মঙ্গলবার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:১৪ অপরাহ্ন
সংবাদ শিরোনাম:
ভোলায় কৃষি উন্নয়নে আওতায় কৃষক প্রশিক্ষন  ফুলপুরে ৩৩তম আন্তর্জাতিক ও ২৬তম জাতীয় প্রতিবন্ধী দিবস পালিত তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ‘স্মার্ট কেস ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম’ বিষয়ক চার দিনব্যাপী কর্মশালা শুরু কেমন পুলিশ চাই’ শীর্ষক জনমত জরিপের ফলাফল প্রকাশ ভূমি সংস্কার সম্পন্ন হলে পার্বত্য চুক্তি বহুলাংশে স্বার্থক হবে- পার্বত্য উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমা শোকরিয়া আদায় ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন “আবু সালেহ আকন” নতুন বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে তারুণ্যের উৎসব-২০২৫ তথ্য চাইতে রেল কর্মকর্তা বলেন গেট আউট বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আহতদের দেখতে অর্থোপেডিক হাসপাতালে আইজিপি এইচএসসি পাসে জনবল নিচ্ছে বাংলাদেশ পুলিশ, আবেদন ফি ২০০ টাকা

পরিযায়ী পাখির গল্প ।। মহিবুল আলম

  • আপডেট টাইম : বুধবার, ১৩ মার্চ, ২০২৪, ৩.৩৮ পিএম
  • ১৬১ বার পঠিত

এক.
শীতের সন্ধ্যায় সাড়ে পাঁচটা বাজতে না বাজতেই অন্ধকার নেমে আসে। যদিও নিউজিল্যান্ডে সন্ধ্যা বা রাতের অন্ধকার বলতে বাড়ির পেছনের উঠোনের সামান্য অন্ধকার। সাধারণত নিউজিল্যান্ডে বড় কোনো প্রাকৃতিক দূর্যোগ না হলে বিদ্যুৎ যাওয়ার কোনো নজির নেই। তাই শহরের বাইরে না গেলে সন্ধ্যা ও রাতের যথার্থ অন্ধকার চোখে পড়ে না।

শীতের সন্ধ্যার অন্ধকার এরই মধ্যে বাসার পেছনের উঠোনে জমা হয়েছে। বাসার পেছনে একটা বড় কমলা গাছ। আর আছে একটা ফিজিওয়া গাছ। সেখান থেকে অনবরত ঝিঁ ঝিঁ পোকা ডাকছে, ঝিঁ-ই-ই-ঝিঁরিৎ, ঝিরিৎ, ঝিঁ-ই-ই-ঝিরিৎ, ঝিরিৎ।

বাইরে শীত পড়েছে বেশ। স্থানে স্থানে ধোঁয়া ওঠার মতো কুয়াশা উড়ছে। জাহিদের শীতকাল ভালো লাগে না। অথচ এই শীতকালেই কিউই ফলের অরচার্ডের সবচেয়ে কঠিন কাজটা তাদের করতে হয়। খুব সকালে উঠে ঘাসের ওপর বিছিয়ে থাকা বরফের স্তর মচ মচ করে ভেঙে সবাই কিউই ফলের গাছের প্রুনিং করে। শীতকালের কিউই ফল গাছের এই প্রুনিংকে বলা হয় উইন্টার প্রুনিং।

কিউই ফল গাছের এই উইন্টার প্রুনিং জাহিদের কাছে খুব কঠিন কাজ মনে হয়। জাহিদ নিউজিল্যান্ডে প্রায় ছয় বছর ধরে বসবাস করছে। এর আগে সে কখনো উইন্টার প্রুনিং করেনি। নিউজিল্যান্ডে আসার পর পর সে যখন কিছুদিন পাপামোয়া ছিল, তখন টিপুকিতে কিছুদিন কিউই ফলের পিকিং ও একটা প্যাকিং হাউজেও প্যাকিংয়ের কাজ করেছিল। তারপর তো সে হেস্টিংস পাড়ি জমায়। কিছুদিন আগেই সে তাওরাঙ্গা শহরে এসে আবার বসবাস শুরু করেছে। এবারই সে প্রথম উইন্টার প্রুনিং করছে।

