হৃদয়ে মিশে থাকা একটি নাম বাংলাদেশ পুলিশ। জানি, শত সহস্র অভিমান দেশবাসীর আমাদের নিয়ে। কিন্তু জানেন আমাদের অভিমান করে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার উপায় নেই। কারণ এই পোশাক গায়ে জড়ানোর সময় শপথ নিয়েছিলাম, দেশ মাতার জন্য দরকার হলে নিজের জীবন দিয়ে দেবো তবুও পিছপা হবো না। যত ভর্ৎসনা, তিরস্কার করুক না কেনো আমাদের মান অভিমান থাকতে নেই। আমাদের থাকতে নেই প্রতিবাদ করে ডিউটি অবহেলা করার আবদার। কারণ আমরা যে পুলিশ।
চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি আমাদের প্রাণপ্রিয় পুলিশ ভাইয়েরা প্রতিনিয়ত হাসিমুখে ঝুঁকিপূর্ণ পথে জীবনের মোহ-মায়া ত্যাগ করে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। শুধু বাংলাদেশ নামক একটি ফুল আর তার পাপড়িগুলো বাঁচানোর জন্য। জানেন এত কিছুর পরেও বুক ভরে ওঠে এক সমুদ্র গর্বে। কয়জনের সৌভাগ্য হয় দেশকে এই ক্রান্তিকাল থেকে টেনে তোলার? কয়জনের সৌভাগ্য হয় দেশকে প্রতিটি মুহুর্ত আগলে রাখার? আমি ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের প্রোটেকশন বিভাগে অতিরিক্ত উপ পুলিশ কমিশনার (এডিসি) হিসেবে দায়িত্বরত। দেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে যে প্রয়োজনীয় সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয়, তা আমার সিনিয়র অফিসারদের নির্দেশ মেনে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছি।
দেশের এই ক্রান্তিকালের শুরু থেকেই পুলিশের কাজের পরিধি আরও বেড়ে গেছে। সেই কাজের ফিরিস্তি আর নাইবা দিলাম। প্রতিদিন দেখতে পাচ্ছি করোনাভাইরাসের কারণে অনেক মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন। নিরাপদ থাকার জন্য সবাই ঘরবন্দি থাকার চেষ্টা করছে। কিন্তু ‘নিরাপদ’ শব্দটা পুলিশ নিজের জন্য প্রযোজ্য না রেখে অন্যের নিরাপত্তায় কাজ করে যাচ্ছে। যার ফলস্বরূপ অনেক পুলিশ সদস্য ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছেন। শহীদও হয়েছেন ছয়জন। আমাদের পাশাপাশি করোনার বিরুদ্ধে চিকিৎসকরাও কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করে যাচ্ছেন। কিন্তু তারা জানছেন না কে আক্রান্ত? তেমননি পুলিশ ও জানেনা কে আক্রান্ত আর কে সুস্থ!
ঢাকা রেঞ্জ ডিআইজি প্রিয় হাবিবুর রহমান স্যারের একটা কথা মনে পড়ে গেল। স্যার বলেন- ‘চিকিৎসকরা সরাসরি দৃশ্যমান শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ করছেন। আর পুলিশ সরাসরি যুদ্ধ করছে কিন্তু সেটা অদৃশ্য শত্রুর সঙ্গে। কেউ জানে না, কে আক্রান্ত।’ প্রটেকশন বিভাগে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আমার সহকর্মী ইন্সপেক্টর সারওয়ার করোনা পজিটিভ ধরা পড়ে। ধীরে ধীরে সংখ্যা বাড়তে থাকে, আমার সহকর্মীদের কথা ভেবে খুব খারাপ লাগত। তবে আমার সরাসরি করোনা যুদ্ধে অংশ নেওয়ার সুযোগ কম ছিল। এতে হয়ত আমার শুভাকাঙক্ষীরা খুশি হচ্ছিল এই ভেবে, যে আমি বিপদ থেকে দূরে আছি। কিন্তু আমার মনের ভেতরে প্রতিনিয়ত যেন একটা জিনিস কাজ করছিল, যেন একটা সুযোগ খুঁজছিল করোনা আক্রান্ত পুলিশদের নিয়ে সম্মুখভাগে থেকে কিছু করার। সৃষ্টিকর্তার কি কুদরত আমি সেই সুযোগ পেয়ে গেলাম।
রাজারবাগ কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে রোগীর জায়গা হচ্ছিল না। তাই ‘ট্রাফিক বেরাক’ খালি করে সেখানে বাড়তি সুবিধার ব্যবস্থা করা হলো। ডিএমপির পুলিশ কমিশনার মহোদয় আমাকে সমন্বয়ক করে সহকারী পুলিশ কমিশনারে (এসি) মহিউদ্দিনসহ আরও দশজনকে দায়িত্ব দিলেন সার্বিক ব্যবস্থাপনার। হেডকোয়ার্টারের যুগ্ম কমিশনার শাফিউর রহমান স্যার এবং অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) হেডকোয়ার্টার ফয়জুর রহমান স্যারের তত্ত্বাবধানে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। অন্যদিকে আইজিপি ড. বেনজীর আহমেদ স্যার আমাদের (পুলিশের) কথা ভেবে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করে আলাদা আরও একটা হাসপাতাল (ইমপালস হাসপাতাল) ভাড়া নিয়েছেন। সেখানেও করোনা যুদ্ধের আয়োজন হচ্ছে। নিজ বাহিনীর সদস্যদের প্রতি আইজিপি স্যারের যে আন্তরিকতা, মমতা, দায়িত্ববোধ তা অন্যত্র একদম বিরল।
ঢাকায় পরিবারের কাছেও থাকি না, আলাদা থাকছি পরিবারের কথা ভেবে। বাচ্চারা আমায় না দেখে কান্নাকাটি করে। পরিস্থিতি সঠিকভাবে আঁচ করতে পারলাম এখানে আসার পর। পুলিশের অনেকেই আক্রান্ত হচ্ছেন প্রতিনিয়ত। টেস্ট করাচ্ছেন, ভর্তি হচ্ছেন। প্রতিনিয়ত থাকতে হচ্ছে তাদের সঙ্গে। ক্রমেই প্রতিদিনই সংখ্যা বাড়ছে। এরমধ্যে কেউ আবার সুস্থ হয়ে ডিউটিতে ফিরছেন। করোনা আক্রান্ত হলে সাধারণ রোগীদের বেশিরভাগ আতঙ্কিত দেখা যায়। কিন্তু পুলিশ সদস্যদের মধ্যে উল্টোটা দেখছি। এক অদৃশ্য উন্মাদনায় যেন তারা হাসি মুখে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছিল।
এক পুলিশ সদস্যকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কি ভয় পাচ্ছো? সে হাস্যোজ্জ্বল কন্ঠে বলল- ‘স্যার আমাদের ভয় পেতে নেই। আমরা ভয় পেলে তাহলে দেশ নির্ভয়ে রবে কিভাবে!’ আজ সুস্থ হবার পর একজনকে বললাম এখন কোথায় যাবেন? জবাবে উত্তর দিল, ‘স্যার আবার নামবো করোনা যুদ্ধে’। চোখ দুটো যেন ভিজে উঠল আমার। তড়িঘড়ি করে সেখান থেকে সরে এলাম। ভাবতে লাগলাম চাকরি জীবন নিয়ে। আজ বড় গর্ব হয় এই ভেবে, আজ যাদের টাকায় আমরা পুলিশ, তাদের নিরাপদ রাখতে আজ আমরা বদ্ধপরিকর। জ্বি হ্যাঁ, আমি সেই পুলিশ। আমরা সেই গর্বিত পুলিশ।
লেখক: অতিরিক্ত উপ পুলিশ কমিশনার, প্রটেকশন বিভাগ, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ, ডিএমপি।