শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:৩৭ পূর্বাহ্ন
সংবাদ শিরোনাম:
গণমাধ্যমের অংশীজনের সঙ্গে ধারাবাহিকভাবে মতবিনিময় সভা আয়োজনসহ কয়েকটি বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ আইজিপি হিসেবে দায়িত্ব নিলেন জনাব বাহারুল আলম নতুন সিইসি নাসির উদ্দীনের পরিচয় কালিগঞ্জে আছিয়া লুতফর প্রিপারেটরি স্কুলে মা সমাবেশ অনুষ্ঠিত সলেমান মামুন ব্যারিস্টার সুমন দুই দিনের রিমান্ডে ডিএমপির ৩৮তম পুলিশ কমিশনার হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করলেন শেখ মোঃ সাজ্জাত আলী বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যেতে হবে : প্রধান উপদেষ্টা আলেমরাই এক দিন এদেশে নেতৃত্ব দেবেন।।ধর্ম উপদেষ্টা কে এই নতুন ডিএমপি কমিশনার? দৌলতপুরে বসতবাড়িতে ডাকাতির সময় মা-ছেলেকে হত্যার দায়ে ৩ জনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ

আশি দোররা চুম্বনঃ পাঠ প্রতিক্রিয়া- তৌফিক জহুর

  • আপডেট টাইম : শনিবার, ১৩ মার্চ, ২০২১, ৩.০৮ পিএম
  • ৩২৭ বার পঠিত
আমরা নব্বই পরবর্তী প্রথম দশকের কবি মাহফুজা অনন্যার সদ্যভূমিষ্ঠ চতুর্থ কাব্যগ্রন্থ “আশি দোররা চুম্বন” নিয়ে বয়ান করতে চাইছি। এই কাব্যগ্রন্থের কবিতার ভিতরে প্রবেশের আগে আমরা কাব্যগ্রন্থের নামকরণ নিয়ে কিছু বলতে চাই। একজন তরুণ কবি যখন Oxymoron চিন্তায় নিজেকে ডুবিয়ে দেয় তখন সেই কবির কবিতায় কৌতূহলী নজর পড়ে। তার আগে Oxymoron নিয়ে কিছু কথা হয়ে যাক।
ইংরেজি শব্দ Oxymoron, গ্রীক শব্দ Oxis এবং moros থেকে ১৬৫৭ সালে প্রথম শব্দটি ইংরেজিতে প্রচলিত হয়েছে। Oxis অর্থ “ধারালো, তীব্র”, moros অর্থ “আহাম্মক”। Oxymoron একবচন আর এর বহুবচন হলো Oxymora । Oxymoron এর আধুনিক অর্থ দাঁড়িয়েছে এমনসব শব্দগুচ্ছ (সাধারণত দুই শব্দ) যেগুলো ভীষণভাবে পরস্পর বিরোধী। অর্থাৎ দুটি পরস্পর বিরোধী শব্দ একটি মাত্র অভিব্যক্তিতে আবদ্ধ করে একটি ধাঁধার ভাবকল্প তৈরি করা হয় তাকেই Oxymoron বলে। উদাহরণ Dark Light, Living Dead, Guest Host, Wise Fool, Cruel Kindness| Oxymoron সাধারণত মেটাফিজিক্যাল কবিতায় ব্যবহার করা হয়। শেক্সপিয়ার তাঁর “রোমিও এন্ড জুলিয়েট” এ রোমিও তার ÒLoving Hate” প্রকাশ করতে অনেকবার Oxymoron ব্যবহার করেন। যেমন:
O brawling Love! O loving hate”
