প্রাচীন মিশরীয় টলেমিক বংশের এক কিংবদন্তি। কি ছিলেন ক্লিওপেট্রা মানবি নাকি দেবী? প্রেমিকা নাকি রানী? নাকি ছিলেন মায়াবিনী, কুহকিনী? হ্যাঁ এমনি দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগতে হয় ক্লিওপেট্রাকে নিয়ে। তাকে নিয়ে যেমন লেখা হয়েছে ইতিহাস, তেমনি হয়েছে ইতিহাস বিকৃতিও। তাকে নিয়ে ইতিহাস লিখতে গিয়ে কল্পনা বিলাসিতাও করেছেন অনেকেই। তার জীবন ছিল বৈচিত্র্যময়, বিলাসিতাপূর্ণ। মৃত্যু রহস্যে ঘেরা।
সপ্তম ক্লিওপেট্রা ফিলোপেটর ১৮৬৯ খ্রিষ্টপূর্ব মিশরের আলেকজান্দ্রিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন এবং আগস্ট ১২, ৩০ খ্রিস্টপূর্ব ৩৯ বছর বয়সে মৃত্যু বরণ করেন। ইতিহাসে কেবল ক্লিওপেট্রা নামে পরিচিত, ছিলেন টলেমিক মিশরের সর্বশেষ সক্রিয় ফারাও। তার রাজত্বের পর, মিশর তৎকালীন সম্প্রতি প্রতিষ্ঠিত রোমান সাম্রাজ্যের একটি প্রদেশে পরিণত হয়।
ক্লিওপেট্রা ছিলেন প্রাচীন মিশরীয় টলেমিক বংশের সদস্য। মহামতি আলেকজান্ডারের একজন সেনাপতি আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর মিশরে কর্তৃত্ব দখল করেন ও টলেমিক বংশের গোড়াপত্তন করেন। এই বংশের বেশিরভাগ সদস্য গ্রিক ভাষায় কথা বলতেন এবং তাঁরা মিশরীয় ভাষা শিখতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। ফলে রোসেত্তা স্টোনের সরকারি নথিপত্রেও মিশরীয় ভাষার পাশাপাশি গ্রিক ভাষার প্রচলন লক্ষ্য করা যায়। অপরদিকে ব্যতিক্রমী ক্লিওপেট্রা মিশরীয় ভাষা শিখেছিলেন এবং নিজেকে একজন মিশরীয় দেবীর পুনর্জন্ম হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন।
রূপ-লাবণ্য: তাঁর জীবনীকাররা বলেন ক্লিওপেট্রা ছিলেন নজরকারা ও অসম্ভব রকমের সুন্দরী। তার ঠোট দুটি ছিল গোলাপের পাপড়ির ন্যায়, নাকছিল সুউন্নত, আর চোখজোড়া ছিল অত্যন্ত মায়াময়। তার কণ্ঠস্বর ছিল বীণার তারের ধ্বনির মতো। জীবনিকাররা আরও বলেন, স্বর্গের দেবতা প্লেটোর ছিল মাত্র চারধরনের তোষামোদকারী কিন্তু ক্লিওপেট্রার ছিল হাজারো ধরনের গুণমুগ্ধ ভক্ত ও তোষামোদকারী। ক্লিওপেট্রা অসম্ভব বিলাসবহুল জীবন যাপন করতেন।
পিতার মৃত্যু ও বিয়ে: ক্লিওপেট্রার বয়স যখন আঠারো বছর তখন তার বাবা মারা যান এবং তিনি মিশরের রানী হিসাবে স্থলাভিষিক্ত হন (খ্রিস্টপূর্ব একান্ন অব্দে)। সেই সাথে রাজা হন তার আপন ছোট ভাই ও স্বামী পনের বছর বয়স্ক টলেমী অষ্টম (মতান্তরে ত্রয়োদশ)। অবশ্য ভাই-বোনের এই বিয়ে টলেমী রাজবংশে নতুন কিছু ছিল না। তার বাবা-মাও ছিলেন আপন ভাই বোন। আসলে টলেমী রাজবংশের উত্তরাধিকার যাতে অন্যকারো হাতে না যায় এজন্যই ক্লিওপেট্রার বাবা এই রাজনৈতিক বিয়ের ব্যবস্থা করেন।