হকস বে অঞ্চলের আপেল অরচার্ডের সব কাজ জাহিদের নখদর্পণে ছিল। সেই কাজগুলো কঠিন হলেও কিউই ফলের কাজের মতো এত কঠিন নয়। কিন্তু হকস বে অঞ্চল ছেড়ে তাওরাঙ্গা শহরে আসতে হয়েছে শুধুমাত্র আজমল হোসেনের জন্য। আজমল হোসেনের নিউজিল্যান্ডে বৈধভাবে বসবাসের সব মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। তিনি এখন লুকিয়ে লুকিয়ে অবৈধভাবে তাওরাঙ্গা শহরের বাঙালি কনট্রাকটারদের মাধ্যমে কিউই ফলের বাগানে কাজ করছেন। জাহিদকেও তাই বাধ্য হয়ে কাজ করতে হচ্ছে। এ ছাড়া উপায় কী? সে না থাকলে আজমল হোসেন যাবেন কোথায়?

এ ছাড়া অবশ্য লিডিয়ার ব্যাপারটাও ছিল। সব ঝামেলা শেষ করার পরও জাহিদের কাগজের বউ লিডিয়া অযথাই ফোন করে তার কাছে টাকা চাইত। এটা-সেটা বলে রাগারাগি করত। কখনো আগের মতো হুমকি দিয়ে বসত। যদিও লিডিয়া এখন তার কিছুই করতে পারবে না। জাহিদের নিউজিল্যান্ডের পার্মান্যান্ট রেসিডেন্সি হয়ে গেছে। আর তাদের সেপারেশান হয়ে গেছে কয়েক মাস আগেই।

জাহিদ বাসার পেছনের জমে থাকা অন্ধকার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আজমল হোসেনকে দেখার চেষ্টা করল। তিনি নিশ্চয়ই বেডরুমের একপাশে বসে শেকসপিয়ারের সমগ্রের বাংলা অনুবাদ পড়ছেন? এই বইটা যে তিনি কতবার পড়েছেন! তিনি বলেন, এসব বই পড়লে নাকি জ্ঞান হয়। কিন্তু জাহিদ বুঝতে পারছে না, একই বই এতবার পড়ার মধ্যে কী জ্ঞান হয়?

জাহিদ আবার বাইরে তাকাল। অন্ধকারটা ঠিক জমাট নয়। বাসার ভেতরের আলো জানালা গলে বাইরে গিয়ে পড়েছে। দুইটি বর্গাকার আলো। ঠিক বর্গাকার নয়, খানিকটা কৌণিক বর্গাকার। তার বাসায় দুটোই জানালা। একটা লাউঞ্জে, অন্যটা বেডরুমে।

জাহিদদের তাওরাঙ্গার বাসাটা ঠিক পুরোপুরি সয়ংসম্পূর্ণ বাসা বলা যায় না। এটা বাসার পেছনে একটা স্লিপ আউট। অনেকে যেটাকে গ্র্যানি ফ্ল্যাট বলে। মূলত এটা বাড়ির পেছনে বাড়ি। যাদের বড় পরিবার, তারা ওটাকে শখের ফ্ল্যাট হিসাবে ব্যবহার করে। আর যাদের পরিবার ছোট, তারা ওটাকে ভাড়া দিয়ে বাড়তি কিছু পয়সা ব্যাংকে জমা করে।

জাহিদ ও আজমল হোসেন এই স্লিপ আউটটা হেদায়েত হোসেনের কাছ থেকে ভাড়া নিয়েছে। হেদায়েত হোসেনের চার বেডরুমের বাসার পেছনের উঠোনে করোগেটেড আয়রন ও ওয়েদার বোর্ডের তৈরি এই স্লিপ আউটটা। একটা বেডরুম। বেডরুম লাগোয়া বাথরুম। ছোট্ট একটা লাউঞ্জ। লাউঞ্জের একপাশে কিচেন। বাইরে যাওয়ার একটাই মাত্র দরজা।

হেস্টিংস শহরে জাহিদদের যে বাসা ছিল, ওটা ছিল যথার্থ অর্থে স্বয়ং সম্পুর্ণ দুই বেডরুমের বাসা। দীর্ঘ একটা লাউঞ্জ ছিল। কিচেনটা অনেক বড় ছিল। হঠাৎ করে তাওরাঙ্গা শহরে এসে এই স্লিপ আউটে বসবাস করতে গিয়ে জাহিদের বেশ সমস্যার মধ্যেই পড়তে হয়েছে। আজমল হোসেনের সঙ্গে তার একই বেডরুমে থাকতে হচ্ছে। প্রাইভেসি বলতে কিছু নেই। প্রাইভেসির ব্যাপারটা কোনো সমস্যা না। সমস্যা যেটা হয়েছে, আজমল হোসেন খুব নাক ডাকেন। এত জোরে জোরে নাক ডাকেন যে একই রুমে তার পাশের বেডে ঘুমানো দায় হয়ে যায়। এমনিতে রাতে ঘুম না হলে ভোরে উঠে কিউই ফলের বাগানে পায়ের নিচে বরফের স্তর কড়মড় করে ভেঙে উইন্টার প্রুনিং করা খুবই দুরূহ ব্যাপার।

