সোমবার, ০৩ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ০৩:১৩ অপরাহ্ন
সংবাদ শিরোনাম:
সবাইকে দেশের মঙ্গল ও কল্যাণে কাজ করতে হবে-পার্বত্য উপদেষ্টা তরুণ প্রজন্ম মেধাভিত্তিক ও পেশাদার আমলাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চায় : উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম জগন্নাথ হলে সরস্বতী পূজামণ্ডপ পরিদর্শনে সরকারের দুই উপদেষ্টা রাধাচক্রের রাজনীতি ! সর্বনাশা পরিণতি ! স্বামীর কিডনি বিক্রি করিয়ে টাকা নিয়ে প্রেমিকের সঙ্গে পালালেন স্ত্রী যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টার সাথে নেদারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূতের সৌজন্য সাক্ষাৎ কালিগঞ্জে মোটরসাইকেলের ধাক্কায় বিএনপি নেতা মোতাহার আইসিওতে সৌদি রাষ্ট্রদূত মাউরিতানিয়াস জাতীয় সংসদ সদস্যের সাথে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা নির্বাচন ব্যবস্থার উপর মানুষের আস্থা ফেরাতে কাজ করছে কমিশন; নির্বাচন কমিশনার বায়ুদূষণ ও নিষিদ্ধ পলিথিনের বিরুদ্ধে মোবাইল কোর্ট: ১৭ লাখ টাকা জরিমানা, ৪টি ইটভাটা বন্ধ

রাধাচক্রের রাজনীতি ! সর্বনাশা পরিণতি !

  • আপডেট টাইম : সোমবার, ৩ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫, ১২.০৩ পিএম
  • ১ বার পঠিত

প্রথমে একজন অসহায় ব্যবসায়ীর গল্প বলি। ভদ্রলোকের বয়স ৭৩ বছর। ব্যবসাবাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত আছেন ৫০ বছর ধরে। নারায়ণগঞ্জে বেশ বড়সড় একটি গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি চালাতেন। করোনার ধাক্কায় প্রায় ৩৫ কোটি টাকার লোকসানের কবলে পড়েন। তারপর সেই লোকসানকে কেন্দ্র করে শুরু হয় একের পর এক বিপদ-বালামুসিবত। প্রথমে কোম্পানির পরিচালকদের সঙ্গে দ্বন্দ্ব। তারপর ব্যাংক-বিমা-ক্রেতা-দেনাদার-পাওনাদার সবাই মিলে এমন চাপ দেয় যা তার শরীর-মন-মস্তিষ্ক ধারণ করতে পারে না। হঠাৎ করে একদিন স্ট্রোক করে বসেন। দেশবিদেশে চিকিৎসা করে একটু সুস্থ হয়ে আবার ব্যবসার হাল ধরার চেষ্টা করেন। কারণ ব্যাংকের দায়দেনার একটা দফারফা না হলে তিনি এবং তাঁর ছেলেকে জেলে যেতে হবে, এই ভয়ে নিজের সব স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি ব্যাংকে বন্ধক দিয়ে দুই বছর ধরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং তাঁর ব্যাংকে ঘুরতে গিয়ে তিনি আরেক দফা স্ট্রোকের কবলে পড়েন।

২০২৩ সালে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দুর্নীতিবাজরা টাকা খেয়ে তাঁকে যে আশ্বাস দিয়েছিল এবং তাদের আশ্বাসে তিনি যেভাবে নিজের শেষ সম্বল ব্যাংকের কাছে বন্ধক দিয়েছিলেন, তা ২০২৪ সালের পট পরিবর্তনের পর উল্টে যায়। নতুন যারা এসেছেন তাদের সঙ্গে সমঝোতা করতে গিয়ে তিনি আবার স্ট্রোকের কবলে পড়েন এবং একটু সুস্থ হয়ে আমার কাছে আসেন দেশের রাজনীতির খবরাখবর জানার জন্য।

