ঢাকার মোহাম্মদপুরের বাসার নীচে রবিন অপেক্ষা করছে।আর সুমন দাঁড়িয়ে আছে মহাখালীতে। সন্ধ্যা সাতটা ত্রিশ মিনিটে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সে কোলকাতা যাবো। রবিনকে নিয়ে রওনা দিলাম। মহাখালী থেকে সুমনকে তুলে নিলাম গাড়িতে, এবার সোজা এয়ারপোর্ট। ইমিগ্রেশন শেষ করে বসে আছি। হাতে সময় বিশ মিনিট। প্ল্যান করছি আমরা। আমাদের কোলকাতার কাজ শেষে এবার কোথায় ঢুঁ মারবো। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি প্রস্তাব করলাম। ছোট দুই ভাই রাজি। প্লেন আকাশে ডানা মেললো। আমরা নির্দিষ্ট সময়ে নেতাজি সুবাস বোস ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে নেমে কাস্টমস সেরে বেরিয়ে সোজা মারকুইস স্ট্রীটে হোটেল সপ্তক এ। রাতে কস্তুরি তে খেলাম। রাস্তায় দাঁড়িয়ে দুধচা পান করছি, রাত তখন বারোটা। রুমে ফিরে সকালের অপেক্ষায় চোখ বন্ধ করলাম। রাতেই হোটেল ম্যানেজারকে বলে রেখেছিলাম।সকালে মিঃ কাল্লু শেখ এলেন। তিনি আমাদের প্রথমে নিয়ে যাবেন বড়োবাজার। তারপর সায়েন্স সিটি। দুই জায়গাতে আমাদের কাজ। এরপর আমাদের নিয়ে যাবেন জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়িতে। ট্যাক্সি ক্যাবে উঠলাম। গাড়ি চলছে। চোখের সামনে ভেসে উঠছে অনেক ছবি। মনে করো যেনো বিদেশ ঘুরে মা’কে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দূরে,তুমি যাচ্ছো মা পালকিতে চড়ে…. যে পালকিতে বসে গুরুদেব এমন মহৎ কবিতা লিখেছিলেন,সেই পালকি কি আজো আছে?? এমন প্রশ্ন মনে উঁকি দেয়। কোলকাতার এপথ ওপথ মাড়িয়ে বড়োবাজার। তারপর সায়েন্সসিটি গেলাম।কাজ সারলাম। তারপর আমাদেরকে কাল্লু শেখ দাঁড় করিয়ে দিলেন ইতিহাসের সামিয়ানার নীচে। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটে।আমরা পৌছে গেছি জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়িতে। আমরা টিকেট কেটে ( বাহিরে ছবি তুলতে চাইলে টিকেট কাটতে হয়) ভিতরে প্রবেশ করলাম। গুরুদেবের গাড়ি নজরে এলো। কাছে গেলাম। মনে হচ্ছিল গাড়ি রেডি, গুরুদেব এক্ষুনি বুঝি বের হবেন কোথাও। আমরা জুতা খুলে বাসার ভেতরে প্রবেশ করলাম। জমিদার বাড়ি। অসংখ্য ঘর। আমরা আস্তে আস্তে হেঁটে চলেছি। আমার মনে হচ্ছিল গুরুদেব আমাদের দেখছেন। গুরুদেবের বেডরুম,স্টাডিরুম, সাক্ষাৎ রুম, যে রুমে মৃত্যুবরণ করেন সেই রুম আমরা গেলাম। গুরুদেবের একটা পোশাক ঝুলছে। অত্যন্ত যত্নসহকারে কাঁচঘেরা জায়গায়। গুরুদেব যেখান থেকে দেহত্যাগ করেন সেই জায়গাটা কাঁচ দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। আঁতুড়ঘর দেখলাম। চিলেকোঠার রুম দেখলাম।যে আঙিনায় পালকিটা ছিলো আমরা সেই আঙিনায় দাঁড়ালাম। অদ্ভুত একটা শিহরণ বয়ে গেলো আমার শিরায় শিরায়। কয়েকজন আমেরিকান টুরিস্ট গুরুদেবের মুর্তির সামনে দাঁড়িয়ে আমাকে একটা ছবি তুলে দিতে অনুরোধ করায় আমি সানন্দে রাজি হয়ে কাজটা করলাম। পরে আমরা মোবাইল ফোনে আমাদের ছবি তুললাম। আমাদের ফটোগ্রাফার কাল্লু শেখ। তাঁকে আমরা ধন্যবাদ দিলাম। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়িতে গিয়ে একটা বিষয় বুঝেছি, তিনি দিনরাত সাহিত্য সাধনার মধ্যে দিয়ে ক্রমাগত সামনের দিকে এগিয়ে গেছেন। জীবন সংসারে তাঁর ধ্যান জ্ঞান চিন্তা চেতনা শুধুমাত্র সাহিত্য কেন্দ্রিক ছিলো। বংশ পরম্পরায় জমিদার ছিলেন। অর্থ বিত্তের অভাব গুরুদেবের ছিলোনা। মহাকালের স্বাক্ষী ঠাকুরবাড়ি, যা দেখলেই অনুমেয়। বিত্তের গড্ডালিকা প্রবাহে গুরুদেব সাঁতার কাটেননি। একটা সাধনার মধ্যে দিয়ে তিনি জীবন পাড়ি দিয়েছেন। আমাদের যাপিত জীবনে কষ্ট আছে। দুঃখ আছে। আমরা যাঁরা সাহিত্য চর্চা করতে চাই, আমাদের সাধনা করতে হবে। দিন-রাত। পড়াশোনা আর পড়াশোনা। সাহিত্য একটা জীবন চায়। সে জীবন শুধু সাহিত্যের জন্য।কষ্টকে হাসিমুখে মেনে নিয়ে অধ্যয়ন করে যেতে হবে। আধুনিক বিশ্বে বাস করে আমাদের মানসিকতা পাল্টাতে হবে। উন্নত রুচিসম্মত মানুষ হতে না পারলে মহত্তম সাহিত্য সৃষ্টি সম্ভব নয়। এই কথাগুলো আমি সুমন ও রবিনকে ঠাকুরবাড়ির আঙিনায় দাঁড়িয়ে বলেছিলাম ১০ এপ্রিল ২০১৯। আজ ১০ এপ্রিল ২০২০। এক বছর হয়ে গেলো। পৃথিবী এখন করোনা আক্রান্ত। সারা পৃথিবীতে মানুষ অসহায় হয়ে গেছে। সবাই গৃহবন্দী। বনের প্রাণীরা রাজপথে। একদিন আমাবস্যা কেটে যাবে, পূর্ণিমার চাঁদ উঠবে ঐ আকাশে। কার্বন ডাই অক্সাইড কমে পৃথিবী সবুজ হয়ে যাবে। নতুন পৃথিবীতে আমরা হয়তো অনেকেই থাকবোনা, কিন্তু যাঁরা থাকবেন, তাঁরা কেউ কেউ ঠাকুরবাড়ির আঙিনায় কদম ফেলবেন। গুরুদেবকে বুঝতে, গবেষণা করতে, ভ্রমণে ঠাকুর বাড়িতে সাহিত্য কর্মীরা ভীড় করবেন। তেমন দিনে যদি বেঁচে থাকি, তাহলে সুমন, রবিন, রফিক, শিবলী মোকতাদির, আবু রায়হান, কামরুন নাহার কুহেলী, মাশরুরা লাকী,সেতুসহ অনেকেই যাবো ঠাকুরবাড়ির আঙিনায়। গুরুদেবের চরণ ধন্য মাটিতে নিজেরা একটু মাটির ঘ্রাণ নিবো। ইতিহাস দেখার জন্য। বাংলা কবিতাকে যিনি বিশ্ব দুয়ারে পৌঁছে দিয়েছেন তাঁর জন্ম মাটিতে আমরা একটা বেলা কাটিয়ে দিবো সূর্যকে মাথায় নিয়ে। সূর্যাস্ত দেখবো ঠাকুর বাড়ির আঙিনায় দাঁড়িয়ে।
তৌফিক জহুর
কবি ও সম্পাদক,
উদ্যান