বর্তমান সময়ে প্রতিদিন অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতির নতুন হিসেব কষতে হচ্ছে। করোনার ধাক্কায় বিপর্যস্ত উৎপাদন, বিপণন এবং সর্বোপরি কর্মসংস্থানের ঝুঁকি তুলে ধরে জাতিসংঘ বলেছে এ বছর বিশ্ব অর্থনীতি ৩.২% সঙ্কুচিত হবে। কিন্তু ১৫ মে ২০২০ এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্কের (এডিবি) প্রকাশিত নতুন সমীক্ষায় দেখা গেল, তা হতে পারে ৫.৮ থেকে ৮.৮ লক্ষ কোটি ডলারের লোকসানে। যা গোটা পৃথিবীর জিডিপি-র ৬.৪% থেকে ৯.৭ শতাংশের সমান। যা বৈশ্বিক অর্থনীতিতে করোনাজনিত ক্ষতির পরিমাণ এপ্রিল মাসে প্রকাশিত ‘বিশ্ব অর্থনৈতিক পূর্বাভাস’ প্রতিবেদনের তুলনায় দ্বিগুণ প্রাক্কলন করেছে। আর জাতিসংঘে আশঙ্কা, বিশ্ব অর্থনীতির যে ক্ষয়ক্ষতি হতে চলেছে, তা ১৯৩০ সালের মহামন্দার পরে আর দেখা যায়নি। এর জেরে আগামী দু’বছর বিশ্ব অর্থনীতির বহর কমতে পারে ৮.৫ লক্ষ কোটি ডলার।
বাংলাদেশের অর্থনীতি পৃথিবীর অন্যসব দেশ থেকে ভিন্ন নয়। অর্থাৎ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থাও চাপের মুখে তাই বিভিন্ন দেশর মত বাংলাদেশ সরকারও তারল্য সংকট মোকাবেলার উদ্যোগ নিয়েছে। দেশ প্রান্তিক মানুষের জন্য বিভিন্ন সাহায্যেও পাশাপাশি হাতে নগদ অর্থ পৌঁছে দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। ক্রয় ক্ষমতা কমার কারণে পণ্য ব্যবহারে যে ব্যাপক ঘটতি দেখা যাবে। তাই সরকারের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে হলে বিভিন্ন অর্থনৈতিক উদ্যোগের পাশাপাশি চাই রাজস্ব আদায়ের জোর উদ্যোগ।
আর রাজস্ব আয়ের একটা বড় অংশ জোগান আসতে পারে জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর তামাকজাতদ্রব্য খাত থেকে। এতে একদিকে যেমন জনস্বাস্থ্য রক্ষা পেতে পারে তেমনি রাজস্ব আয় ও বাড়বে। আর বর্তমান সময়ে বাংলাদেশে কোভিড-১৯ সংকট মোকাবেলায় যেসব গুরুত্বপূর্ণ ও সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে সেগুলো তামাক নিয়ন্ত্রণে জোর উদ্যোগ গ্রহণ সময়ের দাবী। এছাড়া মহামারী চলাকালীন অবস্থায় অর্থনৈতিক চাপের মধ্যে জাতীয় বাজেট প্রণয়ন সরকারের জন্য একটা বড় চ্যালেজ্ঞ হিসেবে দেখা দিয়েছে। একদিকে সরকারের জনস্বাস্থ্য নিয়ে ভাবতে হবে আবার দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতি এগিয়ে নিতে হবে।
কোভিড ১৯ রোগের সাথে তামাকজাতদ্রব্যের ব্যবহারের একটা বড় ভূমিকা আছে। বিশেষ করে যারা ধূমপান করতে করতে ফুসফুস দূর্বল কওে ফেলেছে। ধূমপায়ীদের ফুসফুসের যতেœর কথা মাথায় রেখে ধূমপান ত্যগ করতে হবে। ‘দ্য নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিন’-এ প্রকাশিত সমীক্ষায় দেখা যায়, অধূমপায়ীদের তুলনায় প্রায় তিন গুণ সংখ্যক ধূমপায়ী জটিল অবস্থায় ক্রিটিকাল কেয়ার ইউনিটে ভর্তি হয়েছেন। তাদের কৃত্রিমভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস চালাতে হয়েছে। এরপরও তাদের বেশিরভাগই মারা গিয়েছেন। এছাড়া ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নালের (বিএমজে) এক গবেষণা বলছে, দিনে একটি সিগারেট খেলেও হৃদরোগের ঝুঁকি ৫০ শতাংশ বেড়ে যায়। স্ট্রোক বা মস্তিস্কে ক্ষরণের ঝুঁকিও বাড়ে ৩০ শতাংশ। নারীদের ক্ষেত্রে এই ঝুঁকি আরো বেশি, ৫৭ শতাংশের মত। কোভীড ১৯ কারনে কিছু দেশে অতিরিক্ত ধূমপায়ীদের মধ্যে ধূমপানের মাত্রা কমানোর একটি প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, তারা মনে করছেন এতে তাদের ঝুঁকি কমছে। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা ধূমপান কমানো নয় ধূমপান একবারে ছেড়ে দেয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন। চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের সাথে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থাও সুর মিলিয়ে বলছে, যারা ধূমপান করেন তাদের কোভিড ১৯ সংক্রমণের ঝুঁকি বেশি হবার সম্ভাবনা আছে। এবং তারা আরো বলেছে ধূমপান করার সময় হাতের আঙুলগুলো ঠোঁটের সংস্পর্শে আসে এবং এর ফলে হাতে বা সিগারেটের গায়ে লেগে থাকা ভাইরাস মুখে চলে যাবার সম্ভাবনা বেশী থাকে। এভাবে বিশ্বের বিভিন্ন সংস্থা করোনাকালের প্রথম থেকেই ধূমপায়ীদের সতর্ক করে চলেছে। এছাড়া ধূমপান রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। তাই তামাক সেবন ও ধূমপান করোনা কেন, অন্য অসুখও হতে পারে। এখন আমরা যদি দেখি বাংলাদেশে তামাক ব্যবহার জনিত সমস্য কতটকুু বা এর ক্ষতির পরিমান কি তাহলে দেখব এষড়নধষ অফঁষঃ ঞড়নধপপড় ঝঁৎাবু ২০১৭ হিসাব মতে বাংলাদেশে বর্তমানে ৩৫.৩ শতাংশ অর্থাৎ ৩ কোটি ৭৮ লক্ষ প্রাপ্তবয়স্ক (১৫ বছর এবং তদূর্ধ্ব) মানুষ তামাক সেবন করে। নারীদের মধ্যে এই হার ২৫.২ শতাংশ এবং পুরুষদের মধ্যে ৪৬ শতাংশ। দেশে ধোঁয়াবিহীন তামাক বা গুল, জর্দা, সাদাপাতা ইত্যাদি ব্যবহার করে থাকে নারী ২৪.৮% এবং পুরুষ ১৬.২% যা মোটের হিসেবে ২০.৬ শতাংশ এবং ধূমপায়ী ১৮ শতাংশ এর মধ্যে পুরুষ ৩৬.২%, নারী ০.৮%। এ পরিসংখ্যন মতে বিশ্বের তামাক ব্যবহারকারী দশটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ এখনো অন্যতম। তামাকের ব্যবহার ও অন্যান্য কারনে বাংলাদেশে অসংক্রামক রোগের প্রকোপও দিন দিন বেড়ে চলেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে হৃদরোগে কারনে মৃত্যুর ৩০ শতাংশের, ক্যান্সারে মৃত্যুর ৩৮ শতাংশের, ফুসফুসে যক্ষার কারণে মৃত্যুর ৩৫ শতাংশের এবং অন্যান্য শ্বাসতন্ত্রজনিত রোগে মৃত্যুর ২০ শতাংশের জন্য ধূমপান দায়ী।
দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক ও জনস্বাস্থ্যর বিষয় বিবেচনায় রেখে অর্থের জোগান নিশ্চিত করার জন্য আমরা যদি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ক্যাম্পেইন ফর ট্যোবাকো ফ্রি কিডসসহ ছয়টি আন্তর্জাতিক সংস্থার সম্মিলিত গবেষণার ফলাফলে দেখি, তামাক-কর ও মূল্য বৃদ্ধির প্রস্তাব বাস্তবায়ন করা হলে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত অতিরিক্ত রাজস্ব আয় সম্ভব। এছাড়াও ৩ শতাংশ সারচার্জ থেকে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা বাড়তি রাজস্ব আয় করা যাবে। অতিরিক্ত এই অর্থ থেকে সরকার তামাক ব্যবহারের ক্ষতি হ্রাস করতে পারবে আবার মহামারীকালীন স্বাস্থ্য ব্যয় এবং প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নে ব্যয় করতে পারবে। একইসাথে দীর্ঘমেয়াদে ৬ লক্ষ বর্তমান ধূমপায়ীর অকাল মৃত্যু রোধ করা সম্ভব হবে এবং প্রায় ২০ লক্ষ প্রাপ্তবয়স্ক ধূমপায়ী ধূমপান ছেড়ে দিতে উৎসাহিত হবে।
আমরা যদি দেখি গত ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তামাক ব্যবহারের অর্থনৈতিক ক্ষতির (চিকিৎসা ব্যয় এবং উৎপাদনশীলতা হারানো) পরিমাণ ছিল ৩০ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা। বাংলাদেশে তামাকপণ্য খুবই সহজলভ্য হওয়ায় তামাকের ব্যবহার কাক্ষিত মাত্রায় কমছে না এবং তামাকজনিত মৃত্যু ও ক্ষয়ক্ষতি বেড়েই চলছে। সিগারেটের ৪টি মূল্যস্তর এবং স্বল্প দামে তামাকপণ্য ক্রয়ের সুযোগ থাকায় তামাকের ব্যবহার হ্রাসে কর ও মূল্যপদক্ষেপ সঠিকভাবে কাজ করছেনা। তামাকের দাম বেশি হলে তরুণ জনগোষ্ঠী তামাক ব্যবহার শুরু করতে নিরৎসাহিত হয় এবং বর্তমান ব্যবহারকারীরাও তামাক ছাড়তে উৎসাহিত হয়। বাংলাদেশে মোট জনগোষ্ঠির ৪৯ শতাংশই তরুণ। এই বিশাল তরুণ সমাজকে তামাকমুক্ত রাখার জন্য সকল তামাকপণ্যের কর ও দাম বাড়িয়ে তরুণদের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে নিয়ে যেতে হবে। অন্যদিকে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুত ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ অর্জন করতে হলে এখন থেকেই তামাকের ব্যবহার দ্রুতহারে কমাতে হবে এবং এক্ষেত্রে উচ্চ করারোপের মাধ্যমে ২০২১ সালের মধ্যে তামাক ব্যবহারের হার ২৮.৪ শতাংশে নামিয়ে আনতে হবে।
তাই সরকারের জনস্বাস্থ্য রক্ষা ও দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য দীর্ঘমেয়াদী কৌশল হিসেবে তামাকের কর বৃদ্ধির প্রচুর সুযোগ রয়েছে। এক্ষেত্রে কোভিড-১৯ সংকট মোকাবেলায় ও দেশের উন্নয়ন অব্যহত রাখতে ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে তামাকপণ্যের সুনিদিষ্ট প্রস্তাবনা হচ্ছে- সিগারেটের মূল্যস্তর সংখ্যা ৪ থেকে ২ টি (নিম্ন এবং প্রিমিয়াম) নামিয়ে আনা, ৩৭+ টাকা এবং ৬৩+ টাকা এই দুইটি মূল্যস্তরকে একত্রিত করে নি¤œস্তরে নিয়ে আসা; নি¤œস্তরে ১০ শলাকা সিগারটের খুচরা মূল্য ন্যুনতম ৬৫ টাকা নির্ধারণ করে ৫০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক এবং ১০ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা, ৯৩+ টাকা ও ১২৩+ টাকা এই দুইটি মূল্যস্তরকে একত্রিত করে প্রিমিয়াম স্তরে নিয়ে আসা; প্রিমিয়াম স্তরে ১০ শলাকা সিগারেটের খুচরা মূল্য ন্যুনতম ১২৫ টাকা নির্ধারণ করে ৫০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক এবং ১৯ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা, বিড়ির ফিল্টার এবং নন-ফিল্টার মূল্য বিভাজন তুলে দেয়া, ফিল্টারবিহীন ২৫ শলাকা বিড়ির খুচরা মূল্য ৪০ টাকা নির্ধারণ করে ৪৫% সম্পূরক শুল্ক ও ৬.