংলায় কাব্যানুবাদ আজও সাহিত্যভুবনের মহাবিস্ময়।
মানুষ স্রষ্টারই তেজে উদ্দীপ্ত। শক্তিমান। দুর্জয়। মানুষের শির চির উন্নত। সত্য প্রেমের সৌরভে মোহিত মানুষ কারো সামনে মাথা নত করতে পারে না। এ যে মানুষের অসম্মান অপমান। সাম্যের পৃথিবী গড়ার নেশায় উজ্জীবিত কবি ধুমকেতুর মতো দুর্বার গতিশীল। রাষ্ট্রশক্তি, রাজরোষ এ গতির সামনে খুবই তুচ্ছ। স্থিরতা তার ধর্ম নয়। গতিই তার প্রকৃত স্বরূপ। সব অসত্যের বিনাশই তার একমাত্র লক্ষ্য। একত্ববাদের মর্মবাণীই পৃথিবীর অমানিশা দুর করতে সক্ষম। বিশ্বময় অশান্তির মূলে মানুষের গোলামি অংশীদারিত্ব। কবি সারা বিশে^র মানুষের মুক্তির জন্য গেয়েছেন সাম্য, শান্তির জয়গান-
জাতিতে জাতিতে মানুষে মানুষে অন্ধকারের এ ভেদ জ্ঞান,
অভেদ ‘আহাদ’-মন্ত্রে টুটিবে সকলে হইবে এক সমান।
মানবতার সম্মান মর্যাদা নিহিত পরম সত্তার প্রতি আত্মসমর্পণের মাঝে। স্রষ্টার বিধান তথা ইসলামের সৌন্দর্য শাশ্বত চিরন্তন। মানবমনের স্বভাবপ্রকৃতির সাথে সঙ্গতিশীল। মানবদেহের সবই স্রষ্টার নির্দেশের অধীন। বিশ্ব প্রকৃতিও তাঁরই নিয়মাধীন। ব্যত্যয় ঘটানোর ক্ষমতা কারো নেই। শুধু মানুষেরই রয়েছে ইচ্ছার স্বাধীনতা ও বিবেকের দায়। মানুষ এ দায় ভুলে গিয়ে প্রকাশ্যে অপ্রকাশ্যে অপরের ওপর চালায় নিজের কর্তৃত্ব। এমনি অপরকে দাসে পরিণত করতেও কুণ্ঠিত নয়। মানবতার বন্ধু মহানবি সা. দাসপ্রথার বিলুপ্তি ঘটিয়ে মানুষের মর্যাদাকেই সমুন্নত করেছেন। প্রকৃতপক্ষে মানুষ একমাত্র মহান আল্লাহরই দাস; অন্য কারো নয়। এ চিরন্তন বিধানই সুখ সমৃদ্ধি নিশ্চিৎ করতে পারে বিশ্বময়। সাম্য শান্তির অমীয় বাণীর গতিধারা বহমান নজরুলের হৃদয়ে। কবিতার ছন্দে ছন্দে বেজে ওঠে সুন্দর পৃথবী গড়ার স্বপ্ন-
অন্যেরে দাস করিতে কিংবা নিজে দাস হ’তে ওরে
আসেনিক দুনিয়ায় মুসলিম, ভুলিলি কেমন ক’রে?
ভাঙ্গিতে সকল কারাগার, সব বন্ধন ভয় লাজ
এল যে কোরান, এলেন যে নবী, ভুলিলি সে সব আজ?
প্রকৃতির বৈচিত্র্যময় শোভা স্রষ্টারই নিদর্শন। কবিপ্রতিভাও তাঁর বিশেষ সৃষ্টিনৈপূণ্যের চিহ্নবহ। প্রকৃতি মানুষকে তার সৌরভে মোহিত করে অকাতরে। ধনী-গরীব, রাজা-প্রজা, সাদা-কালো কোনো ভেদাভেদ নেই। কবিতার আকাশও সব মানুষের জন্য অবারিত। তাদের রচনায় সিক্ত হয় মানুষের হৃদয়জগৎ। নজরুলের কবিতাও প্রকৃতির মতো বিশাল উদার। প্রকৃতির অপরূপ মনোহরী চিত্র অঙ্কিত হয় তার কাব্যকলায়। কবিতা হয়ে ওঠে শ্রেষ্ঠ শিল্পকর্ম। শিল্পীর নিপূণতায় প্রকৃতির রূপময়তা ফোটে ওঠে সাবলীলভাবে। কবির ভাষায়-
তাঁর সৃষ্টির উদার আকাশ সকলেরে থাকে ঘিরে,
তাঁর বায়ু মসজিদে মন্দিরে সকলের ঘরে ফিরে।
তাঁহার চন্দ্র সূর্যের আলো করে না ধর্ম ভেদ,
সর্ব জাতির ঘরে আসে, কই আনে না তো বিচ্ছেদ!
