অামার বাড়ী সাতক্ষীরা। সাইক্লোন, অাইলা, জলোচ্ছ্বাস ইত্যাদি দূর্যোগ কাছ থেকে দেখেছি অনেক। তবে নদীভাঙনের ভয়ঙ্কর চিত্র অাগে দেখিনি নিজ চোখে। গতকাল শরীয়তপুরের নড়িয়ায় ভাঙন কবলিত এলাকা দেখলাম। ভয়ঙ্কর এবং অতিশয় ভয়ঙ্কর ব্যাপার।
একটা ফোকগানে শুনেছি-‘সব দিয়ে যার সব কেড়ে নাও, তার তো প্রাণে সয় না… তোমার দিল কি দয়া হয় না।’ গানটির মর্ম এখানে না গেলে বোঝা যাবে না। নদীপাড়ের বিধাতা অাসলেই বে-দিল। না হলে এতগুলো সবহারা মানুষের অার্ত্মনাদে সাড়া দেন না কেন?
দেখলাম ৫০ শয্যার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নদীতে মুখ থুবড়ে পড়ে অাছে। অসংখ্য সাধারণ ও বিলাসবহুল বাড়ীও তেজস্বী ঢেউয়ের তোড়ে ডুবে গেছে। কিছু বাড়ী ল্যাংড়া হয়ে অসহায়ত্বের জানান দিচ্ছে। জানলাম প্রায় ৭০০০ পরিবার অর্থ্যাৎ প্রায় ৩৫০০০ মানুষ অপ্রস্তুতভাবেই বাস্তুচ্যুত হয়ে পড়েছে। এদের কিছু নেই; কিচ্ছুটি নেই। এরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিজের গোছানো অস্তিত্ব ‘নাই হয়ে’ যেতে দেখেছে। বিভিন্ন শহরের ভাসমান বস্তি এখন এদের ঠিকানা হবে।
হাতে বড় সাইজের ডিএসএলঅার ক্যামেরা দেখে কিছু অসহায় মহিলা ছুটে এলেন। এদের চোখে কান্না নেই। তবে খেয়াল করে দেখলে বোঝা যাবে বিধাতার প্রতি এদের ক্ষোভ রয়েছে। জিজ্ঞাস করলেন-‘ ছার অাপনি কোন চ্যালেনের লোক?’ অামি বললাম- ‘অামি চ্যানেলের না’। তারা বিরক্ত হয়ে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। মূলত মিডিয়ার মাধ্যমে তারা তাদের দূর্দশার কথা জানতে চান।
অনেককে দেখলাম অদূরে ফাঁকা বিলে থাকবার অায়োজন করছেন। রোদ বৃষ্টিতে একাকার। নতুন কিছু টিনের অার বাশেঁর দোকান গজিয়েছে। শুনলাম এদিককার বেশিরভাগ পরিবারের দু’একজন ইতালীতে কাজ করেন। তাদের এবং সরকারী সহায়তায় হয়তো টিন ঘিরে অাপাতত রাত কাটানোর ব্যবস্থা তাদের হবে। তবে তাদের অধিকাংশই ফকির হয়ে রাস্তায় নামবে সন্দেহ নাই। অবস্থাপন্ন অবস্থান থেকে বিধাতাই তাদেরকে ফকির বানিয়ে ছাড়লো!
বিকেলের দিকে অাশপাশ থেকে অসংখ্য মানুষ বউ বাচ্চা নিয়ে ভাঙন দেখতে অাসে। ফলে বিকেলের দিকে ভাঙন এলাকা স্পটে পরিণত হয়! কিছু বাদাম বিক্রেতা, অাচার- সিংড়া- পুরি বিক্রেতা মেলার অাবহে অদূরে সারি দিয়ে দোকান পেতে বসেছে। এমন কি দু-একটি খেলনা, বাঁশির দোকানও পাবেন। অসহায় মানুষের অসহায়ত্বকে উপলক্ষ্য করে এরা উৎসবে মেতেছে। মড়ার উপর খড়ার ঘা অার কি! এই অায়োজন শক্ত হাতে তুলে দেয়া উচিৎ।
ভাঙন কবলিত অসহায় মানুষেরা তাদের এই বিপদে কি চাইতে হবে ঠিক করে জানেন না। জানবার অবস্থাও তাদের নেই। কোনটা ছেড়ে কোনটা চাইবেন? অনেকের চাওয়ার অভ্যাসও নেই। অাপন ভিটে-মাটি ছেড়ে হঠাৎ ‘পায়ের তলায় মাটি হারিয়ে’ তারা দিশেহারা। কিন্তু অামরা যারা মাথার উপর অাশ্রয় অার পায়ের তলায় মাটি নিয়ে বেঁচে অাছি তাদের উচিৎ পাশে দাঁড়ানো। কিভাবে দাঁড়াবো, কিভাবে ভালবাসার হাত লম্বা করবো সেই ভাবনাটা স্বউদ্যোগেই করতে হবে।
নদী নিয়ে তো বাঙালি কম গান গায় নি। কম প্রার্থনা করেনি। তবুও অাক্রোশী নদী কথা রাখেনি। কাল রাত অবধি সেখানে ছিলাম। সন্ধ্যা বেলা মাগরিবের অাজান হওয়ার সাথে সাথে অসহায় মানুষ অদূরের মসজিদে ঢুকেছে। হয়তো অাক্রোশী নদীর নামে খোদার কাছে নালিশ দিয়েছে। নালিশের পরেও নদী শান্ত হয়নি। উপরন্তু সন্ধ্যার পর নদীর ওপর শরৎ এর অাকাশে উদিত এক বেহায়া চাঁদ দাত কেলিয়ে হেসেছে। তাতে নদী ‘লাই পেয়ে’ অারও উতলা হয়ে উঠেছে।… খোদা তুমি অসহায়ের সহায়। (ছবিগুলো কাল বিকেলে তুলেছি)
মোঃ মনিরুল ইসলাম
প্রাবন্ধিক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক
Email: monirulislamprism@gmail.com