আকিবুজ্জামিন।। বাংলাদেশের ইতিহাসে খুলনা জেলা এক গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল হিসেবে পরিচিত। তবে এই এলাকার একটি কম আলোচিত কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হলো ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে গোপন গোয়েন্দা কার্যক্রম এবং স্থানীয় জনগণের গোপন সংগ্রাম। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস যেমন আমাদের জাতীয় সত্তাকে গভীরভাবে ছুঁয়ে যায়, তেমনি ব্রিটিশ আমলের বিপ্লবী ও গোয়েন্দা কার্যক্রম আমাদের ইতিহাসের একটি হারিয়ে যাওয়া কিন্তু মূল্যবান অংশ।
বিপ্লবী কার্যক্রম এবং গোপন সংগঠন।
{ একটি রিসার্চ প্রতিবেদন }
১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ থেকে শুরু করে ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশদের প্রস্থান পর্যন্ত, পুরো ভারতজুড়ে বিপ্লবী কার্যক্রম চলছিল। তবে দক্ষিণ বাংলার খুলনা অঞ্চল ছিল এই সংগ্রামের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু। যদিও অনেকেই হয়তো ভাবতে পারেন যে মূলত শহরাঞ্চল বা বড় বড় কেন্দ্রীয় স্থানে বিপ্লবী কার্যক্রম বেশি হত, খুলনার গ্রামাঞ্চলেও ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে প্রচুর বিপ্লবী কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছিল।
এলাকার মানুষগুলো সাধারণত কৃষিকাজ বা নদীর কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও তারা যে বিপ্লবী চেতনায় উজ্জীবিত ছিল তা প্রমাণিত হয় গোপনে গড়ে ওঠা বিভিন্ন সংগঠনের মাধ্যমে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ‘অনুশীলন সমিতি’। এই সংগঠনটি খুলনার বিভিন্ন এলাকায় সশস্ত্র সংগ্রামের পরিকল্পনা করে এবং স্থানীয় তরুণদের বিপ্লবী হিসেবে গড়ে তোলে। তাদের মূল লক্ষ্য ছিল ব্রিটিশ পুলিশের নজরদারি এড়িয়ে গোপনে অস্ত্র সংগ্রহ এবং জনসমর্থন তৈরি করা।
*** স্থানীয় গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক ***
খুলনার গোপন গোয়েন্দা কার্যক্রমকে সবচেয়ে ভালোভাবে বোঝা যায় ,তখনকার স্থানীয় জনগণের মধ্যে গড়ে ওঠা গোপন নেটওয়ার্ক থেকে। এই নেটওয়ার্কগুলো ব্রিটিশ পুলিশের নজর এড়িয়ে বিপ্লবী তথ্য সংগ্রহ এবং যোগাযোগ রক্ষার কাজে অত্যন্ত কার্যকর ছিল। খুলনার কুমিরমারা, কয়রা, এবং সাতক্ষীরা এলাকার গোপন নেটওয়ার্কগুলো বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এরা স্থানীয়দের সহযোগিতায় ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনার কৌশল নির্ধারণ করত।
এই গোপন গোয়েন্দারা অনেক সময় নদী পথে যোগাযোগ করত এবং নৌকাকে ব্যবহার করে বিভিন্ন জায়গায় তথ্য আদান-প্রদান করত। তাদের এই কার্যক্রম এতটাই দক্ষ ছিল যে অনেক সময় ব্রিটিশ পুলিশও তাদের কার্যকলাপ টের পেত না।
*** কয়রা অঞ্চলের দস্যুদের বিরুদ্ধে গোপন গোয়েন্দা কার্যক্রম ***
খুলনার নদীসংলগ্ন কয়রা অঞ্চলটি দস্যুদের দ্বারা প্রভাবিত ছিল। এই অঞ্চলের জনগণ দস্যুদের হাতে বারবার অত্যাচারের শিকার হতো। তবে স্থানীয় কিছু সাহসী মানুষ গোপনে দস্যুদের বিরুদ্ধে তথ্য সংগ্রহ করে স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করত। এই গোয়েন্দা নেটওয়ার্কের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল দস্যুদের গতিবিধি নজরে রাখা এবং সঠিক সময়ে পুলিশ বা সামরিক বাহিনীকে জানানো। যদিও এই গোয়েন্দা কার্যক্রম গোপনে পরিচালিত হতো, তবুও এটি স্থানীয় মানুষের জীবন বাঁচাতে এবং তাদের সম্পদ রক্ষা করতে অসামান্য ভূমিকা পালন করেছে।
