সারাদেশ দ্রোহের আগুণে টলটলায়মান, চট্টগ্রাম ও ঢাকার প্রতিরোধ এবং শ্রীহট্ট, যশোর, রংপুর, দিনাজপুরেও উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। বিদ্রোহ দমনে সেখানেও বাড়তি ইউরোপিয় সৈন্য মোতায়েন করা হয়। পলাতক সিপাহি ও ইউরোপীয় সৈন্যদের মধ্যে শ্রীহট্ট যশোর সহ কয়েকটি স্থানে সংঘর্ষ ঘটে, এতে উভয় পক্ষেরই প্রাণহানি ঘটে। এসকল স্থানে বন্দি নিরস্ত্র সিপাহিদের স্থানীয় বিচারক দ্বারা সংক্ষিপ্ত বিচারে ফাঁসি ও দীপান্তর দন্ড দেয়া হয়…
জোত-জমিদারগণ সিপাহিদের বিরুদ্ধে ছিলেন, তাদের মধ্যে কেউ কেউ আবার ইংরেজদের গরু ঘোড়ার গাড়ি এবং হাতি সরবরাহ করতো, পলাতক সিপাহিদের সন্ধান এবং বিদ্রোহী সিপাহিদের প্রতিরোধ করার লক্ষ্যে স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গড়ে কোম্পানিকে সমর্থন করে। সরকার পরে তাঁদেরকে নওয়াব, খান বাহাদুর, খান সাহেব, রায় বাহাদুর, রায় সাহেব প্রভৃতি উপাধিতে ভূষিত করাসহ নানাভাবে পুরস্কৃত করে। মধ্যবিত্ত শ্রেণিও কোম্পানি সরকারের পক্ষে অবস্থান নেয় আর সাধারণ মানুষ ও কৃষক এ বিষয়ে বরাবরেই মতোই উদাসীন…!
বিদ্রোহীরা সিদ্ধান্ত নেয় তারা ইংরেজ রাজত্ব ছেড়ে স্বাধীন ত্রিপুরার নিরাপদ আশ্রয়ে গিয়ে সেখান থেকে দেশ মুক্ত করবেন। বিদ্রোহী সিপাইদের নেতৃত্বে হাবিলদার রজব আলী খাঁ সঙ্গে সিপাহী জামাল খাঁ। প্রায় ৪০০ বিদ্রোহী সিপাহী আর ২০০ জেলমুক্ত দেশপ্রেমিক বাহিনী নিয়ে ফেনী নদী পার হয়ে তাঁরা ত্রিপুরা সীমানার দিকে রওনা হন। তবে তার আগেই চট্টগ্রামের কমিশনার ত্রিপুরার মহারাজা মিত্র ঈশান চন্দ্র মানিক্যের কাছে বিদ্রোহী সিপাইদের প্রতিহত করার অনুরোধ পত্র পাঠান। বিদ্রোহীরা সীতাকুন্ড হয়ে ২রা ডিসেম্বর ত্রিপুরার সীমান্তে পৌঁছেই স্বাধীন মহারাজার বাহিনীর হামলার শিকার হয়। তাদের কাছ থেকে মহারাজার বাহিনী লুণ্ঠিত হাতি ঘোড়া ও টাকা ছিনিয়ে নেয়। রসদ হারিয়ে বিদ্রোহীরা অনেকটাই দূর্বল হয়ে পড়ে। তারা কুমিল্লার পাহাড়ি এলাকা দিয়ে শ্রীহট্টের দিকে অগ্রসর হতে থাকে, কিন্তু ত্রিপুরার সেনাবাহিনী তাদেরকে ধাওয়া করে। বিদ্রোহীরা দুর্গম পাহাড়ি জঙ্গল পাড়ি দিয়ে মণিপুর রাজ্যের কাছাকাছি শ্রীহট্ট পৌছায়…
