দুই বোন খাদিজা আর রহিমা- বাস করে গেন্ডার্রিয়ার একটা ঘিনজি এলাকায়! বাবা দ্বিতীয় বিবাহ করে বহুদিন লাপাত্তা! মা হাসপাতালে আয়ার কাজ করে -বেতন আর বখশিস মিলিয়ে আয় মন্দ না! মাসের শেষ সপ্তাহটা শুধু ভাত আর চ্যাপা শুটকি ভর্তা চললেও এমনিতে দুই মেয়ে আর এক ছেলের সংসার এই আয়ে মোটামুটি টেনে হিঁচড়ে চালিয়ে দেয়া যায় ! খাদিজা ফরসা, ছিপছিপে এবং অধিকাংশ বড় সন্তানের মতো অপেক্ষাকৃত সরল ! রহিমা কালো না হলেও শ্যামবর্নের, অ্যাথলেটদের মতো দশাসই ও পরিবারের অধিকাংশ মেজো সন্তানের মতো অপেক্ষাকৃত বুদ্ধিমতী ! বুদ্ধিমত্তা ছাড়াও আরেকটি বৈশিষ্ট্য তার মধ্যে প্রবলভাবে বিদ্যমান তা হলো সে হিংসুটে !
বাংলাদেশ এমন একটি দেশ যেখানে এ যুগেও সাদা চামড়াই সৌন্দর্যের প্রধান মাপকাঠি ! এটা রহিমার সার্বক্ষণিক অন্তর জ্বালার কারন ! নিজের আপন বোনসহ পৃথিবীর সকল ফরসা মেয়েকে সে ঘৃণার চোখে দেখলেও মায়ের ব্যাগ থেকে টাকা চুরি করে লতা হারবাল আর ফেয়ার এন্ড লাভলী নিয়মিত ব্যবহার করতে সে কক্ষোনো ভোলে না ! বড় বোন খাদিজাকে তার একটা বড় সাইজের বেকুব মনে হয় অথচ পাড়ার সব ছেলেরা শুধুমাত্র গায়ের রং এর কারনে এই বেকুবের পেছনে ঘুরঘুর করে এটা তার অসহ্য বোধ হয় !
ছোটবেলা থেকেই রহিমা উপলব্ধি করতো টাকাপয়সা জীবনে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ! নৈতিকতা যে কেবলই কেতাবী শব্দ আর ছাপোষা জীবের মতো জীবিকা নির্বাহ করাটাই যে জীবন নয় এটা সে কৈশোরেই বুঝে গিয়েছিল ! তাই তার নজর ছিলো গেন্ডারিয়া এলাকার সন্ত্রাসী ফজল সরদারের ছোট পুত্র গাজা ব্যবসায়ী রমজানের দিকে! রমজান উঠতি যুবক, চেহারাটা সুন্দর স্বীকার করতেই হবে ! সালমান খানের মতো ঘাড়ের পেছনে সানগ্লাস ঝোলানো ! জিম করা পেশীবহুল হাতের মাসল অতিরিক্ত টাইট টি শার্টের নিচে কিলবিল করে – এটা দেখে রহিমা একলা দুপুরে মনে মনে কত যে উত্তেজিত হয়েছে ! একটাই দোষ কপালের উপর সাপের ফণার মতো পরে থাকা চুলের গোছা সোনালী রং করা ! তবে পুরুষের একটা কেন, একশটা দোষ ঢাকা পরে যায় যদি পকেটে মালপানি মানে টাকা থাকে ! গাঁজার ব্যবসা করে রমজান প্রচুর কাঁচা পয়সার মালিক ! গাঁজার ব্যবসায় লাভ বেশি, ধরা পরলে দ্রুত জামিন হয় ! ইয়াবা ব্যবসায় লাভ বেশি হলেও জামিন হতে অনেক দেরী হয় ফলে লস হয় বহুত ! যাই হোক , এই রমজানের সাথে প্রেম আর বিয়ে হলে জীবনটা যে সুখে কাটবে এটা রহিমা বুঝে গিয়েছিল ! তাই রমজান যখন গেন্ডারিয়ার ধূপখোল মাঠে গাঁজার পুরিয়া বিক্রি শেষে দলবল নিয়ে বসে চায়ের দোকানে চা খেত আর হিন্দি গানের তালে তালে চুটকি বাজাত তখন রহিমা অকারণেই তার সামনে দিয়ে যাওয়া আসা করতো আর আলগোছে বুকের ওড়না ফেলে দিতো ! কখনও বা শ্যাম্পু করা ফুরফুরে চুল রমজানের মুখে একটা ঝটকা দিয়ে চা দোকানদারকে বলতো , “মামা,একটা ড্যানিশ কেক দ্যান- না, না চা খামু না, এমনিতেই রাইতে চউক্ষে ঘুম নাই !” বলতে বলতে আঁড়চোখে তাকিয়ে দেখতো- রমজানের মুখ ভাবলেশহীন ! আঁটসাঁট ফিটিং কামিজে উন্নত বক্ষ আর সুবাসিত ঘন কালো চুল দেখিয়েও তাকে আকৃষ্ট করতে না পেরে হতাশ লাগতো বটে কিন্তু হতোদ্যম হতো না !
