কালের প্রবাহে ভেসে চলে চলমান জীবন, থামে না কখনো, থেমে থাকা সে জীবন নয়। এগিয়ে চলা জীবন পেরিয়ে আসা সময়কে বাঁচিয়ে রাখে স্মৃতির অবয়বে। সারা স্মৃতিতে মিশে থাকে অনুভবের স্বাক্ষর। তবে সব স্মৃতি সন্নিহিত থাকে না চিরঞ্জীব পটে। সামান্য পরিচয়ের ঘটনা, সে আবার স্মৃতির গহনে জ্বলে থাকে কিভাবে! কিন্তু আজিজ স্যারের সাথে আমার পরিচয়পর্ব বেঁচে আছে স্মৃতির জানালায়। তখন আমার শৈশব, সবেমাত্র হাইস্কুলে উঠেছি। সাতক্ষীরায় এক সাহিত্য সম্মেলনে কলকাতা থেকে কবি সাহিত্যিকরা এসেছিলেন; কবেকার সে কথা, নামধাম মনে নেই তেমন কারো। কলকাতার কবি কানাইলাল এবং তখনকার জেলা প্রশাসক সামাদ ফারুক স্যারের কথা মনে পড়ে। তাঁদের থাকবার ব্যবস্থা হয়েছিল নলতা শরীফের গেস্ট হাউজে। অতিথিদের জন্য এটা আনো রে- সেটা আনো রে এসব দায়িত্ব ছিল আমার। মনে আছে আমি দূর গ্রাম থেকে এনে তাঁদের তালের রস খাইয়েছিলাম। সেটা নিয়ে খুব হাস্যরস হয়েছিল। সেই সাহিত্য সম্মেলনের আয়োজকদের একজন ছিলেন গাজী আজিজুর রহমান। সেই থেকে পরিচয়। তিনি আমার একাডেমিক শিক্ষক নন, কিন্তু আমার যে দু’একপাতা লেখালেখির ঝোঁক, সে অঙ্গনে তিনি আমার প্রিয় শিক্ষক। সকলের মতো আমিও তাঁকে ডাকি- ‘আজিজ স্যার’। আহ্ছানিয়া মিশনের বিভিন্ন সেমিনার ও গবেষণার কারণে স্যারের সাথে আমার পথচলা পরিণত হয়েছে নিরন্তর রেখাচিত্রে।
গাজী আজিজুর রহমান প্রান্তজনের কথাশিল্পী। দীর্ঘ ৫৫ বছরের নিরন্তর সাধনায় ইতিমধ্যে তিনি নির্মাণ করেছেন নিজস্ব এক সাহিত্যভুবন। পাঠককে শুনিয়েছেন তাঁর স্বতন্ত্র সত্তার অনুভব। ইতিহাসের গভীর সন্ধানী আলো ফেলে সাহিত্য সৃষ্টিতে তাঁর পারদর্শিতা সম্মানযোগ্য। বস্তুত ইতিহাসের আধারেই তিনি সন্ধান করেন বর্তমানকে শিল্পিত করার নানামাত্রিক শিল্প-উপকরণ। স্বদেশ ভাবনা ও বঙ্গবন্ধু, কবিদের কবি কিংবা আঞ্চলিক ইতিহাস সমৃদ্ধ কালীগঞ্জের ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধ তাঁর সেই স্বরূপকে প্রমাণ করে। তাঁর লেখায় তিনি অনুষঙ্গ করেছেন ঐতিহাসিক উপাদান, আবার স্মরণ করেছেন ঐতিহ্য-চেতনা।
ঐতিহাসিক কাল থেকেই সাতক্ষীরার আলো-বাতাস সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চাকে করেছে উর্বর। বাংলা সাহিত্যে চর্চার দ্বিতীয় ধাপে অর্থাৎ ১৮ শতকের মধ্যভাগে সাতক্ষীরার বেশ কয়েকজন সাহিত্যিক নিষ্ঠার সাথে সাহিত্যচর্চা করে গেছেন। ভরত চন্দ্র রায়গুণাকরের ‘অন্নদা মঙ্গল’ কাব্যের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ছিল সাতক্ষীরার প্রত্যাপদিত্যের রাজকাহিনী। ১৮৬১ সালে সাতক্ষীরার প্রশাসনিক পরিবর্তন বিশেষ করে মহকুমার রূপান্তর, ১৮৬৩ সালে সাতক্ষীরার প্রথম ম্যাজিস্ট্রেট নবাব আব্দুল লতিফ কর্তৃক মুসলিম সাহিত্য সমাজ গঠন এবং বিশেষ করে এতদাঞ্চলের মানুষদের সাথে কলকাতাকেন্দ্রিক মূলধারায় অধিক সম্পৃক্ততা ইত্যাদি কারণে এই সময়ে সাতক্ষীরায় সাহিত্য চর্চার বিকাশ ঘটতে শুরু করে। এ সময় সাতক্ষীরার সাহিত্য বিকশিত হয় খান সাহেব আব্দুল ওয়ালী (১৮৫৫-১৯২৬), প্রথম মুসলিম কবি আজিজুননেছা খাতুন (১৮৬৪-১৯৪০), খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (১৮৭৩-১৯৬৫), মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী (১৮৯৬-১৯৫৪) প্রমুখদের অবিশ্রান্ত প্রচেষ্টায় আর সৃষ্টিশীল কলমে। ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের পর একই সাথে কলকাতা ও ঢাকাকেন্দ্রিক সাহিত্য চর্চার দ্বিমুখী স্রোতের প্রভাবে সাতক্ষীরার সাহিত্য একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের চিহ্ন বুকে ধারণ করে অগ্রসর হতে থাকে। দেশ বিভাগের পরে সিকান্দার আবু জাফর, একুশে পদকজয়ী আনিস সিদ্দিকী, গোলাম মঈনউদ্দীন, আবেদ খান প্রমুখদের চর্চায় এগিয়ে যায় এ অঞ্চলের সাহিত্য। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে সাহিত্য চর্চার সে উর্বর ভূমিকে নবরূপে সাজাতে যারা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন গাজী আজিজুর রহমান তাঁদের মধ্যে অন্যতম। অন্যকথায়, দক্ষিণাঞ্চলের রেখে যাওয়া সাহিত্যধারার যোগ্য উত্তরাধিকারী অধ্যাপক গাজী আজিজুর রহমান।
বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ গাজী আজিজুর রহমানের ইতিহাস চর্চার প্রতিভাকে শাণিত ও প্রাণিত করেছে। তাঁর রচিত কালীগঞ্জের ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধ বইয়ের বিষয়বিন্যাস পর্যালোচনা করলে তাঁর দক্ষতার পরিচয় মেলে। গাজী আজিজুর রহমানের লেখায় সাহিত্যের বহুমুখী পর্যবেক্ষণের নিজস্ব একটা অবস্থান রচিত হয়েছে। সাহিত্যকে শুধু মনোরঞ্জনের বাহক হিসেবে বিবেচনা না করে সাহিত্যকে দেখেছেন সমাজের প্রান্তিক লগ্নতার দৃষ্টিকোণে। সাহিত্যে বাস্তবতারধারা, সাতক্ষীরার ভাষা ও শব্দকোষ, আধুনিক বাংলা উপন্যাসের বিষয় ও শিল্পরূপ, সাহিত্য ও সিংহাসন- এসবগ্রন্থে তাঁর পাণ্ডিত্যের পরিচয় ফুটে ওঠে। তাঁর উপন্যাস, নাটকগুলোও নিজস্ব গল্পভূগোলে প্রসারিত। বজ্রের বাঁশি, যোদ্ধার জতুগৃহ প্রভৃতি লেখায় রয়েছে নিজস্বতার পরিচয়।
