সমসাময়িক কবিদের নিয়ে লেখায় একটা মুশকিল আছে। বিশেষ করে সেটা যদি হয় নব্বই দশকের। আমাদের নব্বই দশকের কবিদের কাব্য ঢেউ যখন শুরু হয় তখন পৃথিবীতে আধুনিকতা, উত্তরাধুনিকতার একটা প্রবল দার্শনিক ঢেউ আছড়ে পড়ছিলো সাহিত্যের বালুকাবেলায়। নব্বই দশকের কবিতায় বহুপথ।বহুমত। বহু দিক নিয়ে কবিরা কবিতা চর্চার মধ্যে কাজ করেছেন। সেই ধারাবাহিকতায় নব্বইয়ের কবিরা আজো অবাক সচল। কবি সাখাওয়াত টিপু নব্বই দশকের কবি। আমার বন্ধু। একুশে বইমেলা (২০২০) এ তাঁর ‘ রাজার কঙ্কাল’ কাব্যগ্রন্থটি পৃথিবীতে পয়দা হয়। সেই গ্রন্থ নিয়েই আজকের বয়ান।
চৈতন্যের গভীরে একজন কবি যখন অনুভব করেন ও বুঝতে পারেন, যে কোনো বিবর্তনের নিয়মেই মনের প্রতিচ্ছবি ধরা পড়ে শিল্পের শরীরে সবচেয়ে বেশি মাত্রায়,তখন কবির কবিতায় সে চিত্র অন্কিত হয়ে যায়, অবলীলায়। কবি যখন নিঃসঙ্গ ব্যক্তির আকুতি, প্রকৃতি, পরিবেশ ও সমাজের নানান দিক নিয়ে ভাবনাচিন্তায় দোল খায় তখন তাঁর কবিতার ভাষা হয়ে ওঠে তির্যক। যা ইংগিত দেয়। কখনো সরাসরি বলে। কবিতার ভাষার মধ্যে দর্শনের প্রভাব ফেলে। সাখাওয়াত টিপুর রাজার কঙ্কাল’ পাঠ করতে যেয়ে বারবার আমার মানস পর্দায় মার্কসীয় দর্শন এসে দাঁড়ায়। মনে হয়েছে তাঁর সাহিত্য রুচির চিন্তাশীল তরিকা উক্ত দর্শন দ্বারাই বিশেষিকৃত। মানবিক সম্পর্ক পুনরুদ্ধার ঘটে ভাষার নিরূপিত বিষয় ও ছন্দের অদ্বৈত সক্রিয়তার সহযোগে। এটাও মার্কসীয় নন্দনতত্ত্বে অন্তর্নিহিত। সাখাওয়াত টিপু তাঁর কবিতায় যুক্তি-বুদ্ধি ও বিজ্ঞানের পরিণতিতে ধনতান্ত্রিক উৎপাদন বিশেষত শ্রমবিভাজনের শৃংখলের, অনন্বয়ের মধ্যে থেকে উদ্ধার করে আনতে চেয়েছেন মানবিক সম্পর্কের সমগ্রতা ও বৈভব।মানবিক অন্বয়ের এই কার্যকারণেই তাঁর কবিসত্তা মার্কসীয় দর্শনের চাদরে আবৃত। যেখানে মানুষের সম্বন্ধ সমূহ অনুধাবনে সহায়তা করে,মানুষের শক্তির দিক সম্পর্কে অবহিত করে এবং অমিয় সম্ভাবনার দিকে ধাবিত করে। সাখাওয়াত টিপুর কবিতা নিয়ে কথা বলতে যেয়ে মার্কসীয় দর্শন নিয়ে কথা বলছি। কারণ রাজার কঙ্কাল’ কাব্যগ্রন্থে এই দর্শনের প্রভাব ব্যাপক। মার্কস সম্বন্ধে ত্রিশের কবি বিষ্ণু দে তাঁর “সাহিত্যে সেকাল থেকে মার্কসীয় কাল” প্রবন্ধ “সেকাল থেকে একাল” কলকাতা ১৯৮০, পৃষ্ঠা ১৯ এ বলছেন, ” মার্কসের বিশ্ব কৌষিক মনের বিরাট কতৃত্বের জুড়ি বোধহয় পৃথিবীতে আর হয়নি। মুষ্টিমেয় বিশ্বমানবদের মধ্যে তিনিই বোধ হয় বিজ্ঞানে বুদ্ধিতে শ্রেষ্ঠ মননশীল এবং সবচেয়ে নৈর্ব্যক্তিকভাবে মানবিক,অধিকন্ত তাঁর ছিলস্বীয় চিন্তার প্রক্রিয়ারই প্রবল যন্ত্র যার আলোক রশ্মিতে উদ্ভাসিত হয়েছিল দূরের অস্পষ্ট অনেক কিছু। সবচেয়ে বড়ো কথা যে তাঁর চিন্তা ও ক্রিয়াকর্মের কল্যাণে পরবর্তী আমরা সবাই পেয়েছি সর্বমানবের ইতিহাস বিষয়ে কাজ করবার বৈজ্ঞানিক রীতিটি আর পুরোধা তথ্য ও তত্ত্ব সন্ধানের উত্তরাধিকার “।
কবিতা চিরটাকাল একটা নতুন ঘোরের মধ্যে দিয়ে ক্রমাগত সামনের দিকে এগিয়ে যায়। সাখাওয়াত টিপু কি নতুন ভাষায় কবিতা লিখছেন? না। তিনি চিরায়ত ভাষায় কবিতা লিখে চলেছেন।কিন্তু একটা চিন্তা, একটা দর্শনের আবহ তাঁর কবিতার শরীরে খুঁজে পাওয়া যায়। কবির কবিতায় দেশ, কাল, সীমানা একটা বিশাল প্রান্তর জুড়ে অবস্থান করে। যে জায়গা থেকে কবি ইংগিত করেন, সেখানে সমাজ ও রাষ্ট্রের মেঘময় বিষয় চলে আসে। একজন কবি যখন সে বিষয়ে কবিতা লিখেন তখন কবির চিন্তার স্রোতে পাঠক সাঁতরে খুঁজে পায় দর্শনের মণিমাণিক্য । আমরা সাখাওয়াত টিপুর কয়েকটি কবিতা লক্ষ্য করিঃ
১.
একদিন মানুষের কথা বলা বন্ধ হবে মধ্যরাতে
আকাশে প্যাচারা, ঘেউ ঘেউ করবে কুকুর
একদিন রাজপথ শেয়ালেরই দখলে যাবে
দেখিলাম স্বপ্নে, কাক কাকেরই গোস্ত খাবে।
(রাষ্ট্র মরা দেখা, পৃষ্ঠা ১৫)
২.
শহরের কাকগুলো কবরে ঘুমায়
রাত হলে কালো পরি সাদা হয়ে যায়
চোখগুলো চাঁদ হয়ে ডুবে যায় মেঘে!
কী এক অদ্ভুত মায়া হারানোর খেলা
দুনিয়ায় রেখা আর দেখার আকাশ!
রাতে ভেসে আসে নৃত্যপর বাদামি পা
হাবসির মতো ফেরেশতার নিঃসঙ্গ লাশ!
মানুষ এখনো বোবা,বড় ছদ্মবেশি
কাকই কেবল শহরের প্রতিবেশি!
(শহর কোথায় থাকে, পৃষ্ঠা ১৪)
৩.
গাবো, তোমাকে ছাড়া তুমি কি পাবো
ওই দিকে তিস্তা বয়ে যায় মরুকাবেলায়
প্রগাঢ় সন্ধ্যায়, যাদু যে বাস্তব সেথাশ
যাদু যে সত্য এথায়, মানুষের মুখশ্রীগুলো
মরিবার আগে উই কেনো ডানা ঝাপটায়?