এ বাসায় ওঠার পর জাহিদ কিছুদিন বেডরুমে ঘুমালেও এখন আর সে সেখানে ঘুমায় না। সে লাউঞ্জের লম্বা সোফাটাতে ঘুমায়। টিভি দেখতে দেখতে সে সেখানেই ঘুমিয়ে পড়ে।

জাহিদ জমে থাকা অন্ধকার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে এবার হেদায়েত হোসেনের বাসার দিকে তাকাল। হেদায়েত হোসেন মানুষটা খারাপ নন, ভালোই। একটু চুপচাপ ধরনের। বয়স বেশি নয়, চল্লিশ বছরের মতো। নিউজিল্যান্ডে আছেন প্রায় চৌদ্দ বছর ধরে। তাওরাঙ্গা-টিপুকি অঞ্চলে তিনি আরও দশজন বাঙালি কনট্রাকটরদের মধ্যে একজন কন্ট্রাক্টর। এরই মধ্যে বেশ প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। তাওরাঙ্গা শহরের এই বাড়িটা বাদেও আরও দুটো বাড়ি আছে। ঢাকা রামপুরায় প্লট কিনে আট তলা একটা বাড়ি বানিয়েছেন।

জাহিদ ও আজমল হোসেন হেদায়েত হোসেনের অধীনেই কাজ করে।

তাওরাঙ্গা-টিপুকি শহরের কিউই ফলের বাগানের কন্ট্রাক্টররা অনেকটা হকস বে অঞ্চলের আপেল অরচার্ডের কনট্রাক্টরদের মতোই। অরচার্ডের মালিকের কাছ থেকে কিউই ফলের বড় বড় বাগান নিয়েই তারা কমিশনে শ্রমিকদের দিয়ে কাজ করায়। তবে আপেল অরচার্ডে কাজ করার চেয়ে কিউই ফলের অরচার্ডের কাজে পয়সা বেশি। কিন্তু কাজটা খুব কঠিন। আপাতত জাহিদের কাছে তাই মনে হয়। কিন্তু সে অবাক হয়ে দেখছে, আজমল হোসেন এ কাজটা আপেল বাগানের কাজের চেয়ে বেশ স্বচ্ছন্দে করছেন।

আজমল হোসেন কখন পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন, জাহিদ তা খেয়াল করেনি। সে খানিকটা চমকে উঠে জিজ্ঞেস করল, স্যার, আপনি, ঘুমাননি?

আজমল হোসেন বললেন, না, বইটা পড়ছিলাম।

– কোন বইটা, শেকসপিয়ারের বাংলা অনুবাদ?

– আছে তো একটা বই। আর কোনটা পড়ব?

– তাওরাঙ্গা সেন্ট্রাল লাইব্রেরি থেকে ইংরেজি বই এনেও তো পড়তে পারেন?

– এমনিতে ইংরেজি পত্রিকা পড়তে খারাপ লাগে না। কিন্তু সাহিত্যের বই ইংরেজিতে পড়তে তেমন আনন্দ পাই না। অনুবাদ করা থাকলে আনন্দ পাই। আর শেক্সপিয়ায়ের বাংলা অনুবাদ সমগ্রটা কত বড়! যতবার পড়ি ততবারই মনে হয় নতুন করে পড়ছি।

জাহিদ মৃদু হেসে বলল, তাই! ভালো।

আজমল হোসেনও সায় দিয়ে হাসলেন। এক মুহূর্ত চুপ থেকে কী ভেবে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার কী মন খারাপ?

জাহিদ বলল, নাহ, নাতো। হঠাৎ এ প্রশ্ন কেন স্যার?

– না মানে, তুমি এভাবে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছ?

– এমনিই স্যার।

– এমনিই কেউ এতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে না। আমি কি একটা প্রশ্ন করতে পারি?

– জি স্যার, করুন।

– তোমার কি কিউই ফ্রুটের কাজটা ভালো লাগছে না?

