সারা পৃথিবী জুড়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করা ঘাতকের নাম করোনা ভাইরাস। মানুষের সাধারণ ধারণা ছিল বাঘ, ভালুক তাড়া করলে ভয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে বাসায় ঢুকে আত্মরক্ষা করবে। কিন্তু না, এটি এমন এক শত্রু যা দেখা যায় না খালি চোখে। অথচ তারই ভয়ে সবাই মারাত্মকভাবে ভীত। অনেকটা ‘মিস্টার ইন্ডিয়া’ সিনেমার অনিল কাপুরের অদৃশ্যে থেকে ভিলেন অমরেশপুরি আর তার সাঙ্গোপাঙ্গদের শায়েস্তা করার মতো। আমরা কেউ খালি চোখে এ ঘাতককে দেখছি না অথচ একের পর এক মানুষ মারা যাচ্ছে। আজ ১৮/০৪/২০২০ তারিখ পর্যন্ত ১ লক্ষ ৬০ হাজার মানুষ মারা গেলেন এ নীরব ভয়ংকর ঘাতকের আক্রমণে।
আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ দুনিয়ার সবচেয়ে ঘনবসতির দেশ। পার্বত্য এলাকার আয়তন আর জনসংখ্যা বাদ দিয়ে বাকি ভূমি আর জনসংখ্যা দিয়ে বিভাজন করলে এ জনসংখ্যার ঘনত্ব হবে গ্রিনিচ বুকে লিখে রাখার মতো। আর নদীমাতৃক বাংলাদেশের নদীগুলোর আয়তনকে কল্পনায় বাইরে রেখে ভাবলে আমাদের দেশের ঘনত্ব অকল্পনীয়। এবার আসি মূল প্রসঙ্গ ত্রাণ নিয়ে। বাংলাদেশ সম্ভবত পৃথিবীর একমাত্র দেশ, করোনা মহামারিতে করোনাকে ছাড়িয়ে আলোচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে ত্রাণ, ত্রাণ আর ত্রাণ। আমরা কতটা অসচেতন অগোছানো দায়িত্বহীন আর জাতীয়ভাবে বিশৃঙ্খল তা বর্তমান বাংলাদেশ আর পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনামূলক চিত্র দেখলে বোঝা যায়। এই অসচেতনতা আমাদের কোথায় নিয়ে যায়, তা সময় বলে দেবে। আমার সাবেক কর্মস্থলগুলোয় যেখানে খুব ঘনিষ্ঠ অনেক মিডিয়াকর্মী রয়েছেন। অনেকের সঙ্গে আলোচনায় জানা যায় প্রথমদিকে লক ডউন বেশ ভালোভাবে কার্যকর ছিল। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ছিল যথেষ্ট কঠোর। কিন্তু কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যাপক নেতিবাচক প্রচারণায় পুলিশ খানিক নমনীয় হবার সুযোগে কিছু কিছু মানুষ বাসা থেকে বেরিয়ে আসে। তারপর যুক্ত হয় নতুন অধ্যায়—ত্রাণ বিতরণ। কখন কোথা থেকে শুরু হয়েছে এ বিতরণ বলা মুশকিল। সরকারি-বেসরকারি এ বিতরণে হাজার হাজার নারী-পুরুষ-শিশু আবালবৃদ্ধবনিতা বেরিয়ে আসতে থাকে, ফাঁকা রাস্তাঘাটগুলো কানায় কানায় পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। ত্রাণ গ্রহণে বেপরোয়া মানুষ এবার পুলিশ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও অমান্য করার সাহসে, ফাঁকিবাজি শুরু করে। হাজার হাজার জনতা প্রতিদিন ত্রাণের খোঁজে দাপিয়ে বেড়াতে থাকে রাজপথ থেকে পাড়া মহল্লা। আবার পুলিশ ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য প্রশাসনিক কর্মকর্তা সবাই মাঠে নামার পর কিছু অংশ বাসায় ফিরে যায়। অনেকেই লুকোচুরি শুরু করে। পেটের ক্ষুধা থেকেও চোখের ক্ষুধা বেড়ে যায় ফ্রি ত্রাণ পাওয়ার আশায়। আমাদের পূর্ব-অভিজ্ঞতা খুবই খারাপ। ফ্রি কোনো কিছু পাওয়ার ক্ষেত্রে। সারা দিন কাজ না করে কোথাও সারা দিন বসে থেকে ১০০ টাকা পাবে, সে আশায় বসে থাকা লোকের সংখ্যা কম নয়। বিখ্যাত লেখক ও রাজনীতিবিদ আবুল মনসুর আহমেদের ‘ফুড কারেন্স’ যারা পড়েছেন তারা জানেন, রিলিফ ওয়ার্ক আর নিয়ম অনিয়মের অতীতধারা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় অসচ্ছল, পঙ্গু, বিধবা, বয়স্ক, মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষাভাতা, কাবিখা, কাবিটা ইত্যাদি হাজারো সোশ্যাল সেফটি নেটের আওতায় রয়েছে লক্ষ লক্ষ উপকারভোগী। বর্তমানে তাত্ক্ষণিক বেকার হয়ে পড়া।