রহিমার কল্পনার উড়ন্ত ফানুস একদিন জ্বালিয়ে সবকিছু ছাড়খাড় করে দিল যেদিন রমজান হঠাৎ হাতছানি দিয়ে রহিমাকে ডাকলো ! রহিমার হৃদস্পন্দন বন্ধ হবার যোগাড় – সত্যিই কি তার সাধনা আজ সফল হতে চলল? কাছে এসে রহিমা যখন রমজানের লালচে চোখে চোখ রাখলো তখন রমজান বলল,” একটা কথা কই- রাখবা ??” রহিমার গলার কাছে কি যেন দলা পাকিয়ে আছে, বুকের মধ্যে এমনভাবে ধড়াস ধড়াস করছে মনে হচ্ছে পুরো ধূপখোলা মাঠ জেনে যাবে তার অবদমিত কামনার কথা! রমজান বুক পকেট থেকে একটা চিঠি বের করলো- চিঠি থেকে কড়া ওডিকোলনের গন্ধ আসছে! গলার স্বর খাদে নামিয়ে খানিকটা ইতস্তত করে অসফুট কন্ঠে বলল, “এই চিঠিটা খাদিজারে দিতে পারবা ? “
এ কি শুনছে রহিমা ? মাথামোটা নির্জীব পটের বিবি খাদিজাকে ভালবাসে রমজান – শুধু সাদা বলেই ? প্রায়ানধকার ধূপখোলা মাঠে রহিমার চোখের ধকধকে প্রতিহিংসার আগুন রমজানের সপ্নালু চোখ এড়িয়ে গেল” খাদিজারে একটাবার দেখা করতে কইও আমার সাথে”মিনতি ঝরে পরে তার কন্ঠে !
রমজান দলবল নিয়ে চলে গেলেও ঘনায়মান অন্ধকারে ঠায় দাডিয়ে থাকে সে। বোনের প্রতি শৈশবলালিত অসম্ভব ঘৃণা আজ রূপ নেয় তিব্র প্রতিশোধ সপৃহায় ! প্রতিশোধ নিতে হবে – চরম প্রতিশোধ !!!
এর কিছুদিন পরের কথা ! ফজল সরদারের বাসা থেকে আনুষ্ঠিক প্রস্তাব আসার পর মোটামুটি ধুমধামেই রমজানের সাথে খাদিজার বিয়ে হয়ে যায় ! বিয়েতে খাদিজার পরিবারের এক টাকাও খরচ হয়নি- সব করেছে রমজান ! বিয়ের কোন আনুষ্ঠিকতাতেই রহিমা অংশ নেয়নি, অসুস্থতার অজুহাতে শুয়ে থেকে জ্বলে পুড়ে অংগার হয়েছে কেবল!
বিয়ের চার মাসের মধ্যেই জানা গেলো খাদিজা অন্তঃসত্ত্বা ! খাদিজা নরম সরম! দাম্পত্য জীবনের একেবারেই অনাস্বাদিত প্রাত্যহিকতার সাথে খাপ খাওয়াতে না খাওয়াতেই গর্ভকালীন শারীরিক অভিজ্ঞতার মধ্যে পরে হাবুডুবু খেতে থাকে সে ! মা হাসপতালের আয়ার কাজ করে ফুরসত পাননা।তাই একদিন কিছুটা কুন্ঠিত হয়েই রহিমাকে তিনি অনুরোধ করলেন খাদিজার শ্বশুড় বাড়িতে গিয়ে বোনকে সাহায্য করার জন্য ! অতি আশ্চর্যের বিষয়- কেন যেন সে সাগ্রহে রাজী হয়ে গেল ! মা জানতেও পারলেন না কি দুরভিসন্ধি নিয়ে রহিমা ব্যাগ গুছিযে রওনা হলো বোনের শশুড় বাড়ি!
সেখানে গিয়ে আরেক পত্তন টাসকি খেলো রহিমা ! পুরানো আমলের বিশাল বাড়ি ! প্রতিদিন অন্তত ষাট জন লোক দু’বেলা খায়- সন্ত্রাসী গ্রুপের সকলের জন্যই লংগরখানা খোলা ! এলাকার থানার কনস্টেবলদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা ! ফজলের তৃতীয় স্ত্রী মায়মুনা নিজে বোরখার আড়ালে নথ নেড়ে নিজে খাবার তদারকি করেন ! রমজান বার বাড়িতে খায়- সেই খাবার আগে নিয়ে যেত খাদিজা! কিন্তু এখন খাদিজা নিজের স্ফীত উদরের সংকোচে কিছুটা দূরে দূরেই থাকে- খাবার নিয়ে যায় রহিমা! একেবারে গা ঘেষে বসে যখন বেড়ে দেয় তখন অতি সাবধান অসাবধানতায় রমজানের চওড়া কাঁধের সাথে বুক দিয়ে আলতো স্পর্শ করে! হাত নেড়ে গল্প করার ছলে প্রায় সময় রমজানের উরুর উপর হাত রাখে সে ! রমজান যদিও খাদিজাকে প্রচন্ড ভালবাসে তারপরও এই উপরি স্পর্শসুখ মন্দ লাগেনা তার !
পরিবারের সকলের কাছেও বিভিন্নভাবে খাদিজাকে অপদার্থ মাথামোটা প্রমান করার সূক্ষ্ণ চেষ্টা নিরলসভাবে করে যায় সে …
(চলবে)
লেখকঃ ডাক্তার সাবরিনা।