পিতার মৃত্যুর পর এই কিশোর-কিশোরী সিংহাসনে বসলেও বেশীদিন টিকতে পারেনি। কিছুদিনের মধ্যেই বিদ্রোহীরা ক্লিওপেট্রাকে বিতাড়িত করেন, যদিও রাজা থেকে যান তার স্বামী/ভাই অষ্টম টলেমী। এসময় রাজনৈতিক ডামাডোলে রোমের সিনেট মিশরে নাক গলানো দরকার মনে করে। এগিয়ে আসেন জুলিয়াস সিজার। সিজার অবশ্য তার প্রতিদ্বন্দ্বী পম্পেইকে পিছু ধাওয়া করেই মিশরে আসেন (যদিও এর আগেই পম্পেইয়ের মৃত্যু হয়)। পম্পেইয়ের দেখা না পেলেও সিজার দেখা পান ক্লিওপেট্রার। রাজ্যহারা ক্লিওপেট্রা সিজারের সাথে দেখা করে তাকে আর্থিক সাহায্যের প্রস্তাব করেন এবং বিনিময়ে সিজারও ক্লিওপেট্রাকে মিশরের সিংহাসনে বসাবার প্রতিশ্রুতিদেন। প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছিলেন জুলিয়াস সিজার, বসিয়েছিলেন ক্লিওপেট্রাকে মিশরের সিংহাসনে। সিজার-ক্লিওপেট্রার প্রেম- বিয়ে নিয়ে অনেক কিংবদন্তী আছে। তাদের এক সন্তানের কথাও শোনা যায় (টলেমী সিজার)। টলেমী সিজারের বাবাকে তা জানা না গেলেও ক্লিওপেট্রার সন্তান ছিল ওই একটাই।
রোম এবং ক্লিওপেট্রা: পম্পেইয়ের সৈন্যদের শায়েস্তা করতে সিজারের দুবছর সময় লাগে। রোমে ফিরে গিয়ে সিজার তার সাফল্য ও বীরত্ব উদযাপনের জন্য এক বিশাল বিজয় উৎসব পালন করেন। সেখানে তিনি ক্লিওপেট্রা-টলেমী দম্পতিকেও আমন্ত্রিত করেন। ক্লিওপেট্রার ছোট বোন আরসিনিও সেই অনুষ্ঠানে নৃত্য পরিবেশন করে সবাইকে মুগ্ধকরেন বলেও ইতিহাসে জানা যায়। সিজার এই উৎসবে ক্লিওপেট্রাকে অসম্ভব সম্মান দেখান। রোম নগরীতে স্থাপিত গ্রিকদেবতা জেনট্রিক্স এর মন্দিরে তিনি ক্লিওপেট্রার স্বর্ণমূর্তি স্থাপন করেন। মূর্তির বেদীতে লিখা ছিল : “মিশরের দেবী”।
রোমে ক্লিওপেট্রা অনেকদিন বেড়িয়েছিলেন। সিজার যেদিন নিহত হন তখনও ক্লিওপেট্রা রোমেই ছিলেন। সিজারের মৃত্যুর পর তিনি দেশে ফিরে আসেন ও রোম সাম্রাজ্যের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে মিশরকে স্বাধীন ও স্বার্বভৌম দেশ হিসাবে ঘোষণা করেন।
এন্টোনিও ও ক্লিওপেট্রাঃ