O anything of nothing first create!”
O heavy lightness! Serious varity”
Oxymoron নিয়ে ছোট বয়ান শেষে আমরা মাহফুজা অনন্যার কবিতার আঙিনায় প্রবেশ করছি। আমরা কবির কবিতার অন্দরমহল পর্যন্ত ঢুঁ মারবো। আমরা প্রথমে কবির Oxymoron প্যাটার্নের কবিতাটি লক্ষ করি।
“চুয়াল্লিশ ধারা অমান্য করে তুমি ঢুকে পড়েছো অসীমায়
গোয়েন্দা সিরিজের প্রধান চরিত্র দস্যু বনহুর, সশস্ত্র ঢুকে পড়েছ
ডাকাতসর্দার, একানব্বই নম্বর বাড়িটির প্রধান দরোজায়
শোবারঘর, বিছানা, বালিশ, জায়নামাজ রাখা তসবীর নিরানব্বই দানা
ভেদ করে জাদুমন্ত্র ঢুকে যাচ্ছ নিঃশ্বাসে,
স্পর্ধার সীমালঙ্ঘন করে হাম্মামের উষ্ণ জল ও ফোয়ারার আদিখ্যেতায় ঢলে পড়ছ আমার গায়…
ইচ্ছে করলে তোমাকে বন্দি করতে পারি দুইশত ছয়টি হাড়ের তৈরি অদৃশ্য কারাগারে, যেখানে বন্দি হলে ফিরে যাওয়ার পথ পায়না কেউ,কোনোদিন…
প্রাণভয় থাকলে পালিয়ে যাও, নতুবা তোমার দুঃসাহসের জন্য লিখিত হবে একটি নতুন সংবিধান
জনসমক্ষে আশি দোররা চুম্বনের শাস্তির বিধান জারি হতে পারে শীঘ্রই”
[আশি দোররা চুম্বন, পৃষ্ঠা-২৬]
Oxymoron থিয়োরী নির্ভর এই প্রেমের কবিতাটি বাহিরের দিক থেকে সহজ ও সরল কিন্তু ভেতরে গভীর সুদুরতার দিকে আমাদের মনকে আকর্ষণ করে। যথার্থ প্রেম নির্ভরমন অল্প কয়েকটি বাক্যে প্রকাশের ক্ষমতাও অসামন্য। মাহফুজা অনন্যার এই কবিতায় বহিরঙ্গ আতিশয্য নেই, শৈলেিত দুষ্ট মুদ্রা নেই। তাঁর পংক্তি বয়ান সুর্মিত ও ব্যঞ্জনময়। তাঁর কবিতায় প্রথমেই নজর কাড়ে মুক্তমনের প্রতিফলন। তাঁর মন সংস্কার বিহীন কিন্তু সংস্কৃত। ঐতিহ্যের চাদরে আবৃত। তিনি এ যুগের মানুষ। যুগের জটীলতা, যুগের নিরাশার হাত ধরেই তাঁকে হাঁটতে হচ্ছে। কিন্তু তাঁর কবিতা পাঠ করে উপলব্ধি হয়েছে, যে কাব্যপ্রাণতা জটীলতা কে সরল করে তোলে, নিরাশার বুকেও আশার প্রদীপটি জ¦ালিয়ে দেয়, তার চাবিকাঠির খোঁজ কবি পেয়ে গেছেন। তাঁর কবিতার আঙিনায় পা দিয়েই আমরা তা টের পাই। লাকড়ির উনুনের আঁচ যেমন বেশ খানিকটা দূর থেকে অনুভব হয়। মাহফুজা অনন্যা তাঁর কাব্যভাষা সৃষ্টিতে কথ্যভাষার সাহায্য নেননি। চিরায়ত ঐতিহ্য আশ্রিত শব্দের প্রতি কবির আকর্ষণ লক্ষ করা যায়। বেলী ফুলের মালা গাঁথার মতো শব্দের মালা গাঁথতে যেয়ে তিনি পাঠককে হতাশ করেননি। তিনি সমাজের অসঙ্গতি নিয়েও শব্দের চাষবাস করেছেন। কিন্তু কোথাও মনে হয়নি আরোপিত, সব