সমসাময়িক কবির কবিতা নিয়ে লেখা মুশকিল। তাও আবার যদি সেই কবি হন একান্ত পরিচিত ও আত্মার বন্ধু। বিপুল অধিকারীর সাথে আমার বন্ধুত্ব ত্রিশ বছর হতে চললো। কবিতা নিয়ে যৌবনের সেই “প্রিয় পাঠক” সংগঠন থেকে শুরু করে আমাদের যাত্রা যা আজো চলমান। আমাদের দেখা হয় কম।কিন্তু আমরা একে অন্যের আত্মার ধুকপুক ধ্বনি ঠিকই শুনতে পাই। প্রতিদিন আমরা অনুভব করি, আমরা শেয়ার করি আমাদের চিন্তা, ভাব, আবেগ, ভালোবাসা। ২০১৯ এর একুশে বইমেলায় বিপুল অধিকারীর এই কাব্য গ্রন্থ প্রকাশ হয়েছে। যথারীতি ” বেঙ্গল বই ” এর চায়ের আড্ডায় সে আমাকে উপহার দিয়েছে।
নব্বই দশকের কবিতার আলোচনা করতে অনেক বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করতে হয়। কারন উত্তাল এই সময়ের কবিরা বহুমুখী কবিতা লিখেছেন। ইতিহাস, ঐতিহ্য, প্রেম, রাজনীতি, সমাজনীতি, ধর্মীয় অনুষঙ্গ, ইহজাগতিক, পারজাগতিক বহু বিষয় নিয়ে তাদের কাব্যডালি। লোকচক্ষুর আড়ালে,লজ্জাতুর, মিতবাক, খ্যাতির মোহমুক্ত,একাগ্র সাধনায় যে কজন কবি নব্বই দশকে আমাদের কবিতার আঙিনায় কদম ফেলেছেন কবি বিপুল অধিকারী তাদের একজন।
বিপুল অধিকারীর কাছে জীবন এক সুন্দর আনন্দলোকের মিশ্রণ, তাই তাঁর মন জুড়ে স্বদেশ। তিনি অসংস্কৃত ও অপরিচ্ছন্ন নন। তাই তাঁর ১২৮ পৃষ্ঠার কাব্য গ্রন্থে ১২০ টি কবিতায় লকলকিয়ে ফুটে আছে স্বদেশ চিন্তা ও দেশপ্রেম। সমাজশিল্প জীবনশিল্পের বুনিয়াদ।আর জীবন শিল্প মূল্যবোধেরই অভিব্যক্তি। বিপুল অধিকারী যখন লিখেন,
রাষ্ট্র যেহেতু আমার
আমি আমার অধিকারের কথা বলবোই
গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে
আকাশ কে জানিয়ে বাতাস কে জানিয়ে….”।পৃষ্ঠা ২৫।
কবি বিপুল অধিকারীর এই কাব্য গ্রন্থ পাঠ করতে যেয়ে একটু থতমত খেয়ে যাই। অধিকাংশ কবিতা স্বদেশ ভাবনায় নির্মিত। সহজ, সরল প্রাঞ্জল। বুঝতে অসুবিধা হয়না কবি আমাদের কি ইংগিত করছেন।
” কার হাতে দিয়েছো তুলে
হাতুড়ি বাটাল ছেনি
জানে কি সে পাথরের মর্ম? পাথরের ধর্ম
বোঝে কি সে পাথরের গুনাগুন”… পৃষ্ঠা ৫২।
কিংবা
” নষ্ট খেলার মাঠ,নষ্ট পথ প্রদর্শক,হলো নষ্ট দৃষ্টি
নষ্ট ইচ্ছেগুলো,নষ্ট ফুটবল ছুটি, নষ্ট অঝোর বৃষ্টি
নষ্ট বুড়িগঙ্গা ইছামতী আমার করতোয়া,নষ্ট দুপাশ
বালুদস্যু নষ্ট করে,ভ্রষ্ট করে এই বেঁচে থাকার আশ”… পৃষ্ঠা ৬৩।