( মার্কেজের কথা ভেবো, পৃষ্ঠা ২১)
ইংগিত আছে। প্রথম উদ্ধৃতিতে ছন্দ আছে। কবি হৃদয়ে বিদ্রোহ আছে। ইন্দ্রিয়ের মধ্যে দিয়ে কবির কবিতার জগৎ হৃদয়ে পৌঁছে। যে বিষয়ের অবতারণা কবি করেছেন, তা কুয়াশার মতো রূপহীন,বরফের মতো পবিত্র ও সংহত। সাখাওয়াত টিপুর কবিতা পাঠে মনে হয়েছে, বহির্জগত থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে গভীরতম অন্তর্জগৎ দিয়ে শিল্পকর্ম সৃষ্টিতে আত্মমগ্ন তাঁর কবিতার আকাশ। মানব সমাজের সামগ্রিক অভিজ্ঞতায় ঐশ্বর্যের ডালপালা বিস্তার করে আছে তাঁর কবিতায়। তাঁর কবিতার মাঝে রাজনীতি একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রত্যেক কবিই নিজের কবিতায় উপযুক্ত ভাষা নির্মাণে আত্মনিয়োগ করেন। আধুনিক বাংলা কবিতার ইতিহাসে এটা লক্ষ্য করা যায়। রবীন্দ্রনাথের ভাষা নিয়ে রবীন্দ্রোত্তর কাব্যসৃষ্টি যে অসম্ভব তা পূর্বসূরী ও নিজেদের অভিজ্ঞতার মাধ্যমেই তাঁরা বুঝেছিলেন। আধুনিক কথ্যভাষার সঙ্গে সম্পর্কান্বিত আধুনিক কাব্যের ভাষা সৃষ্টিতে বুদ্ধদেব বসু নিরলস কাজ করেছেন। ‘ রাজার কঙ্কাল’ পাঠ করতে যেয়ে আমার মনে হয়েছে, কবি সাখাওয়াত টিপু ভাষা নির্মাণে সতর্কতার সঙ্গে নিজের একটা রাস্তা তৈরি করছেন। আমরা কবিতা লক্ষ্য করিঃ
১. ভাষা ভাগ হয়ে যায়,ইস!
মনকেও কেটে নেয় দেশ
উনো মানুষের সবিশেষ
বুনো সফেদ সাতচল্লিশ!
মানুষ এতো যে কাঁদে
কূল কুষ্ঠি ধরে,ফাঁদে
রক্ত- জল ভেসে ভেসে
ভাগ্যের মাদুলি পরে?
( ১৯৪৭, পৃষ্ঠা ১২)
২.
যদি ডুবে যাও তরীটির নীচে
মাঠের পরের মাঠ,জল নেই, চরাচরে
নদীর পরের চর,স্রোতহীন,পারাপারে
স্মৃতি হয়ে থাকো মাটির কন্কাল।
( কে যেন বলছে অবলীলায়, পৃষ্ঠা ১৯)
৩.
ভিখারির সাধ আছে দাঁড়িয়ে মরায়
কে নেবে তাহার ভার দরিদ্র বাংলায়?
( ভিখারির সাধ, পৃষ্ঠা ২৪)
৪.সংস্কৃত খাতায় গোলাপ ফুটছে কালো
আলালের ঘরের দুলাল নিশ্চয় আমার চেয়ে ভালো।
( হরিচরণের তলে, পৃষ্ঠা ২৪)
৫.
প্রভু আর দাসে
ভাগ হওয়া দেশে
তুমি কোন কূলে আছো
মে দিবসে?
( সহজ দর্শন, পৃষ্ঠা ২৬)
আমরা কথা বলছিলাম সাখাওয়াত টিপুর ‘ রাজার কঙ্কাল’ কাব্য গ্রন্থ নিয়ে। তিনি একটা ভাষা নির্মাণের চেষ্টা করছেন। আমাদের আলোচনার টর্চের আলো আমরা আপাতত এখানেই স্থির করছি। দেশ, সমাজ, রাষ্ট্র, রাজনীতি নিয়ে সবকালেই কবিরা কবিতা লিখেন। কবি সব সময় সঠিক, ন্যায়, সত্যের মাধ্যমে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করেন। টিপুও সেই কাজটিই করেছেন। কিন্তু ভাষাকে নিজের মতো করে প্রয়োগ করেছেন। প্রথমে আলোচনার শুরুতে আমি মার্কসীয় দর্শন নিয়ে কিছু বয়ান করেছি। কারণ, কবিতার মাঝে যদি চিন্তা ও চেতনার রূপ সমন্বয় করে প্রকাশ পায় তাহলে সেই কবিতা কাল পেরিয়ে মহাকালের আঙিনায় যাওয়ার পথ তৈরি করে। যদি সেখানে নিজস্ব ভাষা নির্মাণ হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পরবর্তী নজরুলের ভাষা লক্ষ্য করলে বোঝা যায়। সেখানে ত্রিশের আধুনিক কবিদের কবিতা বিশেষ করে জীবনানন্দ দাশ পাঠ করলে স্পষ্ট হয়ে যায়, নিজস্ব ভাষা নির্মাণ কতোটা জরুরি একজন কবির জন্য। ড. বাসন্তীকুমার মুখোপাধ্যায় “আধুনিক বাংলা কবিতার রূপরেখা ” গ্রন্থে লিখেছেন, “আধুনিক কবিদের মধ্যে যাঁরা প্রধান তাঁদের প্রত্যেকেই নিজের বক্তব্য বিষয়ের উপযুক্ত ভাষা নির্মাণে আত্মনিয়োগ করতে হয়েছে।” ( পৃষ্ঠা ১৭৪)। এই কথার অনুরণন পাওয়া যায় জসীমউদ্দিন, আল মাহমুদের ক্ষেত্রে। আমরা সাখাওয়াত টিপুর একটি কবিতা লক্ষ্য করিঃ
প্রাণ হাতে লিয়ে যাস কৈ,মোমিন?
