বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন সেল এর ইনচার্জ ও বাংলাদেশ মফস্বল সাংবাদিক ফোরামের সিনিয়র সহ সভাপতি জনাব সাইদুর রহমান রিমন এর ফেসবুক ওয়াল থেকে হুবহু তুলে ধরা……….
আমার প্রিয়জনরা বরাবরই চারটি বিষয় খুব গুরুত্বের সঙ্গেই খেয়াল করেন, স্মরণে রাখেন। ১) আমি সত্যি সত্যিই খাবারটা খেয়েছি কি না ২) বৃহস্পতিবার মধ্য রাতে আমার মায়ের নির্দেশিত নামাজটা আদায় করেছি কি না তা মনে করিয়ে দেয়া ৩) ৩১ ডিসেম্বর জন্মদিন এবং ৪) লেখা রিপোর্ট না পাওয়া।
আজ একই সঙ্গে বৃহস্পতিবার রাত এবং জন্মদিন- এ দুটি বিষয় স্মরণ করিয়ে দেয়ার সময় অপর দুটি ব্যপারেও তারা তাগিদ দিতে ভুলেননি। আমি সত্যি তাদের প্রতি যার পর নাই কৃতজ্ঞ, চিরঋণী।
প্রতি বছরই আমার জন্মদিনটায় আমার শুভাকাঙ্খীরা ভিন্ন রকম উচ্ছাসে পালন করে থাকেন, দিনটি ঘিরে ঢাকার বাইরে থেকেও শতাধিক প্রিয় মানুষের আগমন ঘটে। ফলে ৩১ ডিসেম্বরের আগে ও পরের ৩/৪টি দিন আলাদা রকম ঘোরে কাটে আমার। কিন্তু এবারের দিনটি আমি মোটেও স্মরণীয় করে রাখতে চাই না, বরং সব আনন্দ, উচ্ছাস, হৈচৈ জলাঞ্জলি দিয়ে- সব কিছুর বিপরীতে শুধুই আমার প্রিয়তমা স্ত্রীর জন্য বিশেষ দোয়া কামনা করছি।
দুই যুগেরও বেশি সময়ের জীবন সঙ্গিনী চামেলী রহমান, তিনি বেশ কয়েকদিন ধরেই অসুস্থ। তারচেয়েও বেশি চিন্তাগ্রস্ত তার ব্রেস্ট ক্যান্সারের আগাম শঙ্কা নিয়ে। ব্রেস্টে টিউমার সাদৃশ্য বস্তুটি ক্যান্সার বহন করছে এমন ভাবনায় একের পর এক পরীক্ষা নীরিক্ষা করেও নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। সবশেষে বায়োপসি পরীক্ষা করা হলেও তার ফরাফল হাতে পাওয়া যায়নি এখনো। এ কারণে শঙ্কা আর দুঃশ্চিন্তা থেকে রেহাই মেলেনি পুরো পরিবারের। অবশ্য পরিবার বলতে আমি, চামেলী আর আমাদের একমাত্র সন্তান উর্মি।
চামেলী ছাড়া আমি আর উর্মি তো পুরোই অন্ধকারে। মেয়েটা আমার নর্থ সাউথ ভার্সিটি থেকে কম্পিউটার সাইন্সে অনার্স করে স্কলারশিপে জার্মানির ক্যামব্রিজে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে অথচ প্লেট, চামচ হাতে নিয়ে এখনো হাঁক ছাড়ে, ‘আম্মু কতটুকু ভাত নেবো?’ আর আমার তো সবই ঠিক আছে কিন্তু গরমকালে ফুলহাতা মোটা শার্ট, শীতকালে হাফহাতা শার্ট শরীরে চাপিয়ে ঘর থেকে বের হওয়ার ক্ষেত্রেই কিছুটা ভুল হয়ে যায়। কতদিন যে চামেলী লিফট পর্যন্ত দৌড়ে গিয়ে টেনে বের করে শার্ট বদলে যেতে বাধ্য করেছে তার ইয়োত্তা নেই। এছাড়া খুবই ছোটখাটো ভুল শুধরে দিতে চামেলীর জুড়ি নেই। যেমন টানা তিন রাত তিন দিন জেগে বিরতিহীন কাজের পর ৪র্থ রাতেও যখন ল্যাপটপ খুলে বসি, তখন তা বন্ধ করিয়ে ঘুমাতে বাধ্য করা। জুতা, স্যান্ডেলে ধুলা ময়লার স্তর পড়ে থাকলেও আমার নজর যায় না, কিন্তু মুচি ব্যাটার মতো চামেলীর নজর এড়ানোর উপায় নেই। তাই জুতা স্যান্ডেল মুছে পরিস্কার করাটাও যেন তার জীবনের রুটিন ওয়ার্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে। পছন্দের খাবারগুলো তৈরি করে ফ্রীজে রাখা এবং বারবারই তা পরিবেশনের চেষ্টা করা।