চিত্র আঁকতে যেয়ে কবি কোনো রাখঢাক করেননি।তিনি চিত্র এঁকেছেন তাঁর মতোন করে। কিন্তু বোদ্ধা মহলে তিনি প্রশ্ন রেখেছেন সমাজের অসংগতি বিভিন্ন বিষয় নিয়ে। কবির কাজ স্বপ্ন দেখানো। কবি স্বপ্নের মধ্যে দিয়ে সমাজের নানান অনাচারকে সামনে এনেছেন। সাম্প্রতিক বিষয় নিয়ে এধরনের কবিতা প্রসব করা অনেক দুরূহ। কারন এতে কবিতার আলো আঁধারের রূপের ব্যত্যয় ঘটতে পারে কিংবা কবিতার সৌন্দর্য ম্লান হতে পারে।কিন্তু কবি দারুণ মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। কবিতার দেহকে ডামাডোলের ভেতরে নিয়ে যেয়েও তিনি এর সৌন্দর্য ম্লান হতে দেননি। আমি অবাক হয়ে পাঠ করি…
” আততায়ী সন্ধ্যেরা পৌঁছে গেছে ঘরে ঘরে
এখন ঘনীভূত অন্ধকার ছড়াচ্ছে রক্তলোলুপ ত্রাস,অথচ কোথাও কোনো আর্তনাদ নেই, বিলাপ নেই, শনশন হাওয়ারাও
নিশ্চুপ বড়,ভুলে গেছে স্বগত প্রলাপ,মঙ্গল শাখ….. পৃষ্ঠা ৭১।
নব্বই দশকের কবিদের কবিতায় ভাষায় এক্সপেরিমেন্ট হয়েছে। যার ছাপ খুঁজে পাই বিপুল অধিকারীর কবিতায়ও। কবি এক অদ্ভুত সরলতার মধ্যে দিয়ে সমাজের নানান বিষয়কে টেনে কবিতায় উপস্থাপন করে আনন্দ ও বেদনার মিশেল স্রোতে অবগাহন করেছেন। এটা কবির মূল্যবোধ। কবির এই মূল্যবোধকে শ্রদ্ধা করি। আমাদের মনে রাখতে হবে দার্শনিক যাকে Superstructure বলেছেন তার গোড়ায় আছে মূল্যবোধ।বিপুল অধিকারী সম্ভবত সেই Superstructure এর দিকে লক্ষ্য রেখেই তার এই কাব্যগ্রন্থের main structure গড়ে তুলেছেন। সমাজকে জাগাতে এধরনের কবিতা চর্চা ইতিহাসের সামিয়ানার নীচে আসন পেতে পারে একথা বলা যায়। কারণ, কবির কাজ যেহেতু স্বপ্ন দেখানো। কবি স্বপ্ন দেখান। সমাজে অসংগতি দেখা দিলে কবি তাঁর লেখার শৈল্পিকতায় তা চিত্রায়িত করেন।সেখানেও থাকে আশার বাণী। বিপুল অধিকারী সমাজমনস্ক কবি। তাঁর কবিতা পাঠে প্রেম, ভালোবাসার পাশাপাশি সমাজের নানান দিক ফুটে থাকে। তাঁর কবিতার বাগানে শুধু এক রকমের ফুল ফোটেনা। হরেকরকমের ফুলের গাছ আছে তাঁর কবিতার বাগানে।
২০২০ সালে কবি বিপুল অধিকারীর দুটি কাব্য গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। বই দুটির নাম, “কুড়িয়ে নিচ্ছি বিরুদ্ধ গোলাপ” আর ” দক্ষিণ সমুদ্রে যাবো “। এই দুটি কাব্য গ্রন্থ নিয়েও আলোচনা করবো নিকট ভবিষ্যতে।
তৌফিক জহুর
কবি ও সম্পাদক,
উদ্যান