জায়গাতেই স্বতস্ফূর্তভাবে কলম থেকে শব্দের ঝরনা প্রবাহিত হয়েছে। ফলে তাঁর মুক্তগদ্যে লেখা কবিতাগুলো সুখপাঠ্য হয়ে উঠেছে। তিনি নির্দিষ্ট কোনো দর্শনকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাননি তাঁর কবিতার শরীরে। আস্তিক্যবাদ, নাস্তিক্যবাদ নিয়েও কোনো চিন্তা নেই তাঁর কবিতায়। তবে তাঁর কবিতায় প্রেম নির্ভরতার পাশাপাশি সময় সচেতনতা লক্ষ্য করা যায়। সাম্প্রতিক অনেক বিষয় কবি হৃদয়ে নাড়া দেয়। যা তাঁর কবিতায় বেশ বলিষ্ঠভাবে উঠে এসেছে এবং তা কাব্যিক দ্যোতনার ঘুঙুর পড়ে।
“জাস্টিন ট্রডো কিংবা ডোনাল্ড ট্রাম্প কেউ যখন উড়াতে পারছেনা শান্তির কেতন
তাদের আবাস ভূমি থেকেও যখন ভেসে আসে মরমি সুর…
তখন তুমিও বাজাতে পারো একটা ডুগডুগি।
একদিন শপথ নিয়েছিলেন তেদ্রোস আধানম
এই পথে রোগ শোক গেলে তুলোর মতো ধুনে দেবেন
মনসুর হাল্লাজের মতো সেদিন কেউ কী তুলেছিল আওয়াজ
কারো রক্ত জিকির করেছিল আনাল হক, আনাল হক।
[আলিফ-লাম-মীম, পৃষ্ঠা-৩০]
“আজ এই দুর্দিনে ল্যাজারাসের মতো কেউ ধর্মাপদেশ দিলেও হতো- মহাশয়গণ ঘুমে কাতর,
আহা কিছু গোবর পোকাও যদি জেগে থাকতো
লা-হুভেনের ঝর্নার উল্টোপাশে
ম্যাকডেল বসে যদি কাঁদে
কী করে ঝর্ণা আর অশ্রুর মিলন সম্ভব?
[ধর্মাবতার, পৃষ্ঠা-৩৭]
যথার্থ নতুন কবির দৃষ্টিভঙি নতুন বলেই প্রচলিত কাব্যভাষার সংস্কার সাধন করেই তাঁকে নিজস্ব ভাষায় কবিতা সৃষ্টি করতে হয়। বিশেষ যুগের কাব্যিক ভাষা ব্যাপক চর্বিতচর্বনের ফলে এমন কৃত্রিম অবস্থায় গিয়ে পৌঁছায় যে জীবনের সঙ্গে তার যোগসুত্রটিই হারিয়ে যায়। বাংলা কবিতায় ত্রিশোত্তর আধুনিকতার যে বাঁক তা থেকে সত্তর বছর পর মাহফুজা অনন্যার কলম থেকে কবিতা প্রসরিত হচ্ছে। তাঁর কাব্যের ভাষা এ মুহূর্তেই স্বতন্ত্র ধারায় চিহ্নিত করা মুশকিল। কিন্তু তাঁর কবিতার ভাষা ও শব্দ প্রয়োগে অগ্রজের অনুকরণ নেই। সহজ, সরল, সাবলীল শব্দ নিয়েই তাঁর কবিতার বাক্যবন্ধ কাঁপেনা। স্পষ্টবাক কবিতার মধ্যে অনায়াসে একটা জ¦লজ¦লে আলোর শিখা আমরা লক্ষ্য করি। পাশ্চাত্য ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি থেকে সচেতন গ্রহণ আধুনিক কবিতার একটি ফ্যাশন, একটি লক্ষণ বলা যেতে পারে যা আমরা অনেক অগ্রজ কবির কবিতায় দেখি। কিন্তু প্রথম দশকের কবি মাহফুজা অনন্যার কবিতায় আমরা একটা মিশেল স্রোত লক্ষ করি। যা প্রাচ্য, পাশ্চাত্যের সঙ্গে মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে “আশি দোররা চুম্বন” কাব্যগ্রন্থে। প্রচলন রয়েছে, কবিতা জটিল ও দুর্বোধ্য না হলে আধুনিক বলা যাবেনা। এটা হাস্যকর। আমরা বলতে চাই, জটিলতাই যার একমাত্র গুণ তা কবিতা নাও হতে পারে। কবিতাকে জটিল ও দুর্বোধ্য হতেই হবে এমন তত্ত¡ যাঁরা প্রচার করেন, তাঁদের সঙ্গে আমরা একমত নই। একই যুগের মানুষ একই সময়ে আলাদা আলাদা ভাষায় কবিতা লিখবেন, এটাই স্বাভাবিক। নিজের কাল সম্বন্ধে অত্যন্ত সচেতন মনে হয়েছে কবিকে। আমাদের আলোচনাগুলো মূলত ব্যক্তিগত আকর্ষণ অথবা বিকর্ষণ থেকে লেখা যায়। আমরা চেষ্টা করছি নির্মোহ থেকে যতটুকু সম্ভব কবিতাকে শণাক্ত করা।
মাহফুজা অনন্যার কবিতা সমাজ চেতনা বহন করেছে। আবার যাপিত-জীবনের প্রতিদিনের জীবন, সুখ-দুখ, আশা-নিরাশা তাঁর কবিতায় প্রতিফলিত হয়েছে। চমকে ওঠার মতো যে বিষয়টি দৃষ্টিগোচর হয়েছে তা হলো Oxymoron কনসেপ্ট যেমন বিদ্যমান তেমনি উত্তরাধুনিক কনসেপ্টও তাঁর কবিতায় সুস্পষ্ট প্রতীয়মান। মাহফুজা অনন্যা পৃথিবীকে ভালোবাসেন, পৃথিবীর মানুষকে ভালোবাসেন তাই তাঁকে বৃহত্তর জীবনের, কবি, চেতনার কবি আমরা বলতে পারি। তাঁর অকপট উচ্চারনে আমরা উত্তরাধুনিক মনের পরিচয় পাই। জোনাকীর মতো ক্ষীণপ্রাণ আলো নয়, তাঁর কবিতায় সূর্যের মতো উদাস, চন্দ্রের মতো স্নিগ্ধ আলোর খোঁজ পাই। আমরা কয়েকটি উদাহরণ লক্ষ করি,
“তেত্রিশ থেকে পঁয়ত্রিশ সপ্তাহের শিশু যেভাবে মায়ের গর্ভরসে
ভাঁজ হয়ে থাকে অসিপিটো- অ্যান্টোরিয়র পজিশনে
আমরা সেভাবে ঘুমিয়ে আছি
কিছু অনাসৃষ্টি পৃথিবীকে ইচ্ছের বিপরীতে চলতে বাধ্য করে
তবু সকল অনাসৃষ্টি বুকে পিঠে সয়ে পৃথিবী হাঁটে প্রতি স্রোতে
এইসব স্রোত-প্রতিস্রোতে জীবন জাহাজ কখনো কখনো একদিকে
কাত হয়ে ডুবে যা।
[লবনখনি শেখেনা নুনের গান, পৃষ্ঠা- ১৯]
“মহামারী কেটে, গেলে একটি আলোর উৎসব হবে বেঁচে থাকা তাঁরাদের নিয়ে, আলোর টুপি মাথায় পরে সে উৎসবে তুমি যোগ দিও
উৎসবের আলোয় যদি আমাকে খুঁজে না পাও, প্রধান ফটকে গিয়ে উপরে
তাকিয়ে দেখো, ওখানে নিশ্চিত আমিই হাসব বাঁকা চাঁদ…
তৃষ্ণার্ত হাজরে আসওয়াদ কাঙ্খিত ঠোঁটের চুমুতে যেভাবে হেসে ওঠে…
[হাজরে আসওয়াদ, পৃষ্ঠা-১৭]
“সাতশ কোটি মানুষ ঘেঁটে তোমাকে বের করি হে একত্ববাদী, অদ্বিতীয় সংরক্ষক
সকল সৃষ্টির আকার তুমি
এক তুমি
দুই তুমি
ষোলোকোটিও তুমি
