আজ একটা লাইব্রেরীর কথা বলি। প্রত্যন্ত জেলা সাতক্ষীরা শহর থেকে ২৬ কিলোমিটার দূরে নলতা শরীফের শ্যামল-সবুজ চত্ত্বরে লাইব্রেরীটি জ্ঞানের প্রদ্বীপ জ্বেলে দাঁড়িয়ে আছে। নাম আহ্ছানিয়া পাবলিক লাইব্রেরী। আহ্ছানিয়া মিশনের অসংখ্য সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের এটি একটি। লাইব্রেরীটি ১৯৮১ সালে প্রতিষ্ঠিত।
পাবলিক লাইব্রেরীকে বলা হয় জনগনের বিশ্ববিদ্যালয়। এখানে প্রবেশে পাঠক-ছাত্রদের না অাছে বয়সের সীমা, না আছে বই পছন্দের সীমা। যে কোন বয়সের যে কেউ যে কোন বই-পত্র এখানে ঘাটতে পারে বিনা বাঁধায়। স্কুল কলেজের ক্লাস বিন্যাস পাবলিক লাইব্রেরীতে খাটে না।
প্রতিষ্ঠার হিসেবে আহ্ছানিয়া পাবলিক লাইব্রেরীর বয়স এখন আটত্রিশ। শতবছরের প্রাচীন না হলেও লাইব্রেরীটির তাকে তাকে স্বযত্নে সাজানে সব শতবর্ষী বই। রোজ বিকেলে দ্বিতল লাইব্রেরীটি মুখরিত হয় জ্ঞানপিপাসু আবাল-বৃদ্ধ-বনিতায়। স্কুলের ছেলেরা যেমন আসে দলবেঁধে লাল সাইকেলে ছুটে, বয়স্করা আসে আগেকার দিনের বাটওয়ালা ছাতায় ভর করে। দশ-দূয়ারের খবর জানতে কেউ পাতা ওল্টায় খবরের কাগজের কেউ পাতা ওল্টায় পুরানো বইয়ের।
এখানে টেবিলভেদে বিন্যস্ত রয়েছে পত্র-পত্রিকা বিভাগ, একাডেমিক বিভাগ, তথ্য বিভাগ, ধর্মীয় শাস্ত্র বিভাগ। তাকে তাকে রয়েছে সাহিত্য, দর্শন, ধর্ম, সমাজ, ভাষা, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, শিল্প-কলা, ইতিহাস, রাজনীতি, চিকিৎসা ও বিদেশী সাহিত্য ও শিশু সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ দূর্লভ বই। হাজার দশেক প্রাণবন্ত বই হাজার দশেক পৃথক পৃথক জ্ঞানের প্রকোষ্ট নিয়ে তাকিয়ে আছে জ্ঞানপিপাসুর পথ চেয়ে। অনেক প্রাচীন কিছু ‘রেফারেন্স বুক’ লাইব্রেরীটির আভিজাত্য বাড়িয়েছে।
মানুষের দোরগোড়ায় অসীম বিদ্যার অালো জ্বালানোই আহ্ছানিয়া পাবলিক লাইব্রেরীর ব্রত। জনগনের এই বিশ্ববিদ্যালয়ের না আছে নিজস্ব আয়ের কোন উৎস, না আছে সরকারী পৃষ্টপোষকতা। এলাকার সজ্জন মানুষের স্বল্প সহায়তা আর আহ্ছানিয়া মিশনের পৃষ্টপোষকতাই লাইব্রেরীটির সামনে চলার উপায়। এক সময় লাইব্রেরীটি নাকি জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের সহায়তা পেতো। দীর্ঘদিন ধরে সে সহায়তাও বন্ধ। তবুও থেমে থাকেনি লাইব্রেরী, সময়ের প্রয়োজনে সাহসী পদক্ষেপে এগিয়ে যাচ্ছে প্রান্তিক গ্রামের এই প্রতিষ্ঠানটি। লাইব্রেরীটির পরিচালনা পর্ষদের অক্লান্ত পরিশ্রমে এটি একটি নির্মোহ প্রজ্ঞা কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।
সব শেষে একটা আক্ষেপের কথা বলি। কৈশোর নিয়ে আক্ষেপ, তারুণ্য নিয়ে আক্ষেপ! সভ্যতার সংকীর্ণ যুগে কিশোর আর তরুণেরা আজ মেগাবাইট ব্যয়ে ইন্টারনেটে নিষিদ্ধ ঠিকানা খুঁজতে ব্যস্ত। বিনে পয়সায় তারা লাইব্রেরীর ঠিকানা খুঁজতে একটুও ইচ্ছুক নয়। তারা বইকে সেকেলে ভাবে আর স্মার্ট হয় স্মার্ট ফোনে। ফলে তাদের কাছে কাঁচা নারীর গন্ধ কাঁচা বইয়ের গন্ধের থেকেও আকর্ষণীয়। বই বিচ্ছিন্নতা মানুষকে অসভ্য করে তোলে। গাঁও-গেরামের পাবলিক লাইব্রেরীগুলো হতে পারে সভ্যতা চর্চার প্রাণ কেন্দ্র। এ বিষয়ে অভিভাবকদের দূরদৃষ্টি কাম্য।
সময় পেলে আপনিও আসুন আহ্ছানিয়া পাবলিক লাইব্রেরীর কোরিডোরে। ডুব দিন বইয়ের ভাজে, সত্যের সভ্যতায়। লাইব্রেরীটি সাতক্ষীরার জনগণের বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবেই উচ্চারিত হোক এই প্রত্যাশা।
মোঃ মনিরুল ইসলাম
প্রভাষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান গবেষক, কলামিষ্ট ও লেখক