কদিন থেকে খুব বৃষ্টি নামছে, দিনে রাতে একে বারে মুসলধারে। রাস্তায় জমা জল গতি কমছে বাহনের, বদ্ধ জলে ভাসমান কাগজ, প্লাষ্টিকের বোতল, টুকরো পলিথিন, জৌলুশ হারানো শুকনো ফুলের তোড়া ভেসে ভেসে ভিন্ন মাত্রার দৃশ্যের অবতারনা করছে। বরষা মৌসুমে ফেস বুকে স্কুলগামী কিশোর-কিশোরীর বৃষ্টিতে ভেজা আর পথে জমা জল পায়ে ছিটিয়ে সহপাঠিদের
ভিজিয়ে দেয়া দেখে ভিষণ নষ্টালজিক হচ্ছি। এ কালের স্কুল জীবনের সেই দৃশ্যের সাথে হয়তো আমাদের সময়ের দৃশ্যগুলো পুরোপুরি মিলে না, তবুও কৈশরের স্মৃতিটুকুই হচ্ছে জীবনের সোনালী অধ্যায়।
এরকম মেঘলা দিনে মিলতো হঠাৎ ছুটি,কারণ মেঠো রাস্তা ভরে যেত কাদায়, রাস্তা হত পিচ্ছিল আর অধিকাংশের ছিলনা কোনও বর্ষাতি। আর থাকলেইবা কী! বর্ষাকালে শ্রষ্টাকে কতইনা ডেকেছি বৃষ্টিটা যেন স্কুলে যাওয়ার সময়েই আসে, তারপর থেমে যাক সমস্যা নেই! কালে ভদ্রে সে প্রার্থনা মঞ্জুরও হয়েছে। বৃষ্টির দিনে বড়রা কাজে যেত না, এমনকি বাজারেও না, এই তালে আমাদেরও স্কুল ছুটি। বৈঠকখানায় বসতো পারিবারিক আড্ডা। স্বৈরাচারী গার্জিয়ান যারা অন্যদিন সারাক্ষণ পিছনে লেগে থাকতো, ভরা বর্ষায় তারাও কেন জানি নমনীয় হয়ে যেত।
তখনও দেশে মোবাইল ফোন আসেনি, জল জমা বর্ষায় আমাদের সময় কাটানোর সবচেয়ে বড় হাতিয়ার ছিল কাগজের নৌকা।
কাগজের নৌকার হদিস প্রথম মিলেছিল ১৪৯৮ সালে ইউরোপে, তারপর এই Origami বিদ্যায় বিশ্বকে চমকিত করেছে চীন ও জাপান। কিন্তু ইউরোপের কাগুজে নৌকা কী করে বাংলার শিশুদের জনপ্রিয় খেলনায় পরিণত হল তা অবশ্য জানা যায়নি। তবে এ খেলনার বড় বিশেষত্ব হলো এটা কোনও খরচ ছাড়াই কম আয়োজনে নিজেরাই বানিয়ে ফেলা যায়। এমনকি লেখা খাতার পাতা ছিঁড়ে নৌকা বানানোয় মার খাওয়া শিশুর সংখ্যাও নেহাত কম নয়। আবার কখনো খাতার পাতা ছেঁড়ার কারণে বিপরীত পাতাটাও খুলে আসতো ফলে অনেক কষ্টে করা বাড়ির কাজের দরকারী পাতাটাও হয়ে যেত নিখোঁজ, সময়মতো স্যারের বেতও খুঁজে নিতো আপন ঠিকানা!
স্কুল ফেরত বাচ্চারা হৈ হৈ করে বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে কাগজের নৌকা ভাসাতে ভাসাতে বাড়ি ফেরার দৃশ্য আজকাল তেমন আর দেখা যায় না। ছোটদের কাগজের খেলনা বলে তা কিন্তু মোটেও মামুলি নয়, এ নৌকারও রকমফের আছে। দু’রকমের পাল তোলা নৌকার গঠনই ছিল জনপ্রিয়। তারমধ্যে আবার হরদম চোখে পড়ত তিনকোনা রঙিন পাল তোলা নৌকা। কাগজ ভাঁজ করতে করতেই ছোটরা শিখে ফেলত নৌকা বানানো। যত ছোট হবে নৌকা ততই মজবুত হবে, বড় নৌকা জলে বেশিক্ষণ ভাসতে পারে না, ফেঁসে যায় জলে!
ঝড়োবৃষ্টি কিংবা ঘন বরষার পর উঠোনে জল জমতো, সে জলে ভাসাতাম কাগজের নৌকা। অার যদি ঝিরি ঝিরি হাওয়া বইতো তবে তা নৌকোকে নেয়ে যেত জলের ওপাশে, মনে খেলে অন্য রকম ঢেউ। ইচ্ছে হতো সে নৌকায় লিখে দেই প্রিয় মানুষটার নাম, ভাসতে ভাসতে তা পৌছে যাক ঠিক তারই কাছে!
কাগজের নৌকা এখন শুধু নস্টালজিয়ায় বেঁচে আছে! ইচ্ছে করে আবারও জমে থাকা জলে প্রিয় মানুষটার নাম লিখে ভাসিয়ে কাগজের নৌকা, ঝিরিঝিরি বাতাসে পালে হাওয়া লেগে নৌকা পৌছে যাক সে মানুষটার উঠোনে। কিন্তু আজকাল কাগজের নৌকো ভাসানোর জায়গার বড়ই অভাব, গগণছোঁয়া ফ্ল্যাট বাড়িতে তো আর বর্ষার জল জমে না!
লেখকঃ Hasan Hafizur Rahman
দ্বীপ্রহর
২১ ভাদ্র ১৪৩০
রাজশাহী