জাহিদ একটু চুপ থেকে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, জি স্যার। আসলেই ভালো লাগছে না। কিউই ফ্রুট অরচার্ডের কাজটা আমি ঠিক পছন্দ করছি না। প্রায় পাঁচ-সাড়ে পাঁচ বছর আপেল অরচার্ডে কাজ করেছি তো, তাই ওই কাজটা আমার নখদর্পণে ছিল। কিউই ফ্রুটের কাজটা আমার কাছে খুব কঠিন মনে হচ্ছে।

আজমল হোসেন বললেন, আমার কাছে কিন্তু মনে হচ্ছে না। বরং আপেল বাগানের কাজটা আমার কাছে কঠিন মনে হতো।

– গত কয়েকদিন ধরে তাই তো দেখছি। সত্যি বলতে স্যার, আপনাকে অনেক আগেই আমার তাওরাঙ্গা-টিপুকিতে পাঠিয়ে দেওয়া উচিত ছিল।

– এখানে এলে আমাকে আশ্রয় দিত কে?

– আশ্রয় মানে?

– এই যে, তুমি আমাকে আশ্রয় দিয়ে রেখেছ?

– ছি, কী বলেন স্যার?

– এই আশ্রয় শব্দটা নেগেটিভ অর্থে নিচ্ছ কেন?

– কীভাবে নেব স্যার?

– পজেটিভ অর্থে নিবে। আচ্ছা, আশ্রয় শব্দটা বাদ দাও। তুমি আমাকে উপকার তো করছ। তুমি আছ বলেই এত দিন নিউজিল্যান্ডে আছি। নাতো আমার কী যে হয়ে যেত! প্রায় ছয়টা বছর ধরে তুমি আমাকে আগলে রেখেছ। আজ আমার জন্য তোমাকে হেস্টিংস ছেড়ে তাওরাঙ্গা আসতে হলো।

– হেস্টিংস আমি এমনই ছেড়ে দিতাম স্যার। অন্তত লিডিয়ার জন্য।

– লিডিয়ার জন্য কেন?

– দেখলেন না, তাওরাঙ্গা আসার আগে দিয়ে কী ঝামেলাটা বাঁধাল? আমার পার্মান্যান্ট রেসিডেন্সি হয়ে গেছে কয়েক মাস হয়ে গেছে। লিডিয়ার সঙ্গে টাকাপয়সার ঝামেলা বহু আগেই শেষ। কিন্তু তারপরও সে টাকাপয়সা চেয়ে কীভাবে হুমকি দিতে শুরু করেছিল?

– হ্যাঁ, মেয়েটা বেশ লোভী।

– শুধু লোভী নয় স্যার, মহালোভী। সে ভেবেছে, সারাজীবনই সে আমার কাছ থেকে হুমকি-ধমকি দিয়ে টাকাপয়সা আদায় করে নিবে। রেসিডেন্সি হওয়ার আগে অন্য ব্যাপার ছিল। তার সবকিছু মেনে নিয়েছি। কিন্তু এখন কেন?

দুই
আজ সারাদিন খুব পরিশ্রম গেছে। কিউই ফলের বাগানটা ঠিক যেন বাগান ছিল না। জঙ্গলে পরিপুর্ণ ছিল। টিপুকির কাছে মাকিতুতে তাদের কাজ হয়েছিল। সাধারণত উইন্টার প্রুনিংয়ে একেকটা কিউই ফল গাছের দশ-এগারোটা নতুন ডালা ও দুই-তিনটা পুরোনো ডালা রেখে বাকি সব ডালা কেটে ফেলে দিতে হয়। কিন্তু মাকিতুর কিউই ফলের বাগানে যেন নতুন ডালা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। মনে হচ্ছিল, সব ডালা পেঁচিয়ে শুধু জঙ্গল নয়, দুর্বোধ্য জঞ্জালে পরিণত হয়েছে।

এত পরিশ্রমের পরও জাহিদকে সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে রান্না করতে হয়েছে। আজমল হোসেন অবশ্য তাকে আগাগোড়া রান্নায় সহযোগিতা করেছেন। রাত আটটার মধ্যে খেয়েদেয়ে আজমল হোসেন বেডরুমে চলে যান। জাহিদ লেপ মুড়ি দিয়ে দিঘল সোফাটায় গা এলিয়ে টিভি দেখতে বসে।