সেখানে লাইট ইনফ্যান্ট্রির মেজর বাইং (Major Baing) বিদ্রোহীদের উপর হামলা করে। তীব্র যুদ্ধে মেজর বাইং নিহত হয় এবং ইংরেজ বাহিনী পরাজিত হয়। এরপরেও ইংরেজ ও স্থানীয় বাহিনীর সাথে সঙ্গে তাদের খন্ড খন্ড যুদ্ধ চলতে থাকে। প্রতিনিয়ত আক্রমণ, খাবারের অভাবে বিদ্রোহীদের লোকবল কমতে থাকে। যারা বেঁচে ছিলো আক্রমণের তীব্রতায় শেষ পর্যন্ত তারা পার্বত্য অঞ্চলে গিয়ে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয…
হাবিলদার রজব আলী শেষ বারের মত যুদ্ধে অবতীর্ণ হন ১৮৫৮ সালের ৮ ই জানুয়ারী করিমগঞ্জের মালগ্রামে। বিদ্রোহী বাহিনী পার্বত্য এলাকা কাছাড়, হাইলাকান্দি এলাকা পাড়ি দিয়ে মোহনপুর চা বাগানের নিকটবর্তী সাবাশপুরে অবস্থান নেয়। কিন্তু জমিদারের গুপ্তচরদের মাধ্যমে ইংরেজ বাহিনী খবর পেয়ে লেফটেন্যান্ট রসের (Lieutenant Ross) নেতৃত্বে অতর্কিতে হামলা করে। হাবিলদার রজব আলী তার অল্প সংখ্যক সৈন্য নিয়ে প্রতিরোধ যুদ্ধ চালাতে থাকেন। যুদ্ধে ৭০ জন বিদ্রোহী সিপাহী মারা যায়, এছাড়াও আহত হয়ে এবং ক্ষুধা যন্ত্রনায় মারা যায় আরো কয়েক জন। হাবিলদার রজব আলী সহ চারজন ইংরেজ দ্রোহী এযুদ্ধে বেঁচে যান, অব্যাহত আক্রমনের মুখে তারা গহীন পাহাড়ী জঙ্গলের মাঝে হারিয়ে যান। তারপর আর কেউ তাঁদের খোঁজ জানতে পারেনি…
টলে পড়ে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির গদী…
মহা-বিদ্রোহের অন্যান্য নায়কদের মতো হাবিলদার রজব আলীকে মনে রাখেনি বাঙ্গালী। প্রায় শতবর্ষ পরে তদানিন্তন ফরিদপুর বর্তমান গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়ার সন্তান চিত্র পরিচালক ও গীতিকার মোহিনী চৌধুরী মহা-বিদ্রোহের সেই মহানায়কদের স্মরণে রচনা করেন অমর এই গান, যা আজও প্রাণে দোলা দেয়
মুক্তির মন্দির সোপানতলে
কত প্রাণ হলো বলিদান
লেখা আছে অশ্রুজলে
কত বিপ্লবী বন্ধুর রক্তে রাঙা
বন্দীশালায় ঐ শিকল ভাঙা
তারা কি ফিরিবে আর
তারা কি ফিরিবে এই সুপ্রভাতে
যত তরুণ অরুণ গেছে অস্তাচলে
যারা স্বর্গগত তারা এখনো জানে
স্বর্গের চেয়ে প্রিয় জন্মভূমি
এসো স্বদেশব্রতের সহদীক্ষালোভী
সেই মৃত্যুঞ্জয়ীদের চরণচুমি
যারা জীর্ণজাতির বুকে জাগালো আশা
মৌন মলিন মুখে জাগালো ভাষা
সাজি রক্তকমলে গাঁথা মাল্যখানি
বিজয়লক্ষ্মী দেবে তাঁদেরি গলে
*** মৃত্যুঞ্জয়ী হাবিলদার রজব আলী, সিপাহী জামাল খাঁ’দের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা
লেখকঃ বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমির আইন প্রশিক্ষক Hasan Hafizur Rahman