নৃগোষ্ঠী নির্ধারিত। ছোটো দোকানদার, হকার, ড্রাইভার, শ্রমজীবী ইত্যাদি সোশ্যাল সেফটি নেটের বাইরের মানুষদের খুঁজে সহায়তা দিতে পারলে ক্রাইসিস কমে আসবে। কিন্তু বাস্তবতা বড়োই কঠিন আর বিচিত্র। আমরা কোনো কিছু গ্রহণের ক্ষেত্রে নৈতিকভাবে সঠিক স্থানে থাকতে পারি না। যার ফলে যাদের প্রয়োজন তারা ছাড়া যাদের খুব প্রয়োজন নেই কিংবা আরো কিছুদিন চলবে তারাও হুজুগের সুযোগে রাস্তায় নেমে পড়েছি। এদের কেউ হয়তো প্রয়োজনে, কেউ ভবিষ্যত্ অনিশ্চয়তায় নেমে পড়েছে রাস্তায়।
বিভিন্ন এলাকায় খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, অতি প্রয়োজন ছাড়াও অনেকে ত্রাণের জন্য ঝুঁকি নিয়ে রাস্তায় নামছে। যেহেতু সরকারি-বেসরকারি খাতে ব্যাপক ত্রাণ তত্পরতায় অনেকে রাস্তায় আসছে, যা প্রতিনিয়ত ঝুঁকি বৃদ্ধি করছে। মিডিয়ার বদৌলতে অনেক দেশের দৃশ্যের সঙ্গে আমাদের দেশের দৃশ্যের মিল নেই। মানুষের জীবনে খাদ্যের প্রয়োজন অত্যন্ত বেশি বহুমাত্রিক খাদ্য তালিকার কারণে। পাশাপাশি সবুজ সুন্দর বাংলাদেশের সর্বত্র শাকসবজি ফলমূলের বৈচিত্র্যময় খাবারের ছড়াছড়ি। অর্থাত্ যে কোনো কঠিন পরিস্থিতিতেও টিকে থাকার (সারভাইভ করা) পরিস্থিতি আমাদের দেশে অপ্রতুল নয়। মহান মুক্তিযুদ্ধকালে আমাদের সব মানুষ এভাবে খাদ্যের ক্ষেত্রে সারভাইব করে শুধু টিকেছিল বললে ভুল হবে বরং যুদ্ধ জয় করেছিল। সে মন্ত্রটি আমাদের সবাইকে নতুন করে স্মরণ করে দেওয়া দরকার, যারা বলেন আমরা করোনায় মরব না, আমরা খাওয়ার অভাবে মরব—আমি তাদের সঙ্গে একমত নই। ভয়ংকর করোনা জীবাণু খুবই বেপরোয়া। স্বাস্থ্য খাতের সেরা সেরা দেশগুলো কুপোকাত আর আমাদের পরিস্থিতি কতটা ভয়ংকর হতে যাচ্ছে বুঝতে খুব বেশি জ্ঞানী হবার দরকার নাই। যারা ভাবছেন, ত্রাণ বাঁচাবে প্রাণ তাদের সতর্ক করে বলি ত্রাণ প্রাণ বাঁচার পরিবর্তে ত্রাণদাতা-গ্রহীতা দর্শক, প্রতিবেশী সবাই এ ভয়াবহতার শিকার হবে। এতে যে দৃশ্য মিডিয়ায় দেখছি অন্য দেশের তা হয়তো আমাদের এখানেই সংঘটিত হতে পারে। যদি এখনো কঠোরতার সঙ্গে নিয়ন্ত্রণ করা না হয়, তাহলে ভয়াবহতা অনুমেয়। বিকল্প খাদ্যভ্যাস প্রয়োগ করে ত্রাণের নামে রাস্তায় নামা বন্ধ করতে হবে।
ত্রাণে প্রাণ—থাকবে না যাবে—এ প্রশ্নে বলা যায়, এমন ত্রাণ বিতরণে প্রাণ বাঁচবে না বরং সবাইকে প্রাণের ঝুঁকিতে নিয়ে যাচ্ছে। চেয়ারম্যান, মেম্বার, কমিউনিটি পুলিশ, গোয়েন্দা সংস্থা এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে প্রকৃত অভাবীদের তালিকা প্রস্তুত করে ত্রাণ দিতে হবে। সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ে যারা সরকার থেকে সুবিধা পাচ্ছেন তাদের এ প্রক্রিয়া থেকে বাদ দিতে হবে। সমাজের বিত্তবান, সমর্থবানদের এগিয়ে এসে অভাবী প্রতিবেশীকে সাহায্য করতে হবে। সামান্য সামর্থ্য আর অবলম্বন থাকলেও ঝুঁকি নিয়ে বাইরে যাওয়া যাবে না। আমাদের মতো আর্থসামাজিক অবস্থান দেশে বাসায় থেকে জীবন বাঁচানো থেকে আর কোনো নিরাপদ ব্যবস্থা নেই। এ
ত্রাণে প্রাণ বাঁচার বদলে নিভে যাবে মূল্যবান প্রাণ।
ঘরে থাকুন নিরাপদ থাকুন।
লেখক :
মোহাম্মাদ মোস্তাফিজুর রহমান
পুলিশ সুপার, সাতক্ষীরা।