ক্লিওপেট্রাকে দমন করতে রোম থেকে পাঠান হল সেনাপতি এন্টনিওকে। সিডনাস নদীর তীরে প্রচুর উপঢৌকন সাথে নিয়ে ক্লিওপেট্রা দেখা করেন এন্টনিওর সাথে। ক্লিওপেট্রার রূপের কাছে হার মানেন এন্টোনিও। এখানে তিনি তিন বছর চুটিয়ে প্রেম করেন ক্লিওপেট্রার সাথে আর ওদিকে তার বউ (সম্রাট আগাস্টাসের বোন) অক্টাভিয়া স্বামীর প্রতারণা সহ্য করতে না পেরে অকালে প্রাণ হারান। রোমে ফিরে গিয়ে এন্টোনিও সম্রাটের সাথে আপোষ করতে চাইলেও বিষয়টির মীমাংসা হয়নি। রোম থেকে এন্টোনি আবার মিশরে ফিরে আসেন এবং ক্লিওপেট্রাকে বিয়ে করেন। এই বিয়েই কাল হল এন্টোনিও ও ক্লিওপেট্রার জন্য। রোম সাম্রাজ্য ফুসে ওঠে এন্টনিওর এহেন কাজের বিরুদ্ধে। সিনেট থেকে এন্টনিওকে রাস্ট্রদ্রোহী ঘোষণা করা হয়। তাকে দমনে প্রকান্ড এক নৌবহর নিয়ে এগিয়ে আসেন সম্রাট অগাস্টাস (বোন হত্যার বদলা নিতে ?)।
ক্লিওপেট্রা- সৌন্দর্যের রানী: শতাব্দীর পর শতাব্দী সৌন্দর্য পূজারিদের অন্যতম উপাসনা যেই নারীকে নিয়ে, যার সৌন্দর্যের মায়াজালে আটকা পরেছে অনেক বাঘা বাঘা মানুষ সে আর কেও না, রানী ক্লিওপেট্রা। এই একটি মহিলাকে নিয়ে যুগের পর যুগ ধরে অনেক বড় বড় সাহিত্যিক লিখে চলেছেন নানান উপাখ্যান। কেও লিখেছেন উপন্যাস, কেও গল্প, কেও কবিতা আবার কেও বা অমিত্রাক্ষর ছন্দ। এই তালিকায় যেমন আছে সেক্সপিয়ার, জর্জ বার্নড শ, হেনরি রাইডার হ্যাঁগারড এর মতো মহামহিম সাহিত্যিক, তেমনি আছে ড্রাইডেন প্লুটার্ক, ড্যানিয়েল সহ আরও অনেক সাহিত্যিক। এদের সবাই ক্লিওপেট্রার চারিত্রিক বিভিন্ন রূপ নিয়ে লিখেছেন তাদের উপাখ্যান, তবে সবাই চেষ্টা করেছেন ক্লিওপেট্রার ঐতিহাসিক অবস্থান যথাযথ রাখার। যেমন সেক্সপিয়ার তার এন্টোনিয়ও ক্লিওপেট্রা উপন্যাসে ধারালো লেখনীর মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছেন ক্লিওপেট্রার রূপ সেই সাথে তুলে ধরেছেন এন্টোনিয়ও ও ক্লিওপেট্রার রোম্যানটিসিসম। অন্যদিকে জর্জ বার্নড শ তার সিজার ক্লিওপেট্রা উপন্যাসে সিজার এবং ক্লিওপেট্রার রোম্যানটিসিসম তুলে ধরেছেন। তবে হেনরি রাইডার হ্যাঁগারড তার উপন্যাস ক্লিওপেট্রা তে অসাধারণ ভাবে তুলে ধরেছেন ক্লিওপেট্রার ব্যক্তিত্ব, উচ্চাভিলাষ ও কিছুটা নারী সুলভ অসহায়ত্ব।
ক্লিওপেট্রার প্রেম: ক্লিওপেট্রাকে ঘিরে ইতিহাসে বিতর্ক আর রহস্যের কোনো শেষ নেই। যেমন রহস্যময় তার জীবন ও রাজ্য শাসন তেমনি রহস্যময় তার প্রেম। ক্লিওপেট্রার প্রেম নিয়ে পৃথিবীর ইতিহাসে অনেক গল্প-অনেক কাহিনীর অবতারণা হয়েছে। গল্প-কবিতা-উপন্যাসের পাশাপাশি নির্মিত হয়েছে চলচ্চিত্রও। এমনকি মহান সাহিত্যিক শেকসপিয়ার পর্যনমশ তার নাটকে অমর করে রেখেছেন রানী ক্লিওপেট্রার প্রেমকাহিনীকে। তিনি লিখেছেন অ্যান্টনি-ক্লিওপেট্রা। অন্যদিকে জর্জ বানার্ড শ লিখেছেন সিজার-ক্লিওপেট্রা। অধিকাংশ সাহিত্যকর্মেই প্রাধান্য পেয়েছে ক্লিওপেট্রার প্রেম ও উচ্চাকাঙ্ক্ষা। আর প্রায় প্রত্যেকেই আশ্চর্য দক্ষতার সঙ্গে নিজস্ব স্টাইলে বর্ণনা করেছেন ক্লিওপেট্রার রূপের। বিখ্যাত লেখক হেনরি রাইডার হগাডের লেখা উপন্যাস ক্লিওপেটয় তিনি কিছুটা কল্পনার আশয় নিলেও সেখানে ফুটে উঠেছে ক্লিওপেট্রার ব্যক্তিত্ব, উচ্চাভিলাষ আর কিছুটা নারীসুলভ অসহায়তা। এ ছাঢ়াও ক্লিওপেট্রার চরিত্র নিয়ে লিখেছিলেন বিখ্যাত সাহিত্যিক ড্রাইডেন প্লুটার্ক, ড্যানিয়েল প্রমুখ। ফলে হাজার হাজার বছর পরও ক্লিওপেট্রার প্রেম নিয়ে আলোচনা চলছে আজও। লেখালেখিও থেমে নেই। পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে আলোচিত নারী শাসক ক্লিওপেট্রার জন্ম খ্রিস্টপূর্ব ৬৯ সালে প্রাচীন মিসরের আলেকজান্দ্রিয়ায়। অধিকাংশ ইতিহাসবিদের মতে খ্রিস্টপূর্ব ৫১ অব্দে রোম সম্রাট টলেমী অলেতিস মারা গেলেন। মারা যাওয়ার আগে তার বিশাল সাম্রাজ্য ১৮ বছর বয়সী কন্যা ক্লিওপেট্রা [ক্লিওপেট্রা-৭] ও ১৮ বছর বয়সী পুত্র টলেমী-১৩-কে উইল করে দিয়ে যান। সেই সঙ্গে মৃত্যুর সময় রোমান নেতা পম্পে-কে রাজ্য ও তার সন্তানদের দেখাশোনা করার দায়িত্ব দিয়ে যান। তখনকার মিসরীয় আইন অনুসারে দ্বৈত শাসনের নিয়মে রানী ক্লিওপেট্রার একজন নিজস্ব সঙ্গী থাকা বাধ্যতামূলক ছিল। কাজেই ক্লিওপেট্রাকে বিয়ে করতে হয় তারই ছোটভাই টলেমী-১৩ কে, যখন টলেমির বয়স ছিল মাত্র ১২ বছর। ফলে আইনগতভাবে রাজ্য পরিচালনার দায়িত্বভার অর্পিত হলো ক্লিওপেট্রা এবং তার স্বামী ১২ বছর বয়সী ছোট ভাই ত্রয়োদশ টলেমী এর উপর। ক্ষমতায় আরোহণের পর নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়েও ক্লিওপেট্রা তার শাসন চালিয়ে গেলেন। এরই মধ্যে ৪৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে ফারসালুসের যুদ্ধে দায়িত্বপ্রাপ্ত সেনাপতি পম্পে পরাজিত হলেন। সে বছরই আলেকজান্দ্রিয়ায় ফেরার পথে ফারসালুসের হাতে নিহত হন। যুদ্ধ থেকে পালাতে গিয়ে ক্লিওপেট্রার স্বামী ও ভাই টলেমী-১৩ মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর পর ক্লিওপেট্রা হয়ে ওঠেন মিসরের একচ্ছত্র রানী।
