মিজান ভাইকে আমরা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে সেকেন্ড ইয়ারে পেয়েছিলাম। অর্থাৎ
আমরা ফাস্ট ইয়ার থেকে সেকেন্ড ইয়ারে ওঠি, আর
মিজান ভাই আমাদের স্বাগত জানান। প্রথম দেখাতেই
যে কারো ভালো লাগবে। ফর্সা, সুন্দর চেহারা। কথা খুব
মিস্টি ভাবে আস্তে আস্তে বলতেন। হাতের লেখা ছিল অসাধারণ। লিখতেন খুব কম বা টু দি পয়েন্টে, তবে নম্বর
পেতেন খুব। সাংবাদিক হিসেবেও সুনাম ছিল। ভাসানী হলে থাকতেন। তবে প্রায়ই কামালউদ্দিন হলে আমার রুমে আসতেন। বেশিরভাগ পড়াশুনা নিয়ে কথা বলতেন। আমি আডডা দেয়ার চেষ্টা করতাম। তার মাত্রাজ্ঞান ছিল ভিন্ন, অসাধারণ। এভাবেই সবুজ ক্যাম্পাসে চার বছর সময় পার করি। পাখি, গাছপালা, প্রকৃতির সাথে সাথে তার সাথেও আমার সখ্যতা হয়ে যায়। চলাফেরায় লক্ষ্য করতাম, তার পরিবারের প্রতি প্রবল টান।বাবা-মাকে খুবই শ্রদ্ধা করতেন। ছোট ভাই বোনদের পড়াশোনার দিকে খেয়াল করতেন। ছোট ভাইদের উন্নতির বিষয়ে কোন ছাড় দিতেন না।
একসময় বিসিএস পরীক্ষার ফর্ম ফিলাপের সময় আসে।
মিজান ভাই ফাস্ট চয়েস বিসিএস ( ডাক) ক্যাডার দেন।
অন্য চয়েস দিলেও তার চাকরি হতো। স্বাভাবিক ভাবেই তার
এ ক্যাডারে ২৪তম বিসিএসে চাকরি হয়। আমার বিসিএস ( প্রশাসন) ক্যাডারের চাকরির সুবাদে বাগেরহাট ডিসি অফিসে পদায়ন হয় ২০০৮ সালে। এ শহরেই মিজান ভাইয়ের বাসা। আবার নিয়মিত যাতায়াত। দড়াটানা নদীর পাশে বিকালে আবার হাঁটা, জীবনের হরেক রকম কথা। মিজান ভাইয়ের তখন খুলনায় পোস্টিং। বিকাল হলেই খুলনা থেকে বাগেরহাট চলে আসতেন। আমি যেন তারই জন্য অপেক্ষায় থাকতাম। আমার সহধর্মিণী জানতো, বিকাল মানেই মিজান ভাই।
২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে বাগেরহাটে ইলেকশন মনিটরিং অফিসারের দায়িত্ব পালন কালে তার গ্রামের বাড়িতে গেছি। সাধারণ মানুষের মধ্যমনি যেন মিজান ভাই।
২০০৯ সালে সরকার গঠন করলে আমার সামনে সুযোগ আসে ঢাকা মহানগরীর এসি ল্যান্ড হওয়া বা প্রধানমন্ত্রীর
কার্যালয় বা সচিবালয়ে পদায়ন। আমি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে হ্যাঁ বলি। প্রথমে প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা, রাজনৈতিক ও সামাজিক কল্যাণ বিষয়ক উপদেষ্টা প্রফেসর ড. আলাউদ্দিন আহমদ স্যারের ” রিভিউ কমিটি”তে কাজ করি। বাগেরহাট ছেড়ে আসতে আমার ইতস্তত ছিল। মিজান ভাইয়ের সখ্যতা আমি হাতছাড়া করতে পারছিলাম না। ডিসি স্যারও রিলিজ দিতে রাজি ছিলেন না । আমার জন্য ভালো হচ্ছিল। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব সাদিক স্যার ডিসি স্যারকে ফোন করলে বাধ্য হয়ে রিলিজ করেছিলেন। ২০০৯ সালের প্রথম দিকে ঢাকাতে চলে আসি। সহকারী সচিব হিসেবে যোগদান করি। জনপ্রশাসন সচিব ইকবাল মাহমুদ স্যার কেন জানি পছন্দ করে নিয়েছিলেন।
