অফিসারের অর্ডার ছাড়া মারা যাওয়া যাবে না..! এমনকি শক্রুর কাছে ধরা পড়া কিংবা আত্মসমর্পনও করা যাবে না…!
কমান্ডারের অর্ডার ছাড়া তুমি মরতেও পারবে না, এমনকি সারেন্ডারও করতে পারবে না, যুদ্ধ শেষ হতে ৩ বছর লাগতে পারে, বা বড়জোড় ৫ বছর। এ যুদ্ধে অক্ষশক্তি (জাপান, জার্মানি ইতালি) জিতবেই। অবস্থা যেমনই হোক যুদ্ধ চলতেই থাকবে। আমেরিকান বাহিনীকে নাস্তানাবুদ করতে হবে।ওদের বিমানপোত ও পোতাশ্রয়ে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে হবে। ওরা সংখ্যায় বেশী হলে গেরিলা যুদ্ধ চালাতে হবে। জঙ্গলে টিকে থাকার কৌশল ( Survival tactics) তোমাকে শেখানো হয়েছে।
নাকানো মিলিটারি স্কুলে কমান্ডো ট্রেনিং (Futamata) শেষে ২৪শে ডিসেম্বর ১৯৪৪ তারিখে ট্রেনিং শেষে জাপান রাজকীয় বাহিনীর সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিরু ওনাডা (Hiroo Onada) কে এমনই ব্রিফ করা হয়।
এর সাথে যোগ হলো মা তামাল ওনোডো Tamal Onodo এর আদেশ, “ সামুরাই আজন্ম যোদ্ধা, সামুরাই কখনো শক্রুর হাতে ধরা পড়ে না, শক্রর হাতে ধরা পড়ার আগে প্রয়োজনে নিজেকে শেষ করে দিবে,” বলে ছেলের হাতে সামুরাই ড্যাগার তুলে দিলেন মা তামাল ওনোডো ( Tamal Onodo)। সাথে এও স্মরণ করে দেন যে, তার বাবা তানিজিরু ওনোডো (Tanejiru Onodo) চীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে আহত জাপানি সৈনিকদের আমৃত্যু চিকিৎসা সেবা দিয়ে গেছেন।
আদেশ মোতাবেক ফিলিপাইনের লুবাং দ্বীপে (Lubang Island) যোগ দিয়েই দেখতে পান বাহিনীর মধ্যে সমন্বয় ও নিরন্ত্রণহীনতা। জাপানি বাহিনীর বিশৃঙ্খলার সুযোগে ২৮শে ফ্রেব্রুয়ারী ১৯৪৫ আমেরিকান বাহিনী লুবাং নেমেই স্বল্প সময়ে দ্বীপের দখল নেয়। এ সময় সদ্য পদোন্নতি প্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট হিরু ওনোডোকে তার টিম নিয়ে পাহাড়ে চলে যাবার অর্ডার করলেন মেজর ইয়োসিমি তানিগুচি ( Yoshimi Taniguchi), পরিস্থিতি যেমনই হোক না কেন আমি তোমাদের কাছে আসবই, প্রমিজ করলেন মেজর।
ইতিমধ্যে আমেরিকান আক্রমনে ছত্রভঙ্গ জাপানি বাহিনী। পাহাড়ে হিরুর সঙ্গী হয় মাত্র ৩ জন, কর্পোরাল শইচি শিমাদা (Shoichi Shimada) প্রাইভেট ইউচি আকাটসু (Yuichi Akatsu) এবং প্রাইভেট ফাষ্টক্লাশ কিনশিচি কোজুকা। শুরু হয় গেরিলা যুদ্ধ আর টিকে থাকার লড়াই…