এরমধ্যেই পটভূমিতে আবির্ভাব ঘটলো রোমের পরাক্রমশালী বীর মার্ক অ্যান্টনির। লোকমুখে তিনি ক্লিওপেট্রার রূপ-লাবণ্যের কথা শুনেছিলেন। কিন্তু কিভাবে সেই রূপ-লাবণ্য চাক্ষুষ করবেন? একদিন তিনি রোম থেকে এসে হাজির হলেন ক্লিওপেট্রার কারুকার্যশোভিত প্রাসাদের সামনে। এই খবর গোপন থাকার কথা নয়। দ্রুতই বীর অ্যান্টনির আগমনের খবর পেয়ে গেলেন রানী ক্লিওপেট্রা। মার্ক অ্যান্টনির কথা তিনিও শুনেছেন আগেই। সেই শুরু। অবশ্য কারও কারও মতে মিসর আক্রমণ করতে এসে ক্লিওপেট্রার প্রেমে পড়ে যান রোমান বীর অ্যান্টনি। তবে উভয়ক্ষেত্রেই প্রথম দর্শনেই একে অন্যের প্রেমে পড়ে যান বলে মনে করা হয়। অ্যান্টনির ক্ষেত্রে ব্যাপারটা প্রকট রূপ নিল। শক্তিশালী রোমান বীর যেন ক্লিওপেট্রার ললিতবিভাসে মোমের মতো গলতে লাগলেন। কেবলই অপলক তাকিয়ে থাকা। যতই দেখেন, ততই দেখার আকর্ষণ বেয়ে যায়। চোখের তৃপ্তি হয় না যেন কিছুতেই। এরপর একে অন্যের মধ্যে দেখতে লাগলেন তাদের পরবর্তী জীবন। মার্ক অ্যান্টনি মশগুল ক্লিওপেট্রার প্রেমে। আর ক্লিওপেট্রাও নিঃসঙ্গ জীবনে কেবল একটি সঙ্গীই নয়, বরং তার সিংহাসন রক্ষায় এক পরাক্রমশালী বীরের সমর্থন পেয়ে গেলেন। তারপর নানা ঘাত-প্রতিঘাতের ভেতর দিয়ে এগিয়ে চলে অ্যান্টনিওর জীবন। পত্নী ফুলভিয়ার মৃত্যু এবং পম্পের বিদ্রোহ ঘোষণা এলোমেলো করে দিল বীর অ্যান্টনির সুবর্ণ সময়কে। গৃহযুদ্ধে রীতিমতো বিপর্যস্ত হয়ে পড়লো রোম। এরপর গল্পে ভিন্নমাত্রা যোগ হয়। এর মধ্যেই ক্লিওপেট্রার জীবনে আবির্ভাব ঘটে মধ্যবয়সী বীর জুলিয়াস সিজারের। এলোমেলো মুহূর্তে সিজারকেও আকড়ে ধরেন ক্লিওপেট্রা। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। একসময় অসহায় অ্যান্টনি আত্মহত্যা করেন। সবকিছুর পরিণামে ক্লিওপেট্রাও সাধের জীবন ত্যাগ করতে বাধ্য হন।
ইতিহাসের মায়াজাল ক্লিওপেট্রা: ক্লিওপেট্রা প্রাচীন মিসর এবং ইতিহাসের এক বিস্ময়কর নাম। ইতিহাসের সবচেয়ে বিখ্যাত নারী তিনি। আধুনিক ইতিহাসবিদদের মতে, পরমাসুন্দরী হিসেবে তার খুব বেশি খ্যাতি ছিল না। কিন্তু তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তা, অন্যকে বশ করার প্রত্যয়ী ক্ষমতা, সহজাত রসবোধ এবং প্রচন্ড উচ্চাভিলাষ ও তা বাস্তবায়নের অদম্য ইচ্ছাশক্তির জোরে তিনি সর্বকালের সেরা মহিলাদের কাতারে স্থান করে নিয়েছেন। তাকে মনে করা হয় সম্মোহনী সৌন্দর্য আর সীমাহীন ক্ষমতার অধিকারী হিসেবে এবং সীমিত শক্তিকে অসাধারণ কৌশলে অসীমে নিয়ে যাওয়ার রূপকার হিসেবে।