৮৫ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা, এবং ফিল্টারযুক্ত ২০ শলাকা বিড়ির খুচরা মূল্য ৩২ টাকা নির্ধারণ করে ৪৫% সম্পূরক শুল্ক এবং ৫.৪৮ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা, ধোঁয়াবিহীন তামাকপণ্যের (জর্দা ও গুল) মূল্য বৃদ্ধি করা, প্রতি ১০ গ্রাম জর্দার খুচরা মূল্য ৪০ টাকা এবং প্রতি ১০ গ্রাম গুলের খুচরা মূল্য ২৩ টাকা নির্ধারণ করে ৪৫% সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা, এবং প্রতি ১০ গ্রাম জর্দা ও গুলের উপর যথাক্রমে ৫.৭১ টাকা এবং ৩.৪৫ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা, সকল ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ ভ্যাট বলবৎ রাখা এবং সকল তামাকপণ্যের খুচরামূল্যের ওপর ৩ শতাংশ হারে সারচার্জ আরোপ করা।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে তামাকমুক্ত করা হবে বলে অঙ্গিকার করেছেন। তিনি আইনের সুফল পেতে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা জরুরী বলেও বিভিন্ন সময় বলেছেন। বর্তমানে মহামারিকালীন সময়েও তামাক কোম্পানিগুলো নানা কৌশলে ক্ষতিকর তামাকের ব্যবসা সম্প্রসারণের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। যা সরকারের জনস্বাস্থ্য নীতির বিপরিতে অবস্থান এবং জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় অন্তরায়। তামাক কোম্পানিগুলো করোনা প্রাদুর্ভাবের সময়কালে বিশেষ অনুমতি সংগ্রহ করে উৎপাদন চালু রেখেছে এবং নিজেদের কর্মচারী এবং তামাক শ্রমিকদের মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে। করোনাকালীন সতর্কতার কথা চিন্তা করে ইতোমধ্যে ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং বতসোয়ানা তামাকজাতদ্রব্য বিক্রয়ের ওপর সাময়িক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। বাংলাদেশেও এখন তামাক বিপণন বন্ধ সময়ের দাবি। এছাড়া তামাক নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি শুধুমাত্র আমাদের এসডিজি ৩ এর লক্ষ্যমাত্রা অর্জনেই সহায়ক হবে না, তামাকের বিরুদ্ধে লড়াই আমাদের আরও অনেক লক্ষ্য অর্জনের অগ্রগতি এনে দেবে। যার মধ্যে রয়েছে- সব ধরনের দারিদ্র্য-ক্ষুধার অবসান, টেকসই কৃষিকাজে সহায়তা, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে উন্নীত করা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের নিয়ন্ত্রনে ভূমিকা রাখা ইত্যাদি।
লেখক: ইকবাল মাসুদ
পরিচালক, স্বাস্থ্য সেক্টর, ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন, ইন্টারন্যশনাল সার্টিফাইড এ্যডিকশন প্রফেশনাল
সদস্য, জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ টাস্কফোর্স, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়
সদস্য, জাতীয় মাদক বিরোধী কমিটি, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।