ভদ্রলোকের মুখের দিকে তাকিয়ে আমার কান্না আসছিল। স্ট্রোকের কারণে তাঁর পুরো মুখ বাঁকা হয়ে গেছে। তাঁর স্ত্রী অনেক আগেই মারা গেছেন। বড় ছেলে দেশের বাইরে থাকে। আর ছোট ছেলে ও ছেলের বউকে নিয়ে উত্তরাতে নিজের বাড়িতে থাকেন, যা কিনা ব্যাংকের কাছে বন্ধক দেওয়া। তাঁর ২৮ বছর বয়সি ছোট ছেলে ব্যবসাবাণিজ্য এখনো বুঝে উঠতে পারেননি। অথচ ভদ্রলোক মারা গেলে তাঁকেই দেনার দায়ে জেলে যেতে হবে কোম্পানির পরিচালক হিসেবে। এই চিন্তায় ভদ্রলোক একবার অসুস্থ হয়ে পড়েন আবার একই চিন্তায় সেই অসুস্থতা নিয়ে ব্যাংকের হাতে-পায়ে ধরার জন্য ছয় মাস ধরে ছোটাছুটি করছেন। সুতরাং তাঁর সেই দুরবস্থার মধ্যে হঠাৎ তিনি কেন রাজনীতির খবরাখবর জানতে আমার কাছে এলেন, তা ভেবে আমি ভারি আশ্চর্য হলাম।

ভদ্রলোক আমার মনের অবস্থা বুঝতে পারলেন। তিনি জানালেন যে তাঁর ভাগ্য এখন রাজনীতির ওপর ঝুলছে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর প্রথম দুই-তিন মাস সবাই তৎপরতা শুরু করেছিল। কিন্তু ২০২৪ সালের নভেম্বর থেকে ব্যাংক-বিমা, সরকারি অফিস-আদালত কোনো কাজ করছে না। উল্টো বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে নিত্যনতুন ঝামেলা সৃষ্টি করছে। উদাহরণ হিসেবে তিনি জানালেন, তাঁর ব্যাংকিং সমস্যাটি হয়তো ২০২৪ সালের জুলাই মাসেই শেষ হয়ে যেত। আবার তিনি যখন আগস্ট বিপ্লবের পর নতুন করে খরচাপাতি শুরু করলেন তখন সবাই ধরে নিয়েছিল যে বর্তমান সরকার দুই-তিন বছর থাকবে। কিন্তু ২০২৫ সালের বাস্তবতা হলো, দেশের রাজনীতির সব হিসাব উল্টে গেছে এবং যে যার অবস্থান থেকে যে ঢিলেমি অথবা ঝিমুনি শুরু করেছে, তাতে করে দেশের সর্বনাশ ঘটে চলেছে ক্রমবর্ধমান হারে।

ভদ্রলোকের কথা শুনে আমি সংবিৎ ফিরে পেলাম। আমার নিজের ব্যবসাবাণিজ্য এবং রাজনীতিতে যে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে এবং আমার নিজের অবস্থান থেকে নিজেকে যেভাবে অনিরাপদ অনিশ্চিত গন্তব্যের যাত্রা এবং অগুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হচ্ছে, তা আমার জীবনে অতীতকালে ঘটেনি। কেবল আমি এই দেশের বড় বড় শিল্পপতি, শীর্ষ রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী থেকে শুরু করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর যার সঙ্গেই গত কয়েক মাসে দেখা হয়েছে, সবারই একই প্রশ্ন- কী হতে যাচ্ছে? এসব কী হচ্ছে! কীভাবে বাঁচব! কী করব! আমাদের কী হবে ইত্যাদি।

