উজ্জ্বল রায়, নড়াইল জেলা প্রতিনিধিঃ সভ্যতার ত্রুমবিকাশ আর আধুনিকতার ছোঁয়ায় বিলুপ্ত প্রায় কিশোর ও কিশোরীদের পুতুল খেলা। গ্রাম-গঞ্জে পুতুল খেলা খেলেনি এমন মেয়ে খুজে পাওয়া মুশকিল। উজ্জ্বল রায় নড়াইল থেকে জানান, এক সময় নড়াইল জেলায় গ্রাম বাংলায় বিভিন্ন এলাকায় মেলায় যেমন রথের মেলা, বৈশাখী মেলা, শিবরাত্রি, দশহারার মেলা , পৌষ সংত্রুান্তি ও নানা পাবর্ণে হরেক রকমের পুতুল পাওয়া যেত এখন প্লাস্টিকের পুতুলেরও চল হয়েছে। অবুঝ অতিথেয়তার খেলায় মেতে উঠতো এক সময় গ্রামের সহজ সরল কিশোর ও কিশোরীরা । কল্পনা থেকে বাস্তবতায় রূপ দেওয়ার প্রতিভাই হচ্ছে পুতুলের বিয়ে খেলা। কোমল হাতের পরশে দর্জির কাছ থেকে টুকরা কাপড় দিয়ে তৈরি করে ছেলে- মেয়ে বর- কনে নতুবা কলার গাছের ডোগোল দিয়ে তৈরি করতো।
রান্না-বান্না, সন্তান লালন- পালন মেয়ে পুতুলের সাথে ছেলে পুতুলের বিয়ে ইত্যাদি নানা বিষয়ের অভিনয় করে খেলা হতো পুতুল খেলা। আসলে পুতুল খেলার মধ্যে পুরো সংসারের একটা প্রতিছবি ফুটে ওঠে। পুতুলগুলো যেন ছোট-ছোট সোনামনিদের সন্তান। মায়ের মতোই স্নেহ আর আদর দিয়ে খাওয়া থেকে শুরু করে ঘুম পাড়ানো পর্যন্ত সব কাজই করে খুকুমনিরা। কেবল মাত্র আদর- সোহাগই নয় প্রয়োজনে শাসনও করে তাদের পুতুল সন্তানকে।
মিছেমিছি বিয়ে খেলায় ব্যস্ত গ্রামীন সরলা বনিতা। নিজেদের মতো করে পছন্দের খেলার সাথীর পুতুলের সাথে বিয়ের প্রস্তাব পাঠায় ঘটকের মাধ্যমে। প্রথা অনুযায়ী বর বা কনে পক্ষের বাড়িতে সওদা পাঠান।
অবুঝ কিশোর -কিশোরীদের মধ্যে অতিথীয়তার মান অভিমানও সৃষ্টি হয়। পরম আত্মীয়তার সম্পর্কের বন্ধনে জড়িয়ে পড়ে গ্রামের কোমল মতি ছেলে-মেয়ে। আর এ সম্পর্কের টানে জড় বস্তুর প্রেমে আকৃষ্ট হয় জীবজগৎ। জীবন জগতে প্রত্যেক জীব বৈচিত্র্যময় সম্পর্ক জালে আবদ্ধ। কেউ সাজে পুতুলের মা আবার কেউবা বাবা। মাসি-পিসি,ভাই-বোন,ননদি-দেবর,শ্বশুর-শ্বাশুর সকলেই মমতাময়ীর ভুমিকায় অবতীর্ণ হয় ।
গর্ভ ধারনী মা ও বাবার মত কর্তব্য পালন করেন পুতুলের বাবা-মা। পুতুলকে বিবাহ দেওয়া থেকে যাবতীয় কর্তব্য পালন করে। এই মিছেমিছি সম্পর্কের খেলায় গড়ে ওঠে গ্রাম-গ্রামান্তরের ছেলে-মেয়ের সাথে বন্ধুত্ব পূর্ণ গভীর সম্পর্ক। যা জাতি ধর্ম-বর্ণ গন্ডি ভেঙ্গে চুরমার করে।ফলশ্রুতিতে পৃথিবী ভরে উঠে অতিথীয়তার লালন ভুমিরুপে।
যেই বাচ্চাটি সামান্য পুতুল ভাঙায় কেঁদে অস্থির হয়ে যায় সেই বাচ্চাটির মন অনেক কোমল ভাবে বেড়ে ওঠে। তার ভেতরে থাকে মমত্ববোধ। আজকাল বাচ্চাদের মাঝে সেই মমত্ববোধকোথায়? তারা তো ছোট বেলা থেকেই য়াধুনিকতার ছোয়ায় মোবাইল গেম এ মানুষ হত্যা বোমা হামলা করেই তারা যেন পরম আত্মতৃপ্তি পায়। আপনারা কখনো ভেবে দেখেছেন কি নিজের অজান্তেই বাচ্চাদের কোন পথে ঠেলে দিচ্ছেন? বাচ্চাকে লেখাপড়ার নামে দিনরাত শিক্ষক প্রাইভেট নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে আছেন কখনো সুন্দর ব্যাবহার, আচার আচরন, মানুষের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় এসব শিখিয়েছেন কি?
সভ্যতার ত্রুমবিকাশে তারা আজ হয়ে উঠেছে নিষ্ঠুর প্রতারক এক যন্ত্র, নেই কোন মানবতা যেন এক কাঠের পুতুল। আমরা নিজেরাই নিজেদের বাচ্চাদের মানুষ হওয়ার শিক্ষা দেইনা আবার নিজেরাই বলি আমার ছেলেটা মানুষ হলনা। কেন মানুষ হলনা এর জন্য দায়ী কে? খুজে দেখুন এর জন্য দায়ী আমি আপনি আমাদের এই সমাজ আমাদের এই উন্নত পরিবেশ। যান্ত্রিক খেলনা শুধু শিশুকে নিষ্ঠুরতাই শিক্ষা দেয় না, কেড়ে নেয় সেই মমতাময়ী সম্পর্কের প্রীতি । তাই বলা হয়েছে,”প্রযুক্তি দিয়েছে বেগ,কেড়ে নিয়েছে আবেগ।
যান্ত্রিক পৃথিবীতে কারো কষ্টে কারো মন গলেনা আজকাল। এর চেয়ে বোধয় পুতুল খেলার হারানো দিনগুলো অনেক ভাল ছিল, দিনগুলো এতো নিষ্ঠুর ছিলনা সহজ সরল ছিল প্রতিটা বাচ্চার মন। সামান্য পুতুল ভেঙ্গে গেলে তারা কেঁদে ফেলতো পুতুলের মায়ায়, তাই পল্লী কবি জসীম উদ্দীন তার কবর কবিতায় লিখেছেন এতটুকু তারে ঘরে এনেছিনু সোনার মতন মুখ, পুতুলের বিয়ে ভেঙে কেঁদে ভাসাইত বুক।