মহাবিশ্বের সৃষ্টি রহস্যময়। বিশেষ উদ্দেশ্য রূপায়িত এই বিশ্বচরাচর। সত্য সুন্দর ন্যায়ের শাশ্বত প্রেমময় ভাবনারই ফসল মানুষ। সত্যের সাথে মানুষের সম্পর্ক নিবিড়। মহাবিশ্বের সবই মানুষের কল্যাণের তরে নিবেদিত। সত্য ন্যায়ের গৌরবগাঁথা উচ্চকিত করতেই আবির্ভাব ঘটে মহামানবের। যাদের কণ্ঠে ঝংকৃত হয় স্রষ্টার বীণা। এ বীণা স্রষ্টাই তাদের হৃদয়ে উত্থিত করেন। এ ভাবের উচ্ছাস পরম সত্তার মৌলচিন্তারই বহিঃপ্রকাশ। সাধনা অধ্যবসায়ের ফসল নয়। মানুষের প্রতি প্রবল মমত্ববোধ এ ভাবনাকে আত্মিক শক্তিতে বলীয়ান করে তোলে। সুন্দরের পথে সংগ্রামী নজরুল আসামীর কাঠগড়ায়। রাজবন্দীর জবানবন্দিতে নজরুল দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে এ সত্য উচ্চারণ করেন। এ কাঠগড়ায় দণ্ডায়মান আসামী কবি নিজে নন; কবিকণ্ঠের যিনি সুরবাদক, যিনি ভাবনার যোগদানদাতা তিনিই এ মঞ্চে আসীন। মানুষের ¯্রষ্টার ধ্বনিই তার কণ্ঠে বেঝে উঠছে আপন মহিমায়। আজ একজনের কণ্ঠে তা উচ্চকিত কালের কপোলতলে তা অন্য কারো কণ্ঠে নিঃসৃত হবে। কবি বিশ্বময় নিপীড়িত মানুষের প্রতিনিধি। সত্য ন্যায়ের অগ্রসেনানি। এ অভিযাত্রা ততদিন থাকবে বহমান যতদিন পৃথিবীর আনাচে কানাচে ধ্বনিত হবে না নির্যাতিতের আর্তনাদ। যে আর্তচিৎকারে ভারি হয়ে উঠবে না পৃথিবীর আকাশ-বাতাস।
নজরুলের প্রেমের আকাশ অনেক বিস্তারিত। মানুষের স্বাধীনতা, মুক্তি, প্রেম-বিরহ, স্বপ্ন ও সম্ভাবনা নিয়েই তার কল্পরাজ্য। সুন্দর এই পৃথিবীতে অসত্য অসুন্দরের রাজত্ব চলতে পারে না। মানুষে মানুষে ভেদাভেদ-পার্থক্য ভীষণ বেদনার কষ্টের। এ বেদনা খুবই তীব্র। প্রসব বেদনা যেমন চূড়ান্ত ধাপে হাস্যোজ্জ্বল সন্তান উপহার দিতে উদগ্রীব হয়ে যায়। নজরুলও তেমিনি সব অসাম্য, অভেদ, অসুন্দরের ঝঞ্ঝাট নির্মূল করে শান্তির ধরণী নির্মাণে বদ্ধপরিকর। পরম সত্তার প্রতি ভালোবাসার আত্মনিবেদনই কবিকে দুর্বার দুঃসাহসী করে তোলে। কবি নিজেকে স্রষ্টার তুর্যবাদক মনে করেন। পরম স্রষ্টারই প্রতিনিধি মানুষ। তার মর্যাদা সবকিছুর উর্দ্ধে। স্রষ্টাই মানুষকে করে তুলেছেন মহিয়ান। তাঁরই প্রেমের পরশে মহানবি সা. আকাশ মহাকাশ ভেদ করে পরম সত্তার কাছে নিজেকে সমর্পণের সৌভাগ্য লাভ করেন। তার উত্তরসুরীও একই প্রেমের বলয়ে সাত আসমান পাড়ি দিয়ে খোদার আরশ ছেদিয়া কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছাতে চায়-
বল মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি
চন্দ্র সূর্য্য গ্রহ তারা ছাড়ি
ভূলোগ দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া,
খোদার আসন আরশ ছেদিয়া
উঠিয়াছি আমি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ববিধাত্রীর!
লেখকঃ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. কামাল উদ্দিন প্রধান।