কয়েক দিন আগে বিএনপির কয়েকজন শীর্ষ নেতার সঙ্গে একটি ঘরোয়া বৈঠক ছিল। সেখানে রাজনীতিবিদ-কাম দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী নেতা হঠাৎ করে বললেন, ‘আচ্ছা রনি ভাই, বলেন তো আমাদের কী হবে, আমি কৌতুক করে বললাম, আরেক দফা দৌড়ানি খাবেন- আবার পালাবেন। আমার কথা শুনে ভদ্রলোকের মুখ শুকিয়ে গেল। পাশে বসা এক শীর্ষ নেতা বলে ওঠেন, লিখে রাখেন ২০২৫ সালেই নির্বাচন হবে এবং হতে হবে। আমি পাল্টা প্রশ্ন করলাম ধরুন ২০২৫ সালের মধ্যে নির্বাচন হলো না, তখন কী হবে। এবার তার আত্মবিশ্বাস কর্পূরের মতো উবে গেল। তিনি বললেন, যদি ২০২৫ সালের মধ্যে নির্বাচন আদায় করতে না পারি, তবে আগামী কত বছর পর নির্বাচন হবে, তা বলা যাচ্ছে না।

আমাদের উল্লিখিত কথোপকথনের মধ্যে আরেক শীর্ষ নেতা বললেন, আর পারছি না। কিছু ভালো লাগছে না। মনের জোর হারিয়ে ফেলছি। বিএনপির শীর্ষ নেতাদের মতো অন্যান্য দলের শীর্ষ নেতারাও ভীষণ অস্বস্তিতে রয়েছেন। এমনকি সরকারের উপদেষ্টামণ্ডলীতে যাঁরা আছেন, তাঁদের কাউকে আমি এক দিনের জন্য নির্ভার, আত্মবিশ্বাসী এবং খোশমেজাজে দেখিনি। বরং সাধারণ আমজনতার মধ্যে যে ভয়ভীতি, আতঙ্ক ও অসহায়ত্ব বিরাজ করছে তা বহু গুণ বৃদ্ধি পেয়ে ক্ষমতার প্রতিটি কেন্দ্রে প্রতিমুহূর্তে কম্পন সৃষ্টি করছে। ফলে ফেসবুকে কে কী লিখল- ইউটিউবে কে কী বলল, তা নিয়ে টেনশন করতে গিয়ে অনেকের মেদ-ভুঁড়ি কমে গিয়েছে। কারও কারও অস্ত্রের নিশানা ক্ষণে ক্ষণে উল্টে যাচ্ছে এবং দৈনিক হাজার হাজার গুজব তৈরি হয়ে প্রকৃত সত্যকে মাটিচাপা দিচ্ছে।

আজকের দিনের নির্মম বাস্তবতা হচ্ছে, আমরা প্রায় সবাই রাজনীতির ট্রেন মিস করেছি। দ্বিতীয়ত আমাদের রাজনীতির ট্রেন এখন ট্রেন লাইন ছেড়ে সমভূমিতে চলছে নাকি খালবিল-নদীনালায় চলছে তা বুঝতে পারছি না। ট্রেনের ড্রাইভার কে তা যেমন জানি না, তেমনি ড্রাইভার কী ট্রেন চালাতে পারে, তা-ও জানি না। আমাদের প্রকৃতি ও পরিবেশ এমন হয়ে পড়েছে যে আমরা কেউ কাউকে চিনতে পারছি না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ যে এতটা বদলাতে পারে, তা আমরা ইতোপূর্বে কখনো কল্পনাও করিনি। সময়ের বিবর্তনে স্বঘোষিত বীরেরা কাপুরুষের মতো থরথর করে কাঁপছে। আর যারা আগে কাঁপতে কাঁপতে পারকিনসন্স রোগীতে পরিণত হয়েছিল তারা কেউ কেউ বাঘ, কেউবা সিংহের মতো গর্জন শুরু করেছে এবং অনেকে বুনো মহিষ অথবা দাঁতাল শুয়োরের মতো ভয়ংকররূপে সমাজকে আফ্রিকার অরণ্য বানিয়ে ফেলার জন্য তাণ্ডব শুরু করেছে।