প্রেম আর মৃত্যু এই নারীর জীবনে একাকার হয়ে গেছে। তিনি যেমন ভালোবাসার উদ্দাম হাওয়া বইয়ে দিতে পারতেন, তেমনি প্রয়োজনে মারাত্মক হিংস্রও হতে পারতেন। পথের কাঁটা মনে করলে যে কাউকে নির্মমভাবে সরিয়ে দিতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠাবোধ করতেন না। রোমান রাজনীতির অত্যন্ত সংকটজনক অধ্যায়ে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি সে যুগের নারীদের মতো সাদামাটা জীবন মেনে নেননি। বরং নিজেই ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। আর তাই শত বছর পরও তাকে স্মরণ করা হয়। তবে অন্য সব কিংবদন্তী চরিত্রের তুলনায় কিওপেট্রা ভিন্ন মাত্রা সৃষ্টি করেছেন। সবাই ইতিহাসের নানা পরিক্রমায় নানাভাবে আবির্ভূত হন। কিন্তু ক্লিওপেট্রা তার জীবিতকালেই শত্রু পক্ষের যে নেতিবাচক প্রচারণার শিকার হয়েছিলেন, এত বছর পরও তা কমেনি। প্রতি যুগেই তার চরিত্রকে নানাভাবে রূপান্তরিত করা হয়েছে। কখনো তিনি শত্রু, কখনো স্বাধীনতাকামী, কখনো যৌন আবেদনময়ী নারী, কখনো খলনায়িকা নানা জনে নানা যুগে এভাবেই তাকে চিত্রিত করে চলেছে। এই কাজটি প্রয়োজনমতো কখনো রাজনীতিবিদ, কখনো সাহিত্যিক, কখনো চিত্রকর, কখনো বর্ণবাদী গোষ্ঠী, কখনো স্বাধীনতাকামীরা করেছেন। মাত্র ৩৯ বছর তিনি বেঁচে ছিলেন। এই স্বল্প সময়েই তিনি একের পর এক নাটকীয় ঘটনার সৃষ্টি করেন। সে যুগের কোনো পুরুষের পক্ষেও যে ধরনের কাজ করা ছিল প্রায় অসম্ভব, তিনি সেসব কাজেরও আঞ্জাম দিয়েছেন। ইতিহাস ও নাটকে তার ব্যাপক উপস্থিতি দেখা যায়। বিশ্ববিখ্যাত অনেক সাহিত্যিকই তাকে নিয়ে কালজয়ী উপাখ্যান রচনা করেছেন। এগুলোর মধ্যে আছে উইলিয়াম শেক্সপিয়রের ‘অ্যান্টনি অ্যান্ড ক্লিওপেট্রা’, জর্জ বার্নাড শর ‘সিজার ক্লিওপেট্রা’, জন ড্রাইডেনের ‘অল ফর লাভ’, হেনরি হ্যাগার্ডের ‘ক্লিওপেট্রা’। অনেক কাহিনীতে ভালো দিকের চেয়ে খারাপ দিককেই প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। হ্যালিওয়েল তাকে ‘দ্য উইকেডেস্ট উইম্যান ইন দ্য হিস্ট্রি’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। দান্তের মতে, লালসার শাস্তি হিসেবে কিওপেট্রা নরকের দ্বিতীয় স্তরে দাউ দাউ করে পুড়ছেন। কারো কারো দৃষ্টিতে তিনি ছিলেন ‘সারপেন্ট অব দ্য নাইল’। অনেকেই তার যৌন আবেদনময়ী দিকটিকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। পশ্চিমা লেখকদের অনেকেই তাকে এশিয়ান হিসেবে এবং এশিয়ানদের সব কিছুই যে খারাপ তা বোঝানোর জন্যও তার নেতিবাচক দিকগুলোকে প্রাধান্য দিয়েছেন বা তাদের উর্বর মস্তিষ্কে অনেক কিছু আবিষ্কৃতও হয়েছে। তা ছাড়া অক্টাভিয়ান তার বিজয়ের পর যাতে শুধু রোমানদের লেখা ইতিহাসই টিকে থাকে সে জন্য মিসরের প্রায় দুই হাজার নথিপত্র পুড়িয়ে দিয়েছিলেন। এ কারণেও প্রকৃত ইতিহাস অনেকাংশেই পাওয়া যায় না।