টিভি দেখতে দেখতে জাহিদ এক সময় সোফায় ঘুমিয়ে পড়ে। তাওরাঙ্গা আসার পর সে রাতে এমনটাই করছে। রাতের খাবার খেয়ে লাউঞ্জে লেপ মুড়ি দিয়ে টিভি দেখে। এক সময় টিভি দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়ে। এমনও হয়, সে সকালে ঘুম থেকে উঠে টিভি বন্ধ করে।

আজও জাহিদ টিভি দেখতে দেখতে লাউঞ্জের সোফাতে ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুমের মধ্যে সে একটা স্বপ্নও দেখছিল। কিন্তু কী স্বপ্ন দেখছিল, তা জাহিদ ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গেই মনে করতে পারল না। ঘুম ভাঙার পর প্রথমে সে শুনল টিভির শব্দ। তারপর শুনল আজমল হোসেনের নাক ডাকার শব্দ। এর পরপরই সে স্লিপ আউটের দরজায় কাউকে কড়া নাড়তে শুনল।

জাহিদ ঘড়ি দেখতে দেখতে সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। লাউঞ্জের লাইটটা তখনো জ্বালানো। সে তৎক্ষণাৎ ঘড়ি দেখল, রাত এগারোটা বাজে।

জাহিদ জিজ্ঞেস করল, কে?

– আমি, দরজা খোল।

– আমি কে?

– আমি হেদায়েত।

জাহিদ দরজা খুলল। কিন্তু সে দরজা খুলেই হেদায়েত হোসেনের চেহারার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেল। হেদায়েত হোসেনের চেহারা একেবারেই বিধ্বস্ত। মনে হচ্ছে, এই মাত্র তিনি কোনো ব্যাপারে কান্নাকাটি করে এসেছেন। চোখ তখনো ভেজা। গালের ওপর চোখের জলের সরু রেখা।

জাহিদ জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে হেদায়েত ভাই? এত রাতে?

হেদায়েত হোসেন কান্না জড়ানো গলায় বললেন, আমার সর্বনাশ হয়ে গেছে।

– কী সর্বনাশ?

– তোমার ভাবি জেদ ধরে অনেকগুলো প্রেশারের ওষুধ খেয়ে ফেলেছে।

– অনেকগুলো মানে?

– অনেকগুলো মানে ত্রিশ-চল্লিশটা। আরও বেশি হতে পারে।

– এটা কীভাবে হলো?

– তুমি তো জানোই, তোমার ভাবির ব্লাড প্রেশার হাই। সব সময় প্রেশারের ওষুধ খায়। আজ জেদ ধরে বাসায় যতগুলো প্রেশারের ওষুধ আছে, সব খেয়ে ফেলেছে।

– বলেন কী!

– হ্যাঁ, জাহিদ। আমি কী করব বুঝতে পারছি না।

– অ্যাম্বুলেন্স কল করেছেন?

– না, ঘটনাটা এইমাত্রই ঘটেছে। আমি দিশা না পেয়ে তোমার এখানে চলে এসেছি।

জাহিদ তার স্লিপিং গাউনটা চাপিয়ে বলল, চলেন, চলেন, আগে ভাবির অবস্থা দেখি। তারপর না হয় অ্যাম্বুলেন্স কল করব।

হেদায়েত হোসেন বললেন, তাই কর। আমার মাথায় কিছু ঢুকছে না।

হেদায়েত হোসেনের বাসায় ঢুকে জাহিদ দেখল, ঘটনাটা এইমাত্র ঘটলেও লাকি ভাবির অবস্থা খুবই খারাপ। লাকি ভাবির মুখ দিয়ে অনবরত দিয়ে সরু ফেনা বের হচ্ছে। তিনি ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছেন। তার শরীর থরথর করে কাঁপছে। হেদায়েত হোসেন ও লাকি ভাবির বারো বছরের ছেলে সজল চুপচাপ মার পাশে বসে আছে।

হেদায়েত হোসেন লাকি ভাবির পাশে হাঁটু গেড়ে বসে কেঁদে উঠে বললেন, জাহিদ, আমি এখন এই পাগলটাকে নিয়ে কী করব?

লাকি ভাবি বিড় বিড় করে বললেন, হেদায়েত, আমাকে বাঁচাও।

জাহিদ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। কয়েক মুহূর্ত সে কিছু বলতে পারল না। একটা দেয়াল ঘড়ি চলছে- টিক টিক, টিক টিক। বাইরে রাতের নিস্তব্ধতা। শীত কুয়াশার জল পড়ছে- টুপ টুপ, টুপ টুপ।

লাকি ভাবি আবার বিড় বিড় করে বললেন, ওগো, শুনছ, আমি মরে যাচ্ছি…!