কেবল প্রান্তজনের কথাশিল্পী হিসেবেই নয়, একজন সাহিত্য ও সংস্কৃতির সংগঠক হিসেবে গাজী আজিজুর রহমানের ভূমিকা অনাগতকাল ধরে আমাদের স্মরণ করতে হবে। সাদা কাগজে কালো কলমের লাঙল চষে তিনি হয়েছেন শব্দশ্রমিক, পাশাপাশি শব্দের সে ফসল পাঠকের দ্বারে পৌঁছে দিতে তিনি হয়েছেন অক্লান্ত সাহিত্যকর্মী। সম্পাদক হিসেবেও গাজী আজিজুর রহমানের অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাঁর একক সম্পাদনায় প্রকাশিত খান আনসারউদ্দীন আহমেদ রচনাবলী, মরণরে তুঁহু মম উল্লেখ করার মতো। নিয়মিত সম্পাদনা করছেন ‘নদী’ নামে সাহিত্যপত্র। বাংলাদেশের প্রান্তিক সাহিত্যের ধারায় গাজী আজিজুর রহমান প্রকৃত প্রস্তাবেই নির্মাণ করেছেন নিজস্ব একটা ভুবন। সাহিত্যিক হিসেবে সামাজিক দায়বদ্ধতাকে তিনি কখনো বিস্মৃত হননি। ফলে তাঁর সব রচনার পশ্চাতেই থাকে একটা সামাজিক অঙ্গীকার, থাকে একটা প্রগতিশীল ভাবনা। তাঁর শিল্পীমানসে সব সময় সদর্থক ইতিহাস-চেতনাজাগ্রত থাকে বলে মানুষকে তিনি অনুভবের আয়ত চোখ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে সক্ষম হয়েছেন। সাহিত্যচর্চায় তিনি তাঁর স্বকীয় বিদ্যা ও বুদ্ধির উৎসারণ ঘটিয়েছেন অবলীলায়, অবাধে ও অকপটে। তীক্ষ্ণমনীষা, সূক্ষ্ম অন্তর্জান, স্বতঃস্ফূর্ত রসানুভূতি ও সপ্রতিভ শব্দশিল্পের অধিকারী বলে তাঁর সাহিত্যিক বর্ণনা ও শিল্পবোধ পারস্পারিক অনুরণনে অগ্রসর হয়েছে।
সাহিত্য অঙ্গণে অর্ধ শতাব্দীকালব্যাপী তাঁর যে দীর্ঘ পথচলা, সে স্বীকৃতি তিনি পেয়েছেন থরে-বিথরে। তবে এসব সম্মাননার চেয়ে বড় স্বীকৃতি বোধহয় সবকিছুকে ছাড়িয়ে তিনি হয়ে উঠতে পেরেছেন বাংলা সাহিত্যে প্রান্তজনের মুখপাত্র।
পঁচাত্তর অতিক্রমী এই সাহিত্যিকের কাছে আমাদের আরও অনেক কিছু পাওয়ার আছে। প্রান্তজনের আরও অনেক না বলা কথা অনুষঙ্গ হবে তাঁর কথাশিল্পে। ইতিহাসের অনেক প্রত্যয় শাণিত হবে তাঁর গবেষণায়। তাই তাঁকে সুস্থ থাকতে হবে, থাকতে হবে বিগত অর্ধশতাব্দীর মতো কর্মচঞ্চল। সজনে ফুল কিংবা চালতা ফুলের মতো শ্বেত-শুভ্র পবিত্র মধ্যমণি হয়ে থাকতে হবে সাহিত্যের গহনে। আলোক পিয়াসী গাজী আজিজুর রহমান এই পৃথিবীর আলো-আঁধারের জীবনে আলোকেই নিরন্তর খুঁজে ফিরেছেন। পৃথিবীর নিত্য দিনের আলোয় আলোকিত হোক তাঁর জীবন। প্লাটিনাম জন্মজয়ন্তীতে স্যারের জন্য নিরন্তর শুভকামনা।