আকাশপথে দূরত্বটা কমবেশি ১৫ থেকে ১৮ মিনিটের। চিন সীমান্ত থেকে ঠিক এই দূরত্বেই যৌথ সামরিক মহড়া শুরু করছে ভারত ও আমেরিকার বায়ুসেনা। পশ্চিমবঙ্গের আকাশে টানা ১২ দিন ধরে ভারতীয় ও মার্কিন বিমানবাহিনীর দাপট নিঃসন্দেহে রক্তচাপ বাড়াতে চলেছে চিনের। পানাগড় এবং কলাইকুন্ডা বিমানঘাঁটির দিকে তাই এখন তীক্ষ্ণ নজর বেজিংয়ের।
৩ ডিসেম্বর শুরু হচ্ছে ভারত এবং আমেরিকার বায়ুসেনার যৌথ মহড়া ‘কোপ ইন্ডিয়া ২০১৯’। চলবে ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত। মহড়ার জন্য যে দু’টি বিমানঘাঁটিকে বেছে নেওয়া হয়েছে, তাতে এই মহড়ার তাৎপর্যই বদলে গিয়েছে বলে প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
পশ্চিম মেদিনীপুরের কলাইকুন্ডা এবং পশ্চিম বর্ধমানের পানাগড়— এই দুই বায়ুসেনা ঘাঁটিতে নামছে মার্কিন এয়ার ফোর্স। দুই বায়ুসেনার মধ্যে সহযোগিতা ও সংযোগ বৃদ্ধি, পরস্পরের কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ সামরিক কৌশল শেখা এবং বাহিনীর সক্ষমতা বাড়ানোর লক্ষ্যেই এই মহড়া। অর্থাৎ, পুরোদস্তুর যুদ্ধের মহড়াই চলবে পশ্চিমবঙ্গের আকাশে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চিন এবং ভারতের মধ্যে সীমান্ত নিয়ে যে রকম টানাপড়েন চলছে, তার প্রেক্ষিতে পশ্চিমবঙ্গের মতো এলাকায় ভারত-মার্কিন যৌথ মহড়া অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ ভারত-চিন সামরিক টানাপড়েনের প্রশ্নে পশ্চিমবঙ্গের অবস্থান ভূকৌশলগত ভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
মহড়ায় অংশ নেওয়ার জন্য জাপানের কাদেনা বিমানঘাঁটি থেকে ১৫টি মার্কিন যুদ্ধবিমান পৌঁছচ্ছে পশ্চিমবঙ্গে। আর আসছে মার্কিন বায়ুসেনার ইলিনয় এয়ার ন্যাশনাল গার্ডের ১৮২ডি এয়ারলিফ্ট উইং।
কলাইকুন্ডা বিমানঘাঁটিতে ভারতীয় বায়ুসেনার পাইলটদের অ্যাডভান্স ট্রেনিং হয়। অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্তা কর্নেল সৌমিত্র রায়ের কথায়: ‘‘বায়ুসেনার পাইলটরা সর্বোচ্চ পর্যায়ের সামরিক কৌশল কলাইকুন্ডা বিমানঘাঁটিতেই শেখেন। কলাইকুন্ডার প্রশিক্ষণে উতরে যাওয়ার পরেই একজন পাইলট ফাইটার স্কোয়াড্রনে জায়গা পান। তার আগে পান না।’’ এমন একটি বিমানঘাঁটি থেকে ভারত-মার্কিন যৌথ মহড়া নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ।
যে দুই বিমানঘাঁটি থেকে মহড়া দেবে ভারত ও আমেরিকা, সেখান থেকে চিন সীমান্তে পৌঁছতে খুব একটা সময় লাগে না।