দিনের পর দিন, মাসের পর মাস তারা লুকিয়ে থাকে লুবাং জঙ্গল আর পাহাড়ে। ট্রেনিং এ শেখা টিকে থাকার কৌশল কাজে লাগে এবার, জঙ্গলের কলা নারিকেল, গ্রাম থেকে ধরে আনা গরুছাগল আর বন্য শুকর খেয়ে বেঁচে থাকে ওরা। নিয়মিত হামলা চালাতে থাকে পার্শ্ববর্তী গ্রাম আর স্থানীয় পুলিশের উপর। ১৯৪৫ সালের অক্টোবর মাসে তারা পার্শ্ববর্তী গ্রাম থেকে গরু ধরে আনার সময় লিফলেট কুড়িয়ে পায়, যাতে লেখা, “ ১৫ই আগষ্ট যুদ্ধ শেষ হয়েছে, পাহাড় থেকে বেরিয়ে এসো” এটা নিশ্চয়ই মিত্রশক্তির প্রোপাগান্ডা, তারা এটা বিশ্বাস করলো না। ১৯৪৫ সালের শেষদিকে জাপনি বাহিনীর চতুর্দশ এরিয়া আর্মি জেনারেল তমোয়ুকি ইয়ামাশিতা (General Tomoyuki Yamashita) স্বাক্ষরিত লিফলেট বিমান থেকে জঙ্গলে ছিটানো হয়। কিন্তু সেটাও মিত্রশক্তির ধেঁকা ভেবে তারা গেরিলা যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকে।
এর মাঝে নিজেদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টিহলে ১৯৪৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ইউচি আকাটসু দল ত্যাগ করে এবং ছয় মাস একাকি থেকে ১৯৫০ সালের মার্চ মাসে ফিলিপিনো বাহিনীর কাছে সারেন্ডার করে। তাতেও বাঁকি তিনজন দমে নি। এরপর ১৯৫২ সালে তাদের আত্মসমর্পনের আহ্বান জানিয়ে পরিবারের সদস্যদের চিঠি ও ছবি জঙ্গলের মাঝে ছিটানো হয় কিন্তু তাতেও ফলাফল আগের মতোই। কোন প্রচারনা কিংবা প্রোপাগান্ডা তাদের টলাতে পারেনি। ১৯৫৩ সালের জুন মাসে স্থানীয় জেলেদের সাথে গোলাগুলি তে শিমাদার পায়ে গুলি লাগে কিন্তু দক্ষ কমান্ডো হিরু চিকিৎসা করে তাকে পুরো সুস্থ্য করে তোলে। দূর্ভাগ্য বশতঃ ১৯৫৪ সালের ৭ই মে তাদের ধরতে আসা সার্চ পার্টির গুলিতে শিমাদা মারা যায়। এভাবেই ১৮ বছর চলমান গেরিলা যুদ্ধে ১৯৭২ সালের ১৯শে অক্টোবর গ্রামের ধানক্ষেতে আগুন লাগাতে গিয়ে স্থানীয় পুলিশের সাথে গোলাগুলিতে নিহত হন কোজুকা। এবার সম্পূর্ণ একা হয়ে পড়ে হিরু ওনাডো…
ইতিমধ্যে জাপানের ঘরে ঘরে প্রচার হয়ে গেছে হিরু ওনোডোর কথা। নোরিও সুজুকি নামের এক ভ্রমনপিপাসু সিদ্ধান্ত নেন তিনি হিরুর সঙ্গে দেখা করবেন, তাকে বোঝাবেন। লুবাং জঙ্গলে অনেক খোঁজাখুঁজির পর ১৯৭৪ সালের ২৮ শে ফেব্রুয়ারি তিনি হিরু ওনোডোর দেখা পান। তাকে জানান যে, সম্রাট ও জাপানবাসি তাকে নিয়ে অত্যন্ত চিন্তিত, তারা চান আপনি দ্রুত আত্মসমর্পন করুন। কিন্তু হিরু কোনমতেই বিশ্বাস করতে পারেনি যে, যুদ্ধে জাপান জিততে পারেনি কিংবা কোন জাপানি আত্মসমর্পন করছে। তারপরেও স্বদেশীর