গত ২৩ ফেব্রুয়ারি অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী লেখক-গবেষক নাজমীন মর্তুজা মাটি ও মায়ার টানে দেশে আসেন কিছুদিনের জন্য। কিন্তু করোনা ভাইরাস এর ফলে সারাবিশ্বের মতো আমাদের দেশ ও স্থবির হওয়ায় নিজ গ্রামে অবস্থান করছেন। তিনি নিজ উদ্যোগে সচেতনতা ও মানুষকে যথাসম্ভব সাহায্যের চেষ্টা করে চলেছেন। যারা অসহায় কিন্তু চাইতে পারেনা তাদের জন্যও নিজ ফেসবুকে ম্যাসেজের মাধ্যমে জানানোর আহবান করেছেন। আজ তার একটি উদ্যোগের সম্মান জানাতে কবির অনুমতি ছাড়াই হুবহুই তুলে ধরলাম।
“প্রায় ১৯ দিন হলো আমি গ্রামে এসেছি , কোয়ারেন্টাইনে আছি , প্রবাস থেকে এসেও আমি আমার আত্মীয় বন্ধু বান্ধব থেকে বহুদূরে আছি , মন চাইছে এক ছুটে চলে যাই এপাডা় থেকে ওপাড়া , কিন্তু উপায় নেই , আমি গৃহাভ্যন্তরিন থেকে অন্যকে ভালো রাখার চেষ্টা করছি । প্রথম প্রথম কিছুদিন আব্বা আম্মা দু একজন চাচীদের সাথে রান্না ঘরে বসে রুটি বানিয়েছি , ভাপা পিঠা , খই মুড়ি ভেজে খুব আনন্দে কাটিয়েছি , যতই দিন অতিবাহিত হচ্ছে ততই যেন বাহিরের জগত থেকে বিচ্ছিন্ন হচ্ছি .. রান্নাঘরের মজমাও বন্ধ , যেই বাসায় আসে তাকেই বাইরে হাত ধুয়ে আসার জন্য অনুরোধ করা হয় । নিদৃষ্ট চেয়ারে বসতে বলা হয় , সাথে যদি মাস্ক না থাকে তো নিজের সংগ্রহে থাকা মাস্ক বের করে দিয়ে তিন মিনিট করোনা ভাইরাস নিয়ে বলেছি , সচেতন করেছি , এরমাঝে সেনাবাহিনীর লাঠির ভয়ে অবাধ্য কিছু মানুষ যদিও ঘর মুখি হয়েছে , কিন্তু বাইরের চাতালে গল্পের আসর , আর গাদাগাদি হয়ে লুডু খেলা কমেনি , উঠতি ছেলেদের ক্রিকেট খেলা বন্ধ হয়নি। মাঝে মাঝে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ওদের উল্লোসিত চিৎকার বোল্ড বোল্ড শুনি , আর ভাবি করোনার কথা কি ওরা জানে না , টিভি দেখে না , ? ডিজিটাল বাংলাদেশের নতুন প্রজন্ম, হোক না তারা গ্রাম কিংবা শহর , সবাই তো জানে ফেসবুক -ইমু -হুয়াটসআপ , তবে ওদের মনে কি একটুও ভয় হয় না !
একজন কে ডেকে বল্লাম … বাবা রা তোমরা খেলো ঠিক আছে কিন্তু মাস্ক ব্যবহার করো , দু একজন হেসেই বল্লো ধুর আন্টি , কিচ্ছু হবে না , বাংলাদেশে করোনার খাওয়া নাই , চাতালে কাজ করা মহিলাদের মুখে মাস্ক নেই , খুক খুক করে কাশি দিতে দিতে কাজে যাচ্ছে , দেখেই আমি আতকে উঠি , ডেকে বলি “ও বুবু মাস্ক বান্ধে কাজ করো না কেন ?” বলে কম দামী মাস্ক গুলাও ২০ টাকা বহিন “ আমরা বাড়িতে ৮ জন , ৮ খান কিনিবা গেইলে ১৬০ টাকা , চাউল হবে দুদিনের … “মরন হইলে হবে , করোনা না হইলেও মরণ হইলেও মরণ “।
বুঝলাম ক্ষুধা না খেয়ে মরার চিন্তার আগে করোনার জন্য চিন্তা তাদের নেই । বিষন্ন মন নিয়ে ভাবছি কি করা যায় , কিছু একটা করতে হবে , আমার সাধ্যের মধ্যে আমার ক্ষমতার মধ্যে । পাড়ায় যাদের মেশিন আছে , তাদের ডাকলাম , বল্লাম আমার সাথে কাজ করবে , গরীবদের জন্য হেল্প করবে , বাড়ির কাজের ফাঁকে, আমি পাঁচশ থেকে একহাজার মাস্ক বানাতে চাই , আমার কথায় ওরাও রাজী হয়ে গেল , মনটা কিছু একটা করার তাগিদে নেচে উঠলো , বাসায় বসে ভাবছি চারদিকে বাস বন্ধ, দোকানপাট বন্ধ , খোঁজ নিয়েও ম্যটেরিয়াল জোগার করতে পারলাম না , কি করি কি করি … কি করে পাই রাবার ফিল্টার ফেব্রিক, সবাই এসে খবর দিলো দোকান খোলা নেই , মনটা বিষন্ন হলো , আম্মাকে বল্লাম আম্মা বাসায় টুকরো কাপড় নেই আম্মা বল্লো আছে … নতুন দুটো পাতলা বেডশিট আছে ….