পরাজয় ও মৃত্যু: খ্রিস্টপূর্ব একত্রিশ অব্দের ২,সেপ্টেম্বর তারিখে অক্টাভিয়ান সেনাদের সাথে যুদ্ধ হয় এন্টোনিও-ক্লিওপেট্রার যৌথ বাহিনীর। কিন্তু এক অঞ্জাত কারণে এন্টনিওকে একা ফেলে ক্লিওপেট্রা তার বাহিনী নিয়ে ফিরে আসেন মিশরে। ফলে নৌযুদ্ধে এন্টোনিও পরাজিত ও নিহত হন।অগাস্টাস সিজার এগুতে থাকেন মিশরের দিকে।
রোম শাসক অগাস্টাস সিজার যখন আলেকজান্দ্রিয়ার রাজ প্রাসাদ দখল করে ক্লিওপেট্রার শয়নকক্ষে প্রবেশ করেন তখন দেখেন হাজারো রত্নমালা বিভূষিত হয়ে রানী ক্লিওপেট্রা শুয়ে আছেন তার সোনার সিংহাসনে। তবে জীবিত নয় মৃত। কিংবদন্তী আছে ক্লিওপেট্রা নাকি সাপের দংশনে আত্মহত্যা করেছিলেন।
ক্লিওপেট্রার মৃত্যুরপর তার একমাত্র সন্তান টলেমী সিজার দেশ থেকে পালিয়ে যান। (শুনা যায় ভারত বর্ষে এসেছিলেন) তবে অগাস্টাস সিজারের গুপ্তঘাতকের চোখ এড়াতে পারেননি। জুলিয়াস সিজারের সন্তান হিসাবে যদি সে কখনো রোম সাম্রাজ্যের সিংহাসন দাবি করে বসে এভয়ে অগাস্টাস তাকে হত্যা করেন। এভাবেই ক্লিওপেট্রা স্ববংশে নিহত হন অগাস্টাস সিজারের হাতে।
ক্লিওপেট্রা যদিও ক্ষমতালোভী ও বিলাসী জীবন যাপন করতেন তবুও তার ব্যক্তিগত জীবনে সস্তা নোংরামির কোন ঘটনা দেখা যায় না। কুৎসাগুলি ছড়িয়েছে মুলত রোমান গল্পকারেরা। রোমানদের সাথে ক্লিওপেট্রার যখন বিরোধ চলছিল তখন তার নামে অপবাদমূলক ও মিথ্যা গল্প ছড়ানোর কৌশল অবলম্বন করেন রোমান কর্তৃপক্ষ।
সাপের কামড়ে মারা যাননি মিশরীয় রানী ক্লিওপেট্রা: প্রাচীন রোমান ইতিহাসে কথিত আছে রানী ক্লিওপেট্রা খৃষ্টপূর্ব ৩০ সালে মাত্র ৩৯ বছর বয়সে সর্প-দংশনে মারা যান। মিশরের শাসক ক্লিওপেট্রা রোমান সাম্রাজ্যের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছিলেন। ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের মিশর বিষয়ক গবেষকরা সর্প বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে মিলে এই গবেষণা চালিয়ে বলছেন ডুমুর ফলের ঝুড়িতে লুকানো যে গোখরো সাপের দংশনে রানী ক্লিওপেট্রা ও তাঁর দুই দাসীর মৃত্যু হয়েছিল সেটা অবাস্তব ও অলীক, কারণ তারা মনে করছেন তিনজনকে ছোবল মারতে সক্ষম এত বড় গোখরো সাপের পক্ষে ওইটুকু ফলের ঝুড়িতে লুকিয়ে থাকা অসম্ভব। এছাড়াও পরপর তিনবার ওই সাপের ছোবলে তিনজনের মৃত্যুও অসম্ভব বলে মনে করছেন তারা।
হাসানূর রহমান সুমন
সিনিয়র সহকারী সম্পাদক
দৈনিক তারবার্তা ও সাপ্তাহিক হিতবানী
ইমেইল: sumon.parves09@gmail.com
তথ্য সাহায্য ও ছবি: wikipedia.org