তোমাকে চিনতে গিয়ে মানুষ জেনেছে আমার বহুগামিতা
আমি চিনেছি তোমাকে, তুমিই সর্বগামী
আগুন থেকে জন্ম নেয়া অজস্র ফিকে গোলাপের অহমিকায় উদ্বেলিত জগত সংসার
তোমার দাসত্ব বাসনায় ঘর ছেড়ে পথে
কবরের পাশে পড়ে থাকা পাথরের মতো অপরিমেয় বুনো মাথায় পড়ে আছি
হে জীবনের মালিক, বহুগামী অপবাদে তুমিও কি আজন্ম আমার কাছ
থেকে দূরে থাকবে….?
[অদৃশ্যভাষ, পৃষ্ঠা- ১৮]
“একটি পুরুষের চেয়ে একটি কুকুরকে সঙ্গী হিসেবে বেশি পছন্দ করি
একটি পুরুষের চেয়ে একটি কুকুরকে বেশি ভালোবাসি
একটি পুরুষ সঙ্গীর চেয়ে আমার ছে একটি কুকুর সঙ্গী বেশি প্রিয়
যখন খেতে বসি একটি কুকুর দূরে গিয়ে হাটু গেড়ে বসে থাকে,
হাড় কিংবা উচ্ছিষ্ট ফেললে তখনই শুধু ছুটে আসে খেতে
কুকুরটি কখনো আমার মুখের খাবার কেড়ে খায়না…
যখন ঘুমিয়ে থাকি, কুকুরটি আমাকে পাহারা দেয়
আমার টাকার বিণিময়ে অন্য কারো কাছে বিক্রি করে দেয়না
কিংবা পিঠ ফিরে ঘুমালে আচমকা মুখ চেপে ধরে আমাকে ধর্ষণ করেনা।
[বিশ্বস্ত, পৃষ্ঠা-২৮]
মাহফুজা অনন্যার এই ভাবাবেগ, রোমান্টিসিজম, সমাজচেতনা আমাদের বিস্মিত করে। স্বকীয় কাব্যপ্রচেষ্টার উপর যথেষ্ট দক্ষতার ছাপ রেখেছেন কবি। কবিতার জন্য একজন কবিকে তপস্যা করতে হয়। ধ্যান, জ্ঞান, চিন্তা-চেতনার মধ্যে শুধু কবিতাই ঘুরপাক খায়। একজন তরুণ কবির অন্তপ্রেরণা, পরিশীলিত কবিস্বভাব তাঁর লেখার মধ্যে দৃষ্টিগোচর হয়। বিস্তৃত প্রেমের আবেগে দীর্ঘ কবিতায় যাননি কবি। অত্যন্ত পরিমিতবোধ আমরা লক্ষ্য করি শব্দ প্রয়োগে, বাক্যগঠনে। চিত্রকল্পে তিনি বেশ মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। যদিও তাঁর কবিতার কিছু কিছু বাক্য বেশ লম্বা। কিন্তু রস আস্বাদনে পরিপূর্ণতা আছে। ত্রিশের আধুনিক কবি জীবনানন্দ দাশ, “কবিতার কথা” প্রবন্ধে লিখছেন, “সৃষ্টির ভিতর মাঝে মাঝে এমন শব্দ শোনা যায়, এমন বর্ণ দেখা যায়, এমন আঘ্রাণ পাওয়া যায়, এমন মানুষের বা এমন অমানবীয় সংঘাত লাভ করা যায়- কিংবা প্রভূত বেদনার সঙ্গে পরিচয় হয়, যে মনে হয় এই সমস্ত জিনিসই অনেকদিন থেকে প্রতিফলিত হয়ে আরো অনেক দিন পর্যন্ত। হয়তো মানুষের সভ্যতার শেষে জাফরান রৌদ্রলোক পর্যন্ত কোথাও যেন রয়ে যাবে, এইসবের অপরূপ উদগিরণের ভিতরে এসে হৃদয়ে অনুভূতির জন্ম হয়, নীহারকা যেমন নক্ষত্রের আকার ধারণ করতে থাকে তেমনি ববস্তুসঙ্গতির প্রসব হতে থাকে যেন হৃদয়ের ভিতর।” [“কবিতার কথা, পৃষ্ঠা-১৪-১৫]। আমরা বয়ান করছি মাহফুজা অনন্যার “আশি দোররা চুম্বন” কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত বিষয় ও ভাষা নিয়ে। তিনি চেষ্টা করছেন একটা আলাদা সড়ক নির্মাণে। ভাষা ভঙির সড়ক নির্মাণে কবিকে পূর্বজ কবিদের সড়ক খেয়াল রাখতে হবে যুগ-মানস বিবেচনা করে। তাহলে আশা করা যায় মাহফুজা অনন্যা সড়ক শনাক্ত করা সম্ভব হবে। গন্তব্য অনেকদূর। পথ সবে শুরু। ভালো কবি কখনো ফ্যাশনদুরস্ত হতে পারেনা। ডামাডোল হৈচৈ সাময়িক। উদিত সূর্য একসময় অস্তমিত যায় কিন্তু জেগে থাকে আকাশ, সমুদ্র, পাহাড়, নদী, অরণ্য। আমরা বলতে চাচ্ছি কবিকে অধ্যবসায় চালিয়ে যেতে হবে। চর্চার মধ্যে দিয়ে কবি একদিন তাঁর কবিতার আদিতম রূপ আবিষ্কারে সক্ষম হবেন। নিজস্ব রাস্তাটি সেদিন নির্মিত হবে। তবে তাঁর কবিতার আঙিনা পেরিয়ে অন্দরমহলে যেয়ে এটুকু উপলব্ধি করেছি, সময়কে ধারণ করে কবি যদি নিজেকে প্রস্তুত করেন তাহলে বাংলা কবিতার নিসর্গে মাটিগন্ধী প্রাণশক্তির নতুন সবুজ ফসল সংযোজিত হবে।
“যখন হাঁটতে বের হই এক অদৃশ্য ভাবনা আমার হাঁটার গতিকে বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়
হেমন্তের রাত বাতাসের ডানায় শীত কুড়িয়ে ফেরে নগরমুখে,
আকাশের উপর বসে পরিপাটি চাঁদ উচু হয়ে মুখ দেখে মাটির আয়নায়
রাতের পদক্ষেপে, চাঁদের ভরা যৌবনে কিংবা শোবারঘরের বানোয়াট
আঁধারে অপেক্ষা
‘আগামীকাল’ আসবে আমার সাথে হাঁটবে
দেখতে দেখতে আমিও হেঁটে যাবো বহুদূর…
[আগামীকাল এবং আমি, পৃষ্ঠা- ২১]
আবিষ্কারের নেশায় আমি কবিতার আলোচনা করছিনা। আমরা “আশি দোররা চুম্বন” পাঠ করেছি। বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করছি কবির চিন্তা ও গতিপথ। আমরা কবির কবিতার দিকে এগিয়ে গেছি। জীবন দিয়েই কবিতা তৈরি হয়। কবিতা কোনো আন্তুক নয়। আমেরিকার মহত্তে¡র স্বপ্নদদ্রষ্টা বিশপ বার্কলে বলেছিলেন, “আপেলের স্বাদ বলতে আমরা যা বুঝি তা আপেলে মধ্যে থাকেনা। আপেল নিজে তার স্বাদ নিতে পারেনা- আবার খাদকের মুখের মধ্যেও এই স্বাদ থাকেনা। এরজন্য এই দুয়ের সংযোগ ঘটানোর প্রয়োজন পড়ে।” পাঠক আর কবিতাকে একসাথে হতে হবে গভীর মনোনিবেশ সহকারে। তবেই কবিতার স্বাদ আস্বাদন সম্ভব। হোর্হে ল্ইুস বোর্হেস এর ধারাবাহিক বত্তৃতা “কবিতার কারখানায়” তিনি বয়ান করছেন, “কবিতার প্রথম পাঠই হলে তার আসল