হেদায়েত হোসেন এবার বাচ্চা ছেলের মতো ভেউ ভেউ করে কেঁদে উঠলেন।

জাহিদ বলল, ভাবি, আপনার কিছু হবে না। আপনি ভালো হয়ে যাবেন। আমি অ্যাম্বুলেন্স কল করছি। আপনি একটু ধৈর্য ধরেন। ঘাবড়াবেন না। বলেই সে হেদায়েত হোসেনের দিকে তাকিয়ে বলল, হেদায়েত ভাই, আপনি একটা তোয়ালে ভিজিয়ে ভাবির মুখটা মুছে দিন। আমি এখনই একটা অ্যাম্বুলেন্স কল করছি।

হেদায়েত হোসেন ওঠার আগেই সজল বলল, আমি তোয়ালে নিয়ে আসছি।

জাহিদ তৎক্ষণাৎ ওয়ান-ওয়ান-ওয়ান এ ফোন করে অ্যাম্বুলেন্স ডাকায় ব্যস্ত হয়ে উঠল।

অ্যাম্বুলেন্স এল ঠিক আধাঘণ্টা পর। এরই মধ্যে জাহিদ একবার ভেবেছিল, হেদায়েত হোসেনকে সঙ্গে করে সে নিজেই লাকি ভাবিকে নিয়ে হাসপাতালে চলে যাবে। কিন্তু পরক্ষণ তার মাথায় আসে, রাস্তায় যদি কিছু হয়ে যায়? তাই সে অ্যাম্বুলেন্সের অপেক্ষায় থাকে।

অ্যাম্বুলেন্স এলে হেদায়েত হোসেন স্টেচারের অপেক্ষা না করেই লাকি ভাবিকে পাঁজাকোলে করে অ্যাম্বুলেন্সের কাছে নিয়ে এল। সজল পেছনে পেছনে এল।

লাকি ভাবিকে অ্যাম্বুলেন্সে তুলতেই জাহিদ হেদায়েত হোসেনকে বলল, হেদায়েত ভাই, আপনি আর সজল অ্যাম্বুলেন্সের সঙ্গে হাসপাতালে চলে যান। আমি গাড়ি নিয়ে আসছি।

হেদায়েত হোসেন ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে সায় দিলেন।

অ্যাম্বুলেন্স সাঁই সাঁই করে চলে গেল।

জাহিদ তার স্লিপ আউটে ঢুকেই দেখল, আজমল হোসেন ঘুম থেকে উঠে সোফায় বসে দরজার দিকে তাকিয়ে আছেন। টিভিটা তখনো চলছে।

জাহিদ জিজ্ঞেস করল, স্যার, আপনি ঘুম থেকে উঠে গেছেন যে?

আজমল হোসেন বললেন, হ্যাঁ। এখানে কে যেন এসেছিল। কথাবার্তা শুনলাম। তখনই আমার ঘুম ভেঙে গেছে। লাউঞ্জে এসে দেখলাম, তুমি নেই।

– হেদায়েত ভাই এসেছিলেন।

– হেদায়েত এসেছিল কেন?

– লাকি ভাবি জেদ ধরে প্রেশারের অনেকগুলো ওষুধ খেয়ে ফেলেছেন।

– বলো কী! এখন কী অবস্থা?

– অ্যাম্বুলেন্স কল করে হেদায়েত ভাই লাকি ভাবিকে নিয়ে তাওরাঙ্গা হাসপাতালে গেছেন। সজলও গেছে। আমি এখন যাব। আপনি যাবেন?

– হ্যাঁ হ্যাঁ, আমিও যাব।

– তাহলে কাপড়চোপড় পরে তাড়াতাড়ি তৈরি হন। গরম কাপড় বেশি করে পরবেন। বাইরে অনেক শীত পড়েছে।

জাহিদ ও আজমল হোসেন ত্বরিত একটা প্যান্ট শার্ট পরে, তার ওপর ভারী সুয়াটার ও একটা ভারী জ্যাকেট চাপিয়ে, গলায় একটা মাফলার পেঁচিয়ে স্লিপ আউট থেকে তাওরাঙ্গা হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওনা হলো। রাত তখন প্রায় বারোটা বাজে। শীতের রাত। রাস্তা-ঘাট প্রায় ফাঁকা। তাওরাঙ্গা শহরটা সমুদ্রের তীরে বলে, এখানে অত কুয়াশা পড়ে না। কিন্তু আজ বেশ কুয়াশা পড়েছে। রাস্তার প্রতিটা বাতির সামনে কুয়াশার স্তরটা স্তব্ধ হয়ে জমে আছে। বাইরের তাপমাত্রা এখন নিশ্চয়ই হিমাঙ্কের নিচে।

