একথা স্বীকার না করলে সত্যের অপলাপ হবে যে কারাগারে প্রথম প্রথম বহুবার আমার আত্ম হননের সাঁধ জেগেছে ! এত অপমান , গ্লানি আর অপবাদের অচলায়তন পাড়ি দেবার মতো মনোবল আমার ছিলনা! কিন্তু কারাগার এমন জায়গা যেখানে চাইলেও এটা বাস্তবায়ন করা মোটামুটি অসম্ভব ! কারা কতৃপক্ষের ও কয়েদী পাহাড়াদের সারবক্ষণিক নজরদারী তো রয়েছেই !কামরাগুলোর ছাঁদ এত উঁচু যে নাগালের বাইরে – ফ্যানের সংখ্যা কম ও সেটিও স্বাভাবিকভাবেই উচুতে ! কোনপ্রকার কোন ধারালো জিনিসের ব্যবহার একেবারে নিষিদ্ধ ! এমনকি চামচ পর্যন্ত ব্যবহার করা যাবেনা! দু’দিন পর পরই ব্যপক তল্লাসির মাধ্যমে বন্দীদের কাছ থেকে রশি,দড়ি ,চামচ ,আয়না এমনকি গাছের ডাল, কনচি ইত্যাদি লুক্কায়িত থাকলেও নিয়ে গিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হতো!
বাথরুমের দরজা অর্ধেক কাটা! পয়তাল্লিশ জন – বাথরুম একটা ! বাথরুমে কোন আয়না বা বেসিনের অস্থিত্ব নেই! তারপরও, কেউ যদি সন্দেহজনক ভাবে সামান্য কিছু সময় সেখানে অতিরিক্ত কাটায় তাহলেও রুমের পাহাড়া মুখ দিয়ে অশ্রাব্য গালি বর্ষণ করতে করতে নিরদ্বিধায় দরজার উপর দিয়ে দেখে ভেতরের মানুষটি কি করছে ! মানুষটি যতটাই লজ্জাজনক অবস্থায় থাকুক না কেন পাহাড়ার বিন্দুমাত্র ভাবানতর হতো না!
উল্টো গালাগালির মাত্রা এমনভাবে বেড়ে যেত যে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেয়ার ব্যাপারটি যদি চিরতরে বন্ধ হয়ে যেত তবেই ভালো হতো !
এতকিছুর পরও নিতান্ত অসম্ভব জেনেও নিজেকে শেষ করে দেবার ইচ্ছে জেগেছে – একবার, দুবার নয়-অসংখ্যবার !
হঠাৎ একদিন কারাগারের একজন নারী বন্দীনি জমিলা বুজি অসুস্থ হলেন ! জমিলা বুজি একজন ষাট উর্ধ নারী যিনি পুত্র বধূর দেয়া যৌতুক মামলায় জেল খাটছিলেন।মেডিকেল সেন্টার থেকে আমাকে ডাকার পর পরীক্ষা করে ও ECG দেখে আমার মনে হলো MI বা সাধারন ভাবে যাকে হারট এটাক বলে সেটা ! দ্রুত তাজউদ্দিন মেডিকেলে পাঠানো হলো- চারদিন পর খবর আসলো মারা গেছে ! ময়না তদন্ত করার পর লাশ পরে আছে মর্গেই- কেউ নিতে আসেনি ! কারন, বিধবা এই নারীটির একমাত্র সন্তানও একই মামলায় জেল খাটছিলেন!
সামান্য একটু নিশ্বাস নেবার জন্য কি ভীষন আকুতি ছিলো জমিলা বুজি’র !! শেষ ক্ষণটুকুতে বারবার সে ইশারা করে জানাচ্ছিলো – বাড়ি যেতে চায় ! আগেও সে বারবার বলতো, স্বামীর ভিটেয় গিয়ে মরতে চায় ! যখন বাড়ির কথা ভাবতো, উদাস হয়ে কারাগারের উঁচু প্রাচীরের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকতো- তোবড়ানো গাল বেয়ে জল পরতো ! পাখির খাঁচার মতো হাড় জিরজিরে বুকটা হাপরের মতো ওঠানামা করতো !
তার খবরটা জানার পর শিউরে উঠলাম- না, আল্লাহ যেন এখানে আমাকে মৃত্যু না দেন ! অনন্তর পথে যাত্রা করার সময় একটা প্রিয় মুখের বেদনাতুর চোখভরা পানি যেন আমি দেখতে দেখতে যেতে পারি ! আজরাইল যখন তার চিরন্তন নির্মম রূপে আমার সামনে আবির্ভূত হবে তখন ভয়ার্ত আমার হাতের মুঠিতে কোন প্রিয়জনের উৎকন্ঠায় ঘর্মাক্ত হাতের তালু যেন লেপটে থাকে! আত্মহত্যার চিন্তা সেদিনই আমার মাথা থেকে চিরতরে দূর হয়ে গেল ! নারীটি চিরতরে ঘুমিয়ে গিয়ে আমাকে চিরতরে জাগিয়ে দিয়ে গেলেন !
বুঝে গেলাম-বাঁচার চেষ্টা করতে হবে! কি লাভ হবে আত্মহত্যা করে ? পৃথিবী তার নিজের নিয়মে চলবে, ষড়যন্ত্রকারীরা সমাজ দাপিয়ে বেড়াবে ! কেবল আমাকেই অপরাধীর তকমা নিয়ে চুপিচুপি চলে যেতে হবে ! জীবিত থাকা অবস্থায় অপপ্রচারের পর আমার চরিত্রকে যেমন ব্যবচ্ছেদ করা হয়েছে , অপমৃত্যুর পর আমার শরীরটা তেমনিভাবে ময়না তদন্ত করা হবে !!! আমি স্বেচ্ছায় কখনও তা হতে দিবনা ! কখোনো না! আমাকে বাঁচতে হবে – নিজের জন্য না হলেও -আরও অনেক সাবরিনার জন্য !
আর কখনও কোন সাবরিনা যেন স্বেচ্ছায় মরার কথা ভাবতে বাধ্য না হয় !!!
লেখকঃ ডাক্তার সাবরিনা।