পাঠ, তারপরে, এমন এক বিশ্বাসে আমরা নিজেদের আচ্ছন্ন করে ফেলি যে আমরা মনে করি আমাদের অনুভূতি, উপলব্দি পুনরাবৃত্তি ঘটছে। তবে আমার মতে এটি হতে পারে স্রেফ আনুগত্য, স্রেফ স্মৃতির একটি চাল, আমাদের বর্তমান আবেগ এবং পূর্বে আমরা যে আবেগ অনুভব করেছিলাম এ দুয়ের মধ্যে স্রেফ একটি বিভ্রান্তি। এভাবে বলা যায় যে, কবিতা হলো প্রতিবার এক নতুন অভিজ্ঞতা। একটি কবিতা প্রতিবার পড়ার সময় এই অভিজ্ঞতা হয় এবং এটাই কবিতা।” [কবিতার কারখানা, পৃষ্ঠা- ১৮]
“আশি দোররা চুম্বন” নিয়ে কথা বলতে যেয়ে আমরা আন্তর্জাতিক আঙিনায় কবিতার সংজ্ঞায় বিদগ্ধ কবি হোর্হে লুইস বোর্হেসের দুয়ারে কড়া নাড়লাম।
আমরা শুরু করেছিলাম Oxymoron চিন্তা নিয়ে। একজন কবি যখন এমন চিন্তায় তাড়িত হন তখন তাঁর সৃষ্টিকর্ম নিয়ে কৌতূহল জাগে। ‘আগ্রহ’ জন্মে। আমরা “আশি দোররা চুম্বন” এর প্রতিটি পৃষ্ঠায় ঢু মারি। পৃষ্ঠা ওল্টানোর সঙ্গে সঙ্গে জেগে ওঠে কবিতাগুলো। তারা কথা বলে তাদের ভাষায়। আমরা পাঠ করতে করতে ডুবে যাই কাব্যগ্রন্থের গভীরে।
“ঝিনুকের ভেতর থেকেও মুক্তা যেমন দেখতে পায়না গভীর সমুদ্র, তেমনি
তারাও রাতের উদ্দীপকে হারিয়ে ফেলে দিনের অনুষঙ্গ
ছেলে বেলায় পড়া গল্পের অন্ধ লোকটি কিন্তু হাতির গা ছুঁয়ে ঠিকঠাক
বলেছিল, ‘হাতি হচ্ছে দেওয়ালের মতো’…
আঁধারের শরীর ছুঁয়ে হাঁটতে হাঁটতে মানুষ আজ বড্ড দিন কানা…।”
[দিনকানা, পৃষ্ঠা- ৩৫]
“আশি দোররা চুম্বন” কাব্যগ্রন্থে অতৃপ্ত আত্মার আহাজারি যেমন আছে তেমনি বুকভরা ভালোবাসাও আছে। আছে স্বপ্ন ও বাস্তবের মিশেল স্রোত। কোথাও-কোথাও সমাজ ব্যবস্থার প্রতি কটাক্ষ আছে। পিঞ্জর মুক্ত কবুতর কেমনে আকাশে উড়ে বেড়ায় স্বাধীনভাবে, সেই স্বাধীনতার সুখ কেমন তা জানার সুতীব্র আকুলতা আছে। পৃথিবীতে নারী নিজেই একটা একক পৃথিবী এমন ভাবনা থেকে চিত্রকল্পে দারুণ কাজ সম্পন্ন কবিতাও আছে। আমরা আর একটা কবিতার উদাহরণ দিচ্ছি:
“পাঁচ বছর বয়সে মায়ের কাছে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলোর
নামকরণ শিখেছি, তখন স্তন বলে কিছু ছিলনা বাল্যশরীরে
আমি শুধু বুকটা চিনেছি
তখনও বুঝিনি বুকের ভেতর এক অচিননগর থাকে,
সে নগরে থাকে এক মায়াপাখি।
একটু বড় হতে হতে, একসময় বুঝতে শিখলাম আমার বুকের উপর
পৃথিবীর মতো দুটো নতুন আপেল ফুলে ফেঁপে বড় হয়ে উঠছে।
কারণ জিজ্ঞেস করতেই মা বলল এ দুটি হল মায়ার আঁধার, ছোটবেলায়