তবে বিরক্তিকর কাজও তার কম নয়। যতক্ষণ বাসায় অবস্থান করবো ততক্ষণই পানি পানের জন্য ঘ্যানর ঘ্যানর করা। কাউকে যদি ফোনে বলি হ্যা ভাই বসুন আমি রাস্তায় আছি, এইতো ১০ মিনিটের মধ্যেই হাজির হবো। চামেলী তা শুনলেই বিপদ। অনুনয় বিণয় করে আবার তাকে ফোন করিয়ে বলিয়ে ছাড়বে যে, ‘ভাই আমি এখনো বাসায় আছি, কয়েক মিনিট পরেই রওনা দিবো।’ চামেলীর বক্তব্য হচ্ছে, কোনো কারণ ছাড়া শুধু শুধু মিথ্যা বলাটা খুবই অন্যায়। মিথ্যা আশ্বাস দেয়া আরো বেশি অপরাধ। তার আরেকটি বিষয়ে ঘ্যানর ঘ্যানর আছে তা হলো নামাজ আদায় নিয়ে। নামাজের গাফিলতি নিয়ে মেয়েকে এখনো চর থাপ্পর মারতে এক মুহূর্তও দেরি হয় না তার। তবে আমাকে না মারলেও তার বেজার হওয়ার মুখ চোখ দেখে বাধ্য হই বিছানা ছেড়ে ওজু করতে, নামাজে দাঁড়াতে। সে শুধু ফজরের নামাজ ক্ষেত্রেই আমার উপর এ চাপাচাপি করার সুযোগ পায়, বাকি সময়তো আমার টিকিটিও ছুঁতে পারে না।
আমি বাসা থেকে বেরিয়ে যাবার সময় যেমন অবস্থাতেই থাকুক না কেন, দ্রুত এসে সামনে দাঁড়িয়ে দোয়া দরুদ পাঠ করে আমার শরীরে ফুঁ দেয়াটা তার অত্যাবশ্যকীয় কাজ। দেখে দেখে মেয়েটাও তা রপ্ত করে ফেলেছে। কখনো চামেলী অনুপস্থিত থাকলে দরজা খোলার শব্দেই ছুটে আসে উর্মি, সেও সামনে দাঁড়িয়ে দোয়া দরুদ পাঠ করবে, ফুঁ দিবে তারপর বলবে দেখে শুনে যেও বাবা। আমি সত্যিই অবাক হই, সারাটা রাত চামেলী নামাজে, তসবীহ পাঠে কীভাবে কাটিয়ে দেয়! দারুণ স্বাচ্ছন্দে, মনের আনন্দে। এরই ফাঁকে ফাঁকে সংসার, জীবন, আগামি দিন আর আমার পেশাগত কর্মকান্ডের খোঁজ খবর নিয়ে থাকে চামেলী। ইদানিং অসুস্থতাজনিত কারণে হয়তো তার দীর্ঘসময় জায়নামাজে বসে থাকা কষ্টকর হয়ে পড়ে, তাইতো কাতর মিনতি জানায়, তাহাজ্জত নামাজের জন্য রাত পৌণে তিনটার দিকে একটু ডেকে দিও প্লীজ। প্রায়ই তার ঘুমন্ত চেহারার দিকে তাকিয়ে দুর্বলতার প্রতিচ্ছবি দেখতে পাই বলে ডেকে ঘুম ভাঙ্গাতে চাই না। কিন্তু তিনটা দশে তার মোবাইলের এলার্ম বেজে উঠলে আর তাকে আটকায় কে?
আমার এবং আমার মেয়ের জীবনে অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে থাকা সেই চামেলীর একটা দিনের অনুপস্থিতি আমরা ভাবতেও পারি না। তারই গুরুতর অসুস্থতার শঙ্কা আমাদের কতোটা নির্জিব করতে পারে তা বোধকরি সকলের কাছেই বোধগম্য। সেই মানুষটিকে অসুস্থতার শয্যায় রেখে কোনো উচ্ছ্বাস আমাদের আলোড়িত করবে না, করতে পারে না। তাই এবারের জন্মদিনের সব উচ্ছ্বাস, আনন্দ, আয়োজন কেবলই চামেলীর দোয়া প্রার্থনার কাছে উৎস্বর্গ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমার শুভাকাঙ্খী, প্রিয়ভাজন, বন্ধুবর সবার কাছেই সনির্বন্ধ অনুরোধ: আপনারা আমাকে উইশ করার পরিবর্তে আমার সহধর্মিনী চামেলীর শঙ্কামুক্ত সুস্থতার জন্য প্রার্থনা করুন; আমি চিরকৃতজ্ঞ থাকবো।
(কারো মনে বিন্দুমাত্র কষ্ট দেয়ার জন্য আমার এ লেখনি নয়, বরং আপনাদের হাসিখুশিতে করা প্রার্থনা আমাদের জীবনকে সাভাবিক রাখতেই সাহায্য করবে বলে বিশ্বাস রাখি)