সাথে ইতিমধ্যেই বন্ধুত্ব গড়ে উঠায় তাকে সাফ জানিয়ে দেন, তার কমান্ডারের আদেশ ছাড়া তিনি আত্মসমর্পন করবেন না। দেশে ফিরে যান নোরিও সুজুকি। দেশে ফিরে তিনি বিস্তারিত সরকারকে জানালে খোঁজ শুরু হয় হিরুর যুদ্ধকালিন কমান্ডার মেজর ইয়াসিমি তানিগুচি’র। তিনি অবসরে গিয়ে পুস্তক ব্যবসায় নেমেছিলেন, তাকে খুঁজে বের করে লুবাং জঙ্গলে পাঠানো হয়। ১৯৭৪ সালের ৯ মার্চ তাদের দেখা হয়। মেজর ইয়াসিমি তানিগুচি যুদ্ধের সময় দেয়া প্রতিশ্রুতির কথা স্মরণ করে দেন, “পরিস্থিতি যাই হোক তোমার কাছে ফিরে আসবই”। তানিগুচি তাকে নিম্নরুপ আদেশ দেন…
১. ইম্পেরিয়াল কমান্ড অনুসারে, চতুরর্দশ এরিয়া আর্মি সমস্ত যুদ্ধ কার্যক্রম বন্ধ ঘোষনা করেছে।
২. সামরিক সদর দফতর আদেশ নং আলফা-২০০৩ অনুসারে, বিশেষ স্কোয়াড্রনকে সমস্ত সামরিক দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে।
৩. বিশেষ স্কোয়াড্রন কমান্ডের অধীন ইউনিট এবং ব্যক্তিরা অবিলম্বে সামরিক তৎপরতা এবং অপারেশন বন্ধ করে নিকটস্থ উর্ধ্বতন কর্মকর্তার নিকট নিজেকে উপস্থিত করবেন। যদি কোন অফিসার পাওয়া না যায় সেক্ষেত্রে তাদের আমেরিকান বা ফিলিপাইন বাহিনীর সাথে যোগাযোগ করতে হবে এবং তাদের নির্দেশ অনুসরন করতে হবে।
সেই আদেশ মোতাবেক ১৯৭৪ সালের ১১ ই মার্চ আনুষ্ঠানিক ভাবে ফিলিপাইনের তৎকালিন রাষ্ট্রপতি ফার্দিনান্ড মার্কোস এর হাতে মায়ের দেয়া সেই সামুরাই ড্যাগার তুলে দিয়ে আম্তসমর্পন করেন হিরু ওনোডো। জমা দেন তার নামে ইস্যুকৃত আরিসাকা ৯৯ মডেলের রাইফেল, ৫০০ রাউন্ড এ্যামুনেশন আর কিছু গ্রেনেড। সে অনুষ্ঠানে ফাষ্টলেডি ইমেলডা মার্কোসও উপস্থিত ছিলেন (ছবি দ্রষ্টব্য) উল্লেখ্য যে, আশির দশকে স্বৈরশাসক হিসাবে ফার্দিনান্ড মার্কোস এবং তার স্ত্রী ৭৫০০ জোড়া জুতা স্যান্ডেল ব্যবহারকারী সাবেক মিস ফিলিপাইন ইমেলডা মার্কোস ছিলো বিলাসী জিবনযাপনের জন্য বিশ্বে বহুল আলোচিত নাম। আজ থেকে ৪৮ বছর আগে ১২ ই মার্চ ১৯৭৪ বীরের বেশে মাতৃভূমিতে ফিরে যান জনপ্রিয় হিরু ওনোডা। পরে No Surrender, my thirty year War নামে আত্মজীবনিও লিখেন। সে কাহিনী র উপর সম্প্রতি হলিউডে 10000 Nights in Jungle নামে সিনেমাও নির্মীত হয়েছে…..
এটিই মনে হয় Loyality এর সর্বকালের অন্যতম সেরা উদাহরন,, মা, মাতৃভূমি যার আজন্ম ভালোবাসা ♥
লেখকঃ বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমির আইন প্রশিক্ষক হাসান হাফিজুর রহমান।