আমিও মায়াফল চুষতাম মায়ের কোলে শুয়ে,
আর এক হাতে একটি অধিকারে রাখতাম…
যেদিন প্রথম কোনো পুরুষ আলতো করে ছুঁয়ে দিলো আমার দুটি মায়াফল
সেদিনই প্রথম সজ্ঞায়িত হলো পৃথিবী গোলাকার
গোলাকার পৃথিবীর নিচে
এক মায়ার নগর, সে নগরে থাকে
মায়া নামক পাখি।
[বুক ও মায়াফল, পৃষ্ঠা- ৫৮]
সৌন্দর্যের অনুভূতি যার সঙ্গে একটি সুকুমার পবিত্রতা ও একটা অদ্ভুত ভাব জড়িত যা লালিত সংবেদনশীল মানসিকতার দান তা আমরা খুঁজে পাই এই কবিতায়। কবির রক্তের শিরায়- শিরায় আছে প্রেম তবুও অমৃত অন্বেষণেই কবির আত্মপরিক্রমা। যদিও প্রায় সকল কবিতার মধ্যেই দৃশ্যমান প্রেম ও সৌন্দর্যের অনুভূতি অতিমাত্রায় তীব্র বলে কোথাও ক্রোধ শিকল ভাঙতে চেয়েছে। কবির কবিতাগুলোকে এখানেই জীবনের জটিল অভিজ্ঞতার উপর নির্ভরশীল মনে হয়েছে। বিতৃষ্ণার হাত থেকে মুক্তি পেতে ভালোবাসার বাসনাকে আরো তীব্র ও তীক্ষ্ন করতে চান কবি। যেহেতু জড়তা ও অভ্যাসের দাসত্ব করা কবির কাজ নয়। কবির ধর্ম চৈতন্যের প্রহারে জড়তাকে বিধ্বস্ত করা। মাহফুজা অনন্যা সে কাজটি করে চলেছেন দক্ষতার সাথে।
১৩মার্চ ২০২১ শনিবার, ঢাকা।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন

এই ক্যাটাগরীর আরো খবর

পুরাতন খবর

SatSunMonTueWedThuFri
      1
23242526272829
30      
  12345
20212223242526
2728293031  
       
15161718192021
2930     
       
     12
24252627282930
       
2930     
       
    123
       
    123
25262728   
       
     12
31      
   1234
262728    
       
  12345
2728     
       
   1234
       
     12
31      
1234567
891011121314
15161718192021
2930     
       
    123
11121314151617
       
  12345
20212223242526
27282930   
       
      1
2345678
23242526272829
3031     
      1
       
293031    
       
     12
10111213141516
       
  12345
       
2930     
       
    123
18192021222324
25262728293031
       
28293031   
       
      1
16171819202122
30      
   1234
       
14151617181920
282930    
       
     12
31      
     12
3456789
10111213141516
17181920212223
       
© All rights reserved © MKProtidin.Com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com