আর পানাগড়ের ‘এয়ার ফোর্স স্টেশন অর্জন সিংহ’ অন্য রকম ভাবে গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, কলাইকুন্ডা থেকে ভারত-চিন সীমান্তের দূরত্ব যতটা, পানাগড় থেকে তার চেয়ে কম। দ্বিতীয়ত, পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব সীমান্তে ভারতীয় বাহিনীর লজিস্টিক সাপোর্ট (পরিবহণ) ও সাপ্লাই লাইন (সরবরাহ) মজবুত রাখার প্রশ্নে পানাগড়ের বায়ুসেনা ঘাঁটি অনেকখানি ভূমিকা নেওয়ার ক্ষমতা রাখে। সেই বিমানঘাঁটিতে এই প্রথম বার মার্কিন বায়ুসেনাকে নিয়ে আসছে ভারত।
কলাইকুণ্ডা থেকে ভারত-চিন সীমান্তের নাথু লা-র দূরত্ব সড়কপথে ৮২৪ কিলোমিটার। আকাশপথে সে দূরত্ব অবশ্য অনেকটাই কম। আর পানাগড় থেকে নাথু লা সড়কপথে মাত্র ৬৮৮ কিলোমিটার দূরে। আকাশপথে আরও কম।
ভারতীয় বায়ুসেনার মিগ-২৯ যুদ্ধবিমানগুলির গতিবেগ ঘণ্টায় ২৪০০ কিলোমিটার। আর সুখোই-৩০ এমকেআই উড়তে পারে ঘণ্টায় ২১০০ কিলোমিটার বেগে।
অর্থাৎ, পানাগড় থেকে উড়ে চিন সীমান্তে পৌঁছতে বিভিন্ন যুদ্ধবিমানের সময় লাগবে ১৫ থেকে ১৮ মিনিট। আর কলাইকুণ্ডা থেকে উড়ে বড়জোর ১৯ থেকে ২২ মিনিট।
কর্নেল সৌমিত্র রায়ের কথায়: ‘‘চিন সীমান্তের আরও অনেক কাছে ভারতের ফাইটার এয়ারবেস রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের আলিপুরদুয়ার জেলার হাসিমারা বা অসমের ছাবুয়া সেগুলির অন্যতম। কিন্তু আমাদের সব রকম সক্ষমতা তো আমরা শো-কেসের মধ্যে রাখি না। বরং ভূখণ্ডের গভীরে অনেক কিছু লুকিয়ে রাখি। তাই সীমান্তের সামনে অবস্থিত হাসিমারা বা ছাবুয়াতে এমন অনেক কিছুই নেই, যা পানাগড় বা কলাইকুণ্ডায় আমরা রেখেছি। ফলে এই দুই বিমানঘাঁটিতে মার্কিন বাহিনীকে নিয়ে ভারতীয় বায়ুসেনার যৌথ মহড়া সবসময়েই বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।’’
পানাগড়ের এয়ার ফোর্স স্টেশন অর্জন সিংহ হল দেশের দু’টি বায়ুসেনাঘাঁটির অন্যতম, যেখানে ‘সি ১৩০ জে সুপার হারকিউলিস’ বিমান রয়েছ। সামরিক পরিবহণের জন্য গোটা বিশ্বে যে বৃহত্তম বিমানগুলি রয়েছে, ‘সি ১৩০ জে সুপার হারকিউলিস’ সেগুলির অন্যতম। প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, পানাগড় বিমানঘাঁটির সক্ষমতা বাড়ানোর কাজও অনবরতই চলছে। ফলে ওই বিমানঘাঁটিকে ফাইটার এয়ারবেস হিসেবেও ব্যবহার করা যেতে পারে যে কোনও সময়েই। মূলত ভারত-চিন সীমান্তের কথা মাথায় রেখে ‘১৭ মাউন্টেন স্ট্রাইক কোর’ নামে যে এলিট ফোর্স তৈরি করছে ভারত, সেই বাহিনীর একটি অংশকেও ভবিষ্যতে পানাগড়ে রাখা হতে পারে বলে প্রতিরক্ষা মন্ত্রক সূত্রের খবর। অর্থাৎ, চিনের মোকাবিলায় প্রস্তুত থাকার জন্য যে সব সামরিক ঘাঁটিকে বিশেষ ভাবে ভারত প্রস্তুত রাখতে চায়, পানাগড় তার অন্যতম। সেই পানাগড় থেকেই মার্কিন বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে ভারতীয় বায়ুসেনার মহড়া চিনের চিন্তার কারণ হতে বাধ্য। এমনই মত প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশারদদের।
সূত্র : আনন্দবাজার