তবে, ঢাকাতে এসে বিকালের সময় মিজান ভাইয়ের অভাব রয়ে গেলো। কিছুদিন পর মিজান ভাইয়ের ডাক বিভাগের প্রধান কার্যালয়ে পদায়ন হয়। আমার আকাশের চাঁদ ফিরে পাওয়ার মতো অবস্থা। বেইলী রোডে আমি সরকারি বাসা
পেয়ে যাই। আবার বেইলী রোড আর অফিসার্স ক্লাবে আড্ডা শুরু হয়। আমার বড় শ্যালিকা নাইমার বিয়ে হয়
তার রিকমেন্ডে তার কাছের কাউছারের সাথে। কাউছার
২৪ ব্যাচের পুলিশ কর্মকর্তা। শ্যালিকা পুলিশ কর্মকর্তার সহধর্মিণী হতে পারতো না মিজান ভাইয়ের সহযোগিতা না
থাকলে। শ্যালিকা যদি মিজান ভাইয়ের মাগফেরাত এ-র জন্য দোয়া করে খুব খুশি হবো। আমার অভিব্যক্তি জানতে পারলে কাউছার-নাইমা দম্পতি এমনটা করার কথা, হয়তো তারা তার জন্য দোয়া করে। মিজান ভাই অবশ্য নিজে ততদিনেও বিয়ে করেন নি।
মিজান ভাই ঘুরে ফিরে বেইলী রোডে ডাক বিভাগের মহাপরিচালকের বাংলোর সামনে নিয়ে যেতেন। বলতেন- “আলমগীর,আমি একদিন মহাপরিচালক হবো, এই বাংলোয় তোমার ভাবিসহ থাকবো। ” আমি বলতাম- মিজান ভাই আপনি পারবেন, আপনি তো অসাধারণ মানুষ। একটু মজা করে বলতাম-মিজান ভাই দ্রুত মহাপরিচালক ভাবিকে ঘরে নিয়ে আসেন। চলেন তাকে খুঁজে বের করি।
পরে একদিন জানলাম মিজান ভাইয়ের বিয়ে হয়েছে। মিজান ভাই ফোনে আমাকে ধরিয়ে দিয়ে বললেন -তোমার
ভাবির সাথে কথা বলো। কথা বলে জানলাম তিনি ২০ ব্যাচের প্রশাসন ক্যাডারের সদস্য। তাই ভাবি হয়ে গেলেন ম্যাডাম।
তার কিছুদিন পরে মিজান ভাইয়ের সহধর্মিণী লন্ডনে এম এস করতে গেলেন। তবে জানলাম তার জন্ডিস হয়েছে। এমনি এক বিকালে চট্রগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার সিরাজুল হক খান স্যার ভাবি সহ আমার বাসায় এলেন।
ইতিমধ্যে জেনে গেলাম মিজান ভাই আর নেই। মিজান
ভাইয়ের বাবা আমাদের সম্পর্কের কথা জানতেন। বার বার
মোবাইলে রিং আসছিল। স্যার বাসায় থাকাতে বাহির হতে পারছিলাম না। পরিস্থিতি স্যারকে বুঝাতে পারছিলাম না। স্যার বিদায় নিলে সিএনজি নিয়ে মিরপুরে যাই। কয়েক ঘন্টা আমার দেরি হয়। আমি যখন পোঁছাই তখন নিরব নিথর দেহ। মিজান ভাইয়ের বাবা বললেন -” বাবা, এত দেরিতে আসলে,আমার তো সব শেষ, মিজান তো আর নেই। ” আমি নিরব-পাথরের মতো সবার শেষে শেষ বারের মতো মিজান ভাইকে দেখলাম, ফেরেশতার মতো মানুষ, মার্জিত তার মুখায়ব দেখলাম। এরপরই তার লাশের গাড়ি ডাক বিভাগের প্রধান কার্যালয়ে এলো। আমি পিছনে পিছনে চলে এলাম। তারপর লাশের গাড়ি চলে গেলো বাগেরহাটের উদ্দেশ্যে। আমার প্রচন্ড ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও লাশের গাড়ির সাথে যেতে পারি নি। পরে বাগেরহাটে গেছি,পৌরসভার গোরসহানে চির নিদ্রায় শায়িত মিজান ভাইয়ের জন্য জিয়ারত করে এসেছি। মিজান ভাইয়ের বাবা- মায়েরসাথে দেখা করে এসেছি। একসময় তার পরিবারের সদস্যরা ফোন দিত। তার ছোট ভাইয়ের সরকারি চাকরির খবরে খুব খুশি হয়েছিলাম। সে ঢাকায় একটি পোস্টিং চেয়েছিল, ব্যর্থ হই। দায়বদ্ধতা অনুভব করি।