পেছনে পুলিশ আর সামনে আজরাইল
কত রক্তে ডুবে যাচ্ছে শিমারের দিল?
কোনো কিছু মজা নাইরে, মোমিন!
দিনে সাতবার গোত্তা খায় কে, মোমিন!
রাজার কিভাবে কাটে দিন, কস কি মোমিন!
(কস কি মোমিন!, পৃষ্ঠা ২৩)
উপরে কয়েকটি কবিতার উদ্ধৃতি আর ” কস কি মোমিন” কবিতায় আমরা গভীরভাবে লক্ষ্য করলে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যায়। গতানুগতিক কবিতা যে ফরমেটে লেখা হচ্ছে সেখান থেকে আলাদা। কাব্যের নিজস্ব একটি জগৎ আছে। কবি সেই জগতে যখন সৌন্দর্য চেতনার মধ্যে দিয়ে বাস্তবতা তুলে আনেন, একটা বক্তব্য যখন অনায়াসে সূর্যের আলোর মতন পরিস্কার হয়ে যায় তখন সেই কবিতার দেহে ভর করে মাধুর্য যা পাঠকের হৃদয়ে ঝড় তোলে। সাখাওয়াত টিপুর কবিতা অম্লমধুর। দ্বন্দ্বমুখর। মননের সঙ্গে আবেগের, বুদ্ধির সঙ্গে প্রবৃত্তির,বাস্তবের সঙ্গে আদর্শের,ক্ষণিকের সঙ্গে চিরন্তনতার, দার্শনিক সত্তার সঙ্গে কবি সত্তার যৌথ সভা। দার্শনিক সত্তার সঙ্গে কবিসত্তার অভিজ্ঞতাকে মূলধন করে প্রশ্নের তির্যকতার মধ্যে দিয়ে টিপু তাঁর কবিতাকে নিয়ে গেছেন সৃষ্টিশীল পথে।’ সহজ দর্শন’, ‘আম্মা’, ‘মায়ের কবিতা’,’ আমরা কেমন দেশে, আব্বাজান’, ‘আব্বার মৃত্যুর পর’, ‘মৃত্যুর পরের রাতে”,’ লিচু চোষা বুদ্ধিজীবীগণ’, ‘তামাদি লেনিন’,’ময়নার দিকে যাচ্ছে লালফৌজ’,’হরতালে যা ঘটেছিল’,’শব্দের অধিক স্বাধীনতা ‘ কবিতাগুলো পাঠ করে চমকে ওঠে হৃদয়। প্রেম, আশা, স্বপ্ন সবকিছুই কবি হালকা চালে কিন্তু নিগুঢ় অর্থে ব্যক্ত করেছেন। শেষ পর্যন্ত কবিসত্তা দারুণভাবে সৃষ্টিশীলতা খুঁজে পেয়েছে।
বাংলা কবিতায় নব্বই দশক নানাদিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ। মৌলিক রচনার মধ্যে দিয়ে যাঁরা খ্যাতি অর্জন করেছেন নব্বই দশকে, সাখাওয়াত টিপু তাঁদের মধ্যে একজন। ‘রাজার কন্কাল’ কাব্য গ্রন্থে স্বদেশ ভাবনায় লিখিত কবিতাগুলিতে অনেক বিষয়ের আধিপত্য আছে। দর্শন, রাজনীতি ও কবিভাবনার ত্রয়ী মিশেল স্রোত আমাদের স্বদেশ ভাবনাকে উস্কে দেয়। অতিবাস্তববাদী কবিতা হিসেবে ‘ রাজার কঙ্কাল’ কাব্যগ্রন্থ আমাদের কাছে সমসাময়িক ঘটনাবলী ও দর্শনের চাদরে আবৃত এক নতুন কবিতা ভাষার দরোজা খুলে দিয়েছে। সাম্যের কবি হিসেবে সাখাওয়াত টিপুর এই কাব্যগ্রন্থ নিঃসন্দেহে সমাজের অসংগতির জন্য সূর্যের আলো। যে আলোয় পথ চলা যায়।