হাতে নিয়ে নাকে লাগিয়ে দেখলাম ঠিক আছে শ্বাস নেয়া যাচ্ছে , কাটতে বসে গেলাম , আমার হেল্পার গুলোও মহা খুশি , এবার রাবার নাই , আমাদের পরিচিত এক ভাবী এসে বল্লো আপু আমি রাবার দিবো আছে আমার কাছে … উনি রাবার দিয়ে গেলেন, তারপর একে একে কেউ কেউ নতুন টুকরো কাপড় দিয়ে গেলেন ,
আমার মাস্ক বানানো শুরু হলো প্রতিদিন একশ করে , জানি না এই মাস্ক কতটুকু করোনার জন্য উপোযোগী কিন্তু এসময় যা হাতের কাছে থাকে সেটা নাকে দিয়ে কাজে কিংবা বাইরে যাওয়াতে কিছুটাতো হেল্প হবে , তারপর অনেকেই আমাকে বলতে লাগলো আপু কিছু চান দেন … উনারা কষ্টে আছেন উনাদের খুব অভাব …. পাড়ায় খোঁজ নিয়ে দেখলাম জনা ৩০ টা পরিবার অসহায় মধ্যবিত্তের অভিসাপে অভিসপ্ত , না পারে চাইতে না পারে সইতে ।
আম্মা কিছু চাল দিলো ,এবং আমার নিজের সাধ্য অনুযায়ী চাল যতটুকু পারি সাথে আলু সাবান ব্লিচিং পাউডার ডাল দিলাম । মনের মধ্যে তবুও অশান্তি যদি আরও দিতে পারতাম , যদি আরও কারো কাজে আসতে পারতাম ,
আমি সাধারণ মানুষ ইচ্ছা থাকলেও সাধ্য সীমিত । যারা ঘরের ভেতরে আছেন যাদের মেশিন আছে আপনারাও ঘরে বসে কাপড়ের মাস্ক গুলো বানিয়ে ফেলতে পারেন , ঘরের স্টোরে কত খাবারই তো আমাদের পরে থাকে দেখুন না একটু স্টোরটা গুছিয়ে রাখতে রাখতে
পরে থাকা নুডুলস , ডাল , শুটকী , বিস্কুট, চিড়া , সেমাই . চিপস , আটা , কতকিছুই তো আছে একটু একটু করে , সে গুলো ব্যাগে রাখুন , আপনার নেইবারকে বলুন … একসাথে করে , দিয়ে আসুন … আপনাদের পরিচিত মহলেই ।
একেই বলে দশের লাঠি একের বোঝা , সবাই মিলে সাধ্যের মধ্যে যতটুকু পারি দিয়ে এই সংকট কাল কাটিয়ে উঠবার শক্তি সন্চয় করি ।
আমাদের দেশের মধ্যবিত্ত মানুষরা বড্ড অসহায় , মধ্যবিত্তরা সবচেয়ে চাপে আছে , একেবারে নিম্নশ্রেনীর মানুষরা তবু চাইতে পারে , কিন্তু উনারা চাইতেও পারেন না ।
মানুষ তো মানুষের জন্য ।
একটু সহানুভুতি কি মানুষ পেতে পারে না ।
আসুন না দশে মিলে কাজ করি, করোনার ভয় কে জয় করি।”
আসুন, সবাই যার যার অবস্থান থেকে যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী পাশে দাঁড়িয়ে ঘরে অবস্থান করার নিশ্চয়তা প্রদানে সহযোগিতা করি। করোনার আক্রমণ থেকে নিজেকে, সমাজকে ও দেশকে রক্ষার যুদ্ধে অংশগ্রহণ করি।
#হাসানূর রহমান সুমন
মানুষের কল্যাণে প্রতিদিন