এছাড়াও, এ অঞ্চলের কিছু মৎস্যজীবী এবং স্থানীয় নৌকাচালকরা গোপনে সরকারের কাছে দস্যুদের তথ্য সরবরাহ করত। এদের সাহসিকতা ও কৌশলী পরিকল্পনার জন্য দস্যুদের অনেক পরিকল্পনা ভেস্তে যেত। স্থানীয়রা হয়তো তৎকালীন ব্রিটিশ প্রশাসনের প্রতি ভালোবাসা থেকে এই কাজ করেনি, বরং নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্যই এই গোয়েন্দা কার্যক্রমে যুক্ত হয়েছিল।
*** খুলনার গোপন গোয়েন্দা কার্যক্রমের গুরুত্ব ***
বিপ্লবী কার্যক্রমের পাশাপাশি খুলনার গোপন গোয়েন্দারা স্থানীয় জনগণের নিরাপত্তা রক্ষা ও ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামের একটি বড় অংশ ছিল। এই গোয়েন্দা নেটওয়ার্কগুলো কেবল দেশপ্রেমিক বিপ্লবীদের জন্যই কাজ করেনি, তারা সাধারণ মানুষকেও দস্যুদের হাত থেকে রক্ষা করত।
অধিকাংশ ক্ষেত্রে, এই গোয়েন্দাদের পরিচয় গোপন থাকত, এবং তারা জনসমক্ষে আসত না। অনেক সময় তারা নিজেদের পরিচয় এমনভাবে লুকিয়ে রাখত যে স্থানীয় জনগণও জানত না তাদের এলাকায় এমন কোনো গোপন কার্যক্রম চলছে।
*** হারিয়ে যাওয়া ইতিহাসের পুনরুদ্ধার ***
খুলনার এই গোপন গোয়েন্দা কার্যক্রমের ইতিহাস আজকের দিনে হয়তো অনেকাংশে বিস্মৃত। তবে এটি আমাদের ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়, যা খুলনার স্থানীয় সমাজের সাহসিকতা, দূরদর্শিতা এবং আত্মত্যাগের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা যদি এই হারিয়ে যাওয়া ইতিহাস পুনরুদ্ধার করতে পারি, তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এটি একটি মূল্যবান শিক্ষার উৎস হতে পারে। আমাদের দেশপ্রেম এবং নিজস্বতা রক্ষার জন্য যেসব মানুষ গোপনে সংগ্রাম করেছে, তাদের কাহিনী জানতে এবং জানাতে হবে।
এই গল্পগুলো শুধু স্থানীয় পর্যায়ে সীমাবদ্ধ ছিল না। তাদের সংগ্রাম পুরো বাংলাদেশের বিপ্লবী কার্যক্রমের সাথে মিশে গিয়েছিল। তাই এই গোপন গোয়েন্দা কার্যক্রম আমাদের জন্য শুধু খুলনার ইতিহাস নয়, বরং গোটা বাংলাদেশের বিপ্লবী ইতিহাসের অংশ হিসেবেই বিবেচিত হওয়া উচিত।
*** উপসংহার ***
খুলনার গোপন গোয়েন্দা কার্যক্রম আজ হয়তো কালের গহ্বরে চাপা পড়ে গেছে, কিন্তু এর প্রভাব আজও টিকে আছে আমাদের ইতিহাসের গভীরে। স্থানীয় বিপ্লবী এবং সাধারণ জনগণ কিভাবে দস্যুদের হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করেছে এবং কিভাবে ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে গোপনে তথ্য সংগ্রহ করে সংগ্রাম করেছে, তা আমাদের জন্য একটি দৃষ্টান্ত। এই ইতিহাস পুনরুদ্ধার করা এবং জনসাধারণের সামনে তুলে ধরা অত্যন্ত জরুরি, যাতে আমরা বুঝতে পারি আমাদের পূর্বপুরুষদের কিভাবে সংগ্রাম করতে হয়েছে।
আজকের দিনে দাঁড়িয়ে এই হারিয়ে যাওয়া ইতিহাসকে পুনরুদ্ধার করার জন্য আমাদের প্রচেষ্টা চালানো উচিত। এটি শুধু খুলনার নয়, বরং পুরো জাতির জন্য একটি প্রেরণা হয়ে দাঁড়াতে পারে।
বৃহত্তর খুলনার ইতিহাস আধিপত্য তরুণ সমাজের নিটক ধরে তুলার ক্ষুদ্র প্রয়াস।