অফিসার্স ক্লাবের নির্বাচন উপলক্ষে ঢাকার সকল সরকারি অফিসে যেতে হয়। কিন্তু ডাক বিভাগের প্রধান কার্যালয়ে গেলে আমার বোবা কান্না চলে আসে। আমি মিজান ভাইকে খুঁজে বেড়াই। আমার সেখানে আর যেতে ইচ্ছে করে না।
সচিবালয় থেকে মতিঝিলে আসা-যাওয়ার পথে ডাক বিভাগের প্রধান কার্যালয়ের দিকে তাকালেই মিজান ভাইয়ের চেহারা ভেসে ওঠে। আমি স্তব্দ হয়ে যাই, যে মিজান
ভাই মহাপরিচালক হতে চেয়ে ছিলেন, সেখানে তার লাশের গাড়ি গিয়েছিল। জীবন কি তাহলে এতই ঠুনকো, প্রত্যাশা -প্রাপ্তির এতই ব্যবধান।
অফিসার্স ক্লাবে গত ২০.০৮.২০২১ তারিখে জাবি ইংরেজি ২৬ ব্যাচের গ্রান্ড গেট টুগেদার আয়োজন করি। ব্যাচের সবার নাম সংগ্রহ করি তাল গাছ টাইপের ব্যানার তৈরি।
হল ভিত্তিক বন্ধুদের নাম দেই, নামের প্রতি অনেকের আগ্রহ, নাম আগে না থাকলে অনেকের ইগোতে লাগে। মিজান ভাইয়ের নাম সর্বশেষ ৭৩ নম্বরে দেই, মিজান ভাই জীবিত থাকতেও এ ধরনের ইগো ছিল না। তবে, মিজান ভাই-আমার কাছে আপনার অবস্থান অনেক ওপরে।
মিজান ভাইয়ের নামে ইংরেজি বিভাগে একটি স্কলারশিপ চালু করার স্বপ্ন আমি এখনো বাস্তবায়িত করতে পারি নি। ব্যাচমেটদের অনেককে বলেছি, অনেক কথা হয়,কিন্তু
কাজ হয় না। বেঁচে থাকলে জীবিত মানুষ মনে হয় এমন হয়!
আজ সচিবালয় থেকে মতিঝিল আসার পথে সাহস করে
ডাক বিভাগের দিকে তাকালাম, অন্য দিন হলে দ্রুত চলে যেতাম। শক্তি-সাহস নিয়ে দাঁড়ালাম – প্রধান কার্যালয়ের ছবিও তুললাম। মিজান ভাই বেঁচে থাকলে অফিসের ভিতরে যেতেই হতো। মিজান ভাই ডাক বিভাগে থাকলে সামনের ফূটপাত হয়তো দখলমুক্ত থাকতো, সাধ্যমতো ভূমিকা রাখতেন। পরিচ্ছন্নতা তার ভালো লাগতো। আর কিছু না হোক, বলতে পারতাম, মিজান ভাই, ডাক বিভাগের সামনে
এমন জামা-কাপড় বেঁচা-বিক্রী মানায় না। বস্তির মতো ভাবও মানায় না। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যদি এ অফিসের সামনে
রাস্তা দখলমুক্ত করতে পারে তাহলে আমার মিজান ভাইয়ের
পরপারে থেকেও ভালো লাগার কথা।
যা হোক, মিজান ভাইয়ের মতো ভালো মানুষেরা মনে হয় একটু আগেই চলে যায়। পরপারে ভালো থাকবেন মিজান ভাই।
তথ্যসূত্রঃ অফিসার্স’ ক্লাব ঢাকা এর কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য, বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের উপসচিব আলমগীর হোসেন এর ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকে।