নির্জন নিস্তব্ধ দ্বীপ, প্রায় সন্ধ্যা, জঙ্গলের রাস্তা দিয়ে একাই হাঁটছেন, কিছুটা ভয় ভয় করছে, যদি সামনে কিছু পড়ে যায়, ভাবতেই বুকের ভেতর ছ্যাৎ করে উঠলো। হাঁটার গতি বাড়ালেন, তারপরেও মনের ভেতর কেমন জানি করছে। ভয় নিয়েই জোরে পা চালাচ্ছেন, হঠাৎ কী মনে করে বামে তাকাকেই চমকে উঠলেন, ডালে ঝুলে থাকা একটা পুতুল ঘাড় ঘুরিয়ে এক চোখে আপনাকেই দেখছে, তার আরেকটা চোখ নষ্ট, মুখে রহস্যময় হাসি….
দ্রুত ঘাড় ঘুরিয়ে অরেক পাশে তাকাতেই দেখলেন এ পাশের অবস্থা আরও ভয়াবহ,,, ঝুলে থাকা লতায়, গাছের ডালে কিংবা তারেও ঝুলছে অনেকগুলো ভয়াল দর্শন পুতুল কোনটার হাত নেই, কারো এক পা নেই তো কারো মাথা নেই…! এবার দৌড় শুরু করলেন, পেছনে তাকানোর সাহস হারিয়ে ফেলেছেন, আশেপাশে নিরাপদ জায়গা খুঁজতে খুঁজতে অনেক দূরে ছোট্ট একটা কাঠের বাড়ি দেখতে পেলেন, কাছে যেতেই বুঝলেন এ বাড়িতে ঢোকা যাবে না। বাড়িটার আঙ্গিনায়ও অজস্র পুতুল, ঘরের দেয়ালে, বারান্দায় এমনকি বাইরে থেকে যতটুকু দেখা যায় ঘরের ভেতরটাও পুতুলে ভর্তি। টের পেলেন আপনি মৃত্যুপুরী’তে। এখানে ঢোকা মোটেও উচিত হবে না, এবার দৌড় দিলেন ঘাটের দিকে, দূর থেকে ঘাটে ভেড়ানো খেয়া দেখা যাচ্ছে, যেয়েই টের পেলেন, ঘাটের পাড়ে, গাছের গোড়ায, ডালে এমনকি পাটাতনেও শুয়ে বসে দাঁড়িয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে পুতুল। মনে হচ্ছে, এরা সবাই আপনারই অপেক্ষায়…
না নাহ, এতকিছু ভাববার সময় নেই, কোনো দিকে মাথা না ঘুরিয়ে শ্বাস বন্ধ করে নৌকায় উঠতে গিয়ে দেখতে পেলেন, বৈঠা ধরে বসে থাকা পুতুলটা আপনারই দিকে তাকিয়ে, মনে হলো এতক্ষণ সে আপনারই অপেক্ষায় ছিলো, এবার তার মুখে বিজয়ের হাসি …..!
হাত পা হিম হয়ে আসা এমন কোন দ্বীপে যেতে চান…?
একটি নির্জন দ্বীপে সাধারনতঃ নানা প্রজাতির গাছপালা, কিছু বন্য প্রাণি, কিছু নিস্তব্ধতা আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যই থাকে। কিন্তু নির্জন কোন দ্বীপে গিয়ে যদি আপনি আবিস্কার করেন সমস্ত দ্বীপ জুড়ে রয়েছে শুধু পুতুল আর পুতুল। গাছের ডালে, গোড়ায়, তারে, লতায়, পরিত্যক্ত ঘরে, খেয়া ঘাটে যেদিকে চোখ যায় শুধুই পুতুল…!
মেক্সিকোর রাজধানী মেক্সিকো সিটির আজটেক ষ্টেডিয়াম (Estadio Azteca ১৯৭০ ও ১৯৮৬ বিশ্বকাপ ফুটবলের ফাইনাল ম্যাচের ভেন্যু। এছাড়াও ১৯৮৬ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে দিয়াগো ম্যারাডোনার করা “ঈশ্বরের হাত” এর গোল ও শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ ফিল্ড গোলটিও এমাঠেই হয়েছে) থেকে প্রায় ১৭ মাইল দক্ষিণে অবস্থিত সোচিমিলকো (Xochimilco) দ্বীপই সেই ‘পুতুলের দ্বীপ” স্থানীয় ভাষায় Isla de las Munecas বা The Island of the dead dolls
প্রায় শতবর্ষ আগে দ্বীপটি ছিল শীতল ও অন্ধকারাচ্ছন্ন। একদিন তিনটি শিশু খালের পাড়ে পুতুল বিয়ে খেলছিলো, হঠাৎ একটি শিশু উধাও। শুরু হয় খোঁজাখুঁজি, অনেক খোঁজার পর খালের পাড়ে শিশুটির মৃহদেহ পাওয়া যায়। সেই থেকে সাধারণ মানুষের কাছে দ্বীপটি হয়ে ওঠে ভয়ংকর এক দ্বীপ এবং লোকমুখে কালক্রমে প্রচলিত হয়ে আসছে নানা কাহিনী।পুতুলগুলো নাকি আজও আগুন্তকের দিকে চোখ ঘুরিয়ে তাকায়, হাত পা নড়াচড়া করে, ঈশারায় ডাকে, নিজেরা ফিস ফিস করে কথা বলে, এমনকী জোছনা রাতে তাদের ছায়াও হেঁটে বেড়ায়! অনেক সাহসী বীরেরও বুক কেঁপে ওঠে এই দ্বীপটিতে গেলে…
এই পুতুলগুলো কিন্তু এমনি এমনি এ দ্বীপে আসেনি। ১৯৫০ সালে ডন জুলিয়ান সানতানা বেরেরা (Don Julian Santana Berrera) নামক এক সন্ন্যাসী এখানে নির্জনবাসে আসেন। একদিন তিনি খালের পানিতে একটা কন্যাশিশুর মৃতদেহ ভাসতে দেখে অনেক চেষ্টা করেও তাকে বাঁচাতে পারেন নি। মৃতদেহের নিকটে ভাসতে থাকা তার পুতুলটা আশ্রমে এনে রাখেন। এরপর থেকে তার ঘরে অতৃপ্ত আত্মার চলাচল টের পান। আঙ্গীনায় লাগানো শাকসবজির ফলনও বন্ধ হয়ে যায়, অজ্ঞাত কারনে গৃহপালিত পশুপাখি মরে যেতে থাকে। কোনোভাবেই শাকসবজি ফলাতে পারছিলেন না…
একদিন স্বপ্নে দেখেন, সেই মৃতশিশুটি তার কাছে পুতুলটা ফেরত চাইছে। পরদিন তিনি পুতুলটা সেই খালের ধারে গাছে টাঙ্গিয়ে রাখেন। তাতেও পরিস্থিতি বদলায় নি, তাকে আবারও স্বপ্নে জানানো হয় যে, শুধু তার একার পুতুল দিলে হবে না। নিখোঁজ হওয়া সব শিশুরই পুতুল ফিরিয়ে দিতে হবে এবং অক্ষত পুতুল নয় তা হতে হবে বিকৃত বিভৎস। যা দেখলেই মনে হবে এরা মানুষের নির্যাতনে প্রাণ হারিয়েছে…
এরপর থেকে জুলিয়ান সান্তানা মানুষের ফেলে দেয়া নষ্ট ভাঙ্গা পুতুল, ময়লার স্তুপ থেকে পুতুল কুড়িয়ে এনে দ্বীপের চারপাশে টাঙ্গানো শুরু করেন। তার আঙ্গীনায় আবারও সবজি ফলা শুরু হয়। তখন থেকে জুলিয়ান সবজি বেচা টাকা দিয়ে পুতুল কিনে তা বিভিন্ন জায়গায় টাঙ্গানো শুরু করেন, এতে সেই শিশুটির আত্মা খুশী হতো। এভাবেই প্রায় ৫০ বৎসরে তিনি পুরো দ্বীপটাই লটকানো পুতুলে ভরে ফেলেন, গড়ে উঠে “পুতুল দ্বীপ”
বিগত ২০০১ সালে জুলিয়ান তার ভাইকে জানান, খালে মাছ ধরার সময় জলের নীচ থেকে কে যেনো তাকে বারবার ডাকে। সেবছরে তার কদিন পরই ২১ শে এপ্রিল সেই খালের ধারে জুলিয়ান এর লাশ পাওয়া যায়, ঠিক যেখানে মেয়েটির লাশ ভাসতে দেখা গিয়েছিলো…!!
মৃত্যুর কারন কেউ বলতে পারেনি…..
©Hasan Hafizur Rahman
*** মানুষের মধ্যে প্রচলিত ভ্রান্ত ধারণা দূর করার জন্য মেক্সিকান সরকার দ্বীপটিকে ‘ন্যাশনাল হেরিটেজ’ ঘোষণা করে দ্বীপটিকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করেছেন। তা স্বত্ত্বেও কোন মৌসুমে ২০/৩০ জনের বেশী পর্যটক আসছে না। তদুপরি, সেখানে কেউ রাত কাটাতে নারাজ। তাই ইসলা ডে লাস মিউনিকাস (The Island of the Dead Dolls) এর পুতুলগুলো এখন কোনও বাঙ্গালীর পদচারনার অপেক্ষায়..
আপনি যাচ্ছেন তো….?
লেখকঃ বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমির আইন প্রশিক্ষক হাসান হাফিজুর রহমান।