জাহিদ স্টেট হাইওয়ে টু ধরে যাচ্ছে। সেখান থেকে এলিজাবেথ স্টিটে মোড় নিয়ে দিঘল ক্যামেরুন রোড ধরে তাওরাঙ্গা হাসপাতালে যাবে।

রাস্তায় দুই-একটা গাড়ি আসা-যাওয়া করছে। দুই-একটা পুলিশের গাড়ি ধীরে-স্থিরে টহল দিচ্ছে। দুই-একটা সিকিউরিটি অফিসারের গাড়ি। মধ্যরাতের একটা প্লেন যাচ্ছে ওপরের কুয়াশা ভেদ করে। তাওরাঙ্গা পোর্টে বড় একটা জাহাজ ভিড়েছে।

জাহিদ গাড়ি চালাতে চালাতে গাড়ির গ্লাস গলে বাইরে তাকাল। তাওরাঙ্গা পোর্টের সারি সারি থেমে থাকা স্পিডবোটগুলো থেকে সারি সারি আলোর রেখা আসছে। সমুদ্রের ঢেউয়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে স্পিডবোটগুলোর আলোর রেখা ওঠানামা করছে। স্পিডবোটগুলোতে কোনো মানুষজন নেই। বহুতল বিশিষ্ট ক্রুজ শিপটার ছোট ছোট জানালা ভেদ করে ভেতরের আলো ছড়িয়ে পড়েছে বিন্দু বিন্দু হয়ে। জলের প্রতিবিম্বে আলোগুলো কেমন এলোমেলো হয়ে উঠছে।

হাসপাতালে পৌঁছে ইমার্জেন্সিতে ঢুকতেই জাহিদ ও আজমল স্যার দেখল, এরই মধ্যে লাকি ভাবিকে আইসিইউতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সজল আইসিইউর ভেতরে। কিন্তু হেদায়েত হোসেন আইসিইউর সামনের ছোট্ট লাউঞ্জের একটা চেয়ারে অবলম্বনহীন বসে আছেন।

জাহিদকে দেখা মাত্রই হেদায়েত হোসেন ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। হেদায়েত হোসেনকে দেখে মনে হচ্ছে হাইপারটেনশন লাকি ভাবির নয়, হেদায়েত হোসেনের।

জাহিদ হেদায়েত হোসেনের পাশের চেয়ারে বসে জিজ্ঞেস করল, এখন ভাবির কী অবস্থা?

হেদায়েত হোসেন শিশুর মতো কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, তোমার ভাবির শরীরের টেম্পারেচার খুব তাড়াতাড়ি কমে যাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে ব্লাড প্রেশারও নেমে যাচ্ছে।

– আপনি বাইরে বসে আছেন যে?

– আমার ভেতরের পরিবেশটা সহ্য হচ্ছিল না।

– ভাবি কথা বলতে পারছেন তো?

– হ্যাঁ, এখনো কথা বলছে।

– আপনি ভেতরে ঢোকেন। আপনাকে এখন ভাবির পাশে থাকতে হবে। অন্তত ভাবিকে মানসিকভাবে সাপোর্ট দেওয়ার জন্য।

হেদায়েত হোসেন চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। জাহিদ তুমিও আমার সঙ্গে ভেতরে চল। আমারও মানসিকভাবে সাপোর্টের প্রয়োজন।

জাহিদ জিজ্ঞেস করল, একসঙ্গে এত মানুষ আইসিইউতে ঢুকতে দেবে?

হেদায়েত হোসেন বললেন, আজমল স্যার এখানে থাকুক। তুমি আমার সঙ্গে ভেতরে আস।

জাহিদ সায় দিয়ে হেদায়েত হোসেনকে অনুসরণ করল। জাহিদ বুঝতে পারছে না, এক সঙ্গে অনেকগুলো প্রেশারের ওষুধ খেয়ে ফেললে বাঁচার জন্য কতটুকু হুমকিস্বরূপ।

আইসিইউতে ঢুকে হেদায়েত হোসেন কিছুতেই তার কান্না থামাতে পারছেন না। যদিও তিনি শব্দ করে কাঁদছেন না। কিন্তু কান্নাটা যেন তার ভেতর থেকে ঠেলে ঠেলে উথলে উঠছে। সজল চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। লাকি ভাবির শরীরে পানিশূন্যতাও দেখা দিয়েছে। নার্স সেলাইন ঝুলিয়ে পানিশূন্যতা দূর করার চেষ্টা করছে।

এরই মধ্যে লাকি ভাবি হেদায়েত হোসেনের হাত টেনে বিড়বিড় করে বললেন, আই লাভ ইউ। তুমি আমাকে বাঁচাও…!

