সমস্ত জমি বালুকাময়, ধূ-ধূকার, গাছ-গাছড়া নাই, কেবল দূরে দূরে দুই একটী বাবলা গাছের ছোট ছোট ঝাড়। ইহাই উটের খোরাক। যতই মদিনার নিকটবর্ত্তী হইলাম পানি ততই সুস্বাদু মনে হচ্ছিল,জিদ্দা বা নিকটবর্ত্তী মঞ্জিল সমূহের পানি কিছুটা কটু। কিন্তু ওহুদের ময়দান অতিক্রম করিতেই পানি ক্রমশঃ সুস্বাদু মনে হইতে লাগিল…
মক্কাবাসী দেখিতে কিঞ্চিৎ ক্ষুদ্রাকায়, অপেক্ষাকৃত মলীন, বাক্য ব্যবহারে হঠকারী, ক্ষিপ্র ও কলহ-প্রিয়। আহারাদির ব্যবস্থা সুখপ্রদ নহে। অধিবাসীদিগের মধ্যে অনেকেই আছে, যাহারা জীবনেও হজ্জব্রত পালন করে নাই। অন্যপক্ষে মদিনাবাসী দেখিতে সুশ্রী, দীর্ঘকায়, সত্যবাদী, কোমল স্বভাব, অতিথি-প্রিয় ও দান-পরায়ণ। বহু মদিনাবাসী প্রতি বৎসর হজ্জ উৎসবে যোগদান করেন। অতিথি আসিলে সমাদর করেন, স্বয়ং ক্ষুধার্ত থাকিয়া অতিথির সম্মান রক্ষা করেন। সকলেই পরিস্কৃত পরিচ্ছন্ন, কলহ নাই, বাদানুবাদ নাই। রন্ধনকার্যে অধিকতর পটু ও আহার প্রণালী শতগুণে শ্রেয়। কাহাকেও ধোঁকা দেন না। বহু পরিবারে হাবশী মহিলা রক্ষিত হয়। সুন্দরকায় মদিনাবাসী কুৎসিতকায় হাবশী স্ত্রীকে গ্রহণ করিতে নারাজ নহে।কৃষ্ণকায় ও শ্বেতকায়ের কী প্রেম-সম্মিলন! সভ্য জগত যাহা বর্ত্তমান যুগেও শিক্ষা দিতে পারে নাই, চৌদ্দশত বছর পূর্ব্বে একজন নিরক্ষর নবী তাহা শিক্ষা দিয়াছেন…
যখন দূর হইতে মসজিদে নববী নজরে পড়িল, তখন আনন্দের রোল উঠিল। অতঃপর মসজিদ নববীতে দাখিল হইলাম। আমাদের উষ্ট্রচালক ‘গণ দীর্ঘ্য ছফরের পর স্নানান্তে কি আগ্রহে কি সুস্বরে আজ হেরেম শরীফের মধ্যে কোরআন তেলাওয়াত করিতেছে। যাহাদিগকে নিঃস্ব ও নিরক্ষর উষ্ট্র চালক বলিয়া অবহেলার চোখে দেখিতাম আজ তারাই চরম ভক্তিভরে প্রেম অর্ঘ উৎসর্গ করিতেছে…
মরুতে ২৯ টী দিন অতিক্রম করিয়া কাফেলা মক্কা ভুমিতে উপস্থিত হইল। তখন আর মাত্র ৪টী দিন বাকি আছে হজ্জব্রতের, তাই সকলে মহোৎসবে যোগ দিতে প্রস্তুত হইতে থাকিল। নির্দিষ্ট দিনে মোয়াল্লেম আসিয়া আমাদিগকে আরাফাত ময়দান পানে চালিত করিলেন, সেখানে আমরা তাম্বু গাড়িলাম। জোহরায়েন নামাজ আদায় করিতে নগ্ন পদে মুন্ডিত মস্তকে চলিলাম মসজিদ পানে। মধ্যাহ্নের প্রচন্ড উত্তাপ, বালুকারাশি উত্তপ্ত। গাছ নাই, ছায়া নাই, কেবল সূর্য্যতাপ, ফুটন্ত বালুকারাশি অগ্নিকুন্ডে পরিণত। জবেহ করা মোরগ যেমন ছটফট করে সেইরুপ অবস্থা আমাদের। মছজিদ প্রাঙ্গণে একত্রে জোহর ও আছর নামাজ সমাধা করিলাম। সেখানে লক্ষ লক্ষ বান্দা সমবেত, আকাশ বাতাস মুখরিত, আর কোন ধ্বনি নাই, আর কোন শব্দ নাই, আছে কেবল অশ্রু প্রবাহ, হৃদয় বিদারক অনুতাপ, অপরাধ স্বীকার আর ক্ষমা প্রার্থনা। আফ্রিকা, এশিয়া, ইউরোপ, ইরান, তুরান, আফগান, বেলুচি,সিন্ধি পাঞ্জাবী, শ্বেতকায়, কৃষ্ণকায় সবারই একই পরিধেয় ইহরাম, একই বেশ, একই পরিচ্ছদ, সবারই মুখে একটাই ধ্বনি, একটাই সুর…
“লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক,
লাব্বাইকা লা শারিকা লাকা লাব্বাইক,
ইন্নাল হামদা ওয়াননিয়ামাতা লাকা ওয়ালমুলক লা শারিকা লাকা লাব্বাইক,
লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক…
লেখকঃ বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমির আইন প্রশিক্ষক হাসান হাফিজুর রহমান।