দেশ-কাল-সমাজে শব্দসন্ত্রাসের যন্ত্রণা অসহ্যকর হয়ে পড়েছে। যার জিহ্বা আছে সে-ই চেষ্টা করছে কথা বলার জন্য, আর কথা বলতে গিয়ে যে যেভাবে পারছে ইচ্ছামতো জলহস্তির মতো হাঁ করে প্রতিপক্ষকে ভয় দেখাচ্ছে। শিশুরা বুড়োদের জীবনজীবিকা, রাজনীতি-অর্থনীতি শেখাচ্ছে। আর বুড়োরা শিশুদের ভয়ে কম্পমান হয়ে একের পর এক ভীমরতি ঘটাচ্ছে। ফলে সর্বত্র দেখা দিয়েছে অরাজকতা। এখানে সন্ত্রাসীরা থানা আক্রমণ করছে। সন্ত্রাসীদের ভয়ে থানার ওসি পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। ছাত্ররা শিক্ষকদের ওপর মাতব্বরি করছে, ভিক্ষুকরা কাঙ্খিত ভিক্ষা না পেয়ে ভিক্ষাদাতার গাড়িতে সজোরে লাথি মারছে আর সন্তানদের ভয়ে অভিভাবকরা থরথর করে কাঁপছেন।

উল্লিখিত অবস্থায় দেশের রাজনীতি যে কত বড় রাধাচক্রের কবলে পড়ছে, তা অনুধাবন করার জন্য আপনাকে রাধাচক্রের আরোহী হিসেবে শৈশবের স্মৃতি স্মরণ করতে হবে। গ্রাম্য মেলায় গিয়ে শিশুটি যখন রাধাচক্রে ওঠার জন্য বায়না ধরে তখন যে আগ্রহ তাকে তাড়িত করে তা রাধাচক্রে ওঠার পর যেভাবে ভয় ও আতঙ্কের চিৎকারে পরিণত হয় তা ভুক্তভোগীর কাছে যতই যন্ত্রণাদায়ক হোক না কেন দর্শক-শ্রোতারা কিন্তু ব্যাপক বিনোদন পেয়ে থাকে। দ্বিতীয়ত রাধাচক্রের আরোহীরা যেমন ইচ্ছা করলেই মাঝপথে চক্রযান থামিয়ে নেমে যেতে পারে না- তদ্রুপ দর্শকরাও আরোহীদের কান্নায় বিগলিত হয়ে কোনোকালে নিজেদের হাসি থামিয়ে যাত্রীদের উদ্ধার করার চেষ্টা করেছে তার নজির কোথাও দেখা যায়নি। কাজেই বাংলাদেশের রাজনীতি এখন যেভাবে রাধাচক্রের কবলে পড়েছে, তা আমাদের অনেককে যেভাবে কাঁদাবে তদ্রুপ অনেককে ব্যাপকভাবে বিনোদিত করবে। আমরা আজকের আলোচনার শেষ পর্যায়ে চলে এসেছি। চলমান রাজনীতি আমাদের জাতিসত্তা, স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, আত্মপরিচয়, সামাজিক বন্ধন, পারিবারিক সম্পর্ক এবং ব্যক্তির পরিচয়কে যেভাবে জটিল থেকে জটিলতর করে তুলছে তা নিশ্চিতভাবে পুরো দেশকে যে সর্বনাশা পরিণতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে, সেখান থেকে কবে যে ইতিবাচক ধারায় ফিরবে তা কেবল বিশ্বজাহানের মালিক আল্লাহ রাব্বুল আলামিনই বলতে পারবেন।

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম মাওলা রনি।

সোমবার, ৩রা ফেব্রুয়ারী, ২০২৫।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন

এই ক্যাটাগরীর আরো খবর

পুরাতন খবর

SatSunMonTueWedThuFri
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
       
       
  12345
20212223242526
2728293031  
       
15161718192021
2930     
       
     12
24252627282930
       
2930     
       
    123
       
    123
25262728   
       
     12
31      
   1234
262728    
       
  12345
2728     
       
   1234
       
     12
31      
1234567
891011121314
15161718192021
2930     
       
    123
11121314151617
       
  12345
20212223242526
27282930   
       
      1
2345678
23242526272829
3031     
      1
       
293031    
       
     12
10111213141516
       
  12345
       
2930     
       
    123
18192021222324
25262728293031
       
28293031   
       
      1
16171819202122
30      
   1234
       
14151617181920
282930    
       
     12
31      
     12
3456789
10111213141516
17181920212223
       
© All rights reserved © MKProtidin.Com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com