হেদায়েত হোসেন এবার হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন।

ডাক্তার জাহিদকে বললেন, প্লিজ, আপনি ওনাকে বাইরে নিয়ে যান।

ব্যাপার ছিল অতি সাধারণ। হেদায়েত হোসেন ও লাকি ভাবির মধ্যে বাংলাদেশের তাদের সয়-সম্পত্তি নিয়ে কী সব কথা কাটাকাটি হয়েছিল। লাকি ভাবি খুব জেদী। এ ছাড়া তিনি উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন। এই বয়সেই তাকে নিয়মিত প্রেশারের ওষুধ খেতে হয়। তাই কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে লাকি ভাবি জেদের বশে হাতের কাছে পাওয়া প্রেশারের ওষুধগুলো একত্রে মুখে দিয়ে চাবিয়ে খেয়ে ফেলেন। হয়তো তিনি কাজটা জেদের বশে করেছেন। কিন্তু প্রেশারের ওষুধগুলো খাওয়ার পর তার টনক নড়ে। মনের ভেতর ভয় ঢুকে যায়। তার মধ্যে মৃত্যু চিন্তা এসে ভিড় করে।

অথচ তাদের দুজনের প্রেমের বিয়ে। বাংলাদেশে থাকতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়ন বিষয় নিয়ে মাস্টার্স করে হেদায়েত হোসেন একটা ওষুধ কোম্পানিতে বেশ ভালো বেতনেরই চাকরি পান। চাকরি পাওয়ার পরপরই লাকি ভাবিকে বিয়ে করেন। যদিও তাদের প্রেমের বিয়ে, লাকি ভাবি হেদায়েত হোসেনের দূর সম্পর্কের খালাত বোন হওয়াতে পারিবারিকভাবেই জাঁকজমকভাবে বিয়ে হয়। বিয়ের দুই বছরের মাথায় তারা অভিবাসী হয়ে নিউজিল্যান্ডে চলে আসেন। তাদের ছেলে সজলের জন্ম এই নিউজিল্যান্ডে।

হেদায়েত হোসেন ও লাকি ভাবির সংসারটা বলা যায় অনেকটা নির্ঝঞ্ঝাটই ছিল। ষোল বছরের বিবাহিত জীবনে তাদের সম্পর্কের খুব একটা উত্থান-পতন হয়নি। নিয়মমাফিক স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে একটু-আধটুকু ঝগড়াঝাঁটি হতেই পারে। জাহিদ তাদের বাসার পেছনের স্লিপ আউটে বসবাস করতে এসে গত দেড় মাস ধরে এর বেশি কিছু দেখেনি। কিন্তু আজ?

লাকি ভাবি পুরো চার ঘণ্টা আইসিইউতে থাকার পর ভোর পাঁচটার দিকে তিনি মারা যান। মারা যাওয়ার আগে তিনি কোমায় চলে গিয়েছিলেন। ভেন্টিলেটার দিয়ে তাকে ঘণ্টাখানেক বাঁচিয়ে রাখা হয়েছিল।

…চলবে

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন

এই ক্যাটাগরীর আরো খবর

পুরাতন খবর

SatSunMonTueWedThuFri
 123456
78910111213
14151617181920
21222324252627
28293031   
       
  12345
20212223242526
2728293031  
       
15161718192021
2930     
       
     12
24252627282930
       
2930     
       
    123
       
    123
25262728   
       
     12
31      
   1234
262728    
       
  12345
2728     
       
   1234
       
     12
31      
1234567
891011121314
15161718192021
2930     
       
    123
11121314151617
       
  12345
20212223242526
27282930   
       
      1
2345678
23242526272829
3031     
      1
       
293031    
       
     12
10111213141516
       
  12345
       
2930     
       
    123
18192021222324
25262728293031
       
28293031   
       
      1
16171819202122
30      
   1234
       
14151617181920
282930    
       
     12
31      
     12
3456789
10111213141516
17181920212223
